logo
news image

পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের শোবিজ জগতেও বিবাহবিচ্ছেদ

শাকিব-অপুর দাম্পত্য সম্পর্ক এখন অতীত। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন তারা। সংসারও করেছেন, তাদের সন্তান পৃথিবীতে আলোর মুখও দেখেছে। তারপরও মাত্র ১১ বছরের মাথায় ডিভোর্স নামক শব্দটি দিয়ে তারা দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। সব শ্রেণির মানুষ এমনকি তাদের দর্শক-ভক্তরাও এই ভাঙনে হতাশ। শাকিব-অপুর বিচ্ছেদকে কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এই মেনে না নেওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো তাদের সন্তান আছে। একসময় বাচ্চাটি যখন বুঝতে শিখবে তখন বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের ঘটনা তার মনে কেমন প্রভাব ফেলবে। এতে তার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ারই কথা। মনোবিজ্ঞানী আর সমাজবিজ্ঞানীদের কথায়, তারকারা তাদের বিয়ে আর সংসারকে রীতিমতো তাসের ঘর বানিয়ে ফেলেন। দীর্ঘদিন গোপন প্রেম, তারপর গোপন বিয়ে, এমনকি গোপনে সন্তানের জন্মদান, তারপর একসময় সবকিছু ফাঁস। কিছুদিন পরই ডিভোর্স। এটি চরম অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব ঘটনায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিখবে আর কোন পথে হাঁটবে। এ বিষয়টি তারকাদের ভেবে দেখা উচিত। কারণ অনেকেই সেলিব্রেটিদের আদর্শ হিসেবে মানেন। তাদের অনুকরণ ও অনুসরণ করেন।

শাকিব-অপুর পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তাহসান ও মিথিলার বিচ্ছেদ। কারণ, ভক্তদের পাশাপাশি এই দম্পতি তারকাদের আদর্শ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তাহসান ও মিথিলার বিবাহবিচ্ছেদ তাদের ভক্ত-শ্রোতাদের কষ্টের সাগরে ভাসিয়েছে। বহু বিবাহবিচ্ছেদ মেনে নিতে পারলেও এটি তারা মেনে নিতে পারেননি।

‘রেহান তো খুবই নরম প্রকৃতির মানুষ। আমার মনে হয় না ওর কোনো রাগ আছে। রাগ থাকলে আমার আছে।’ ২০১১ সালে দ্বিতীয় বিয়ের পর এমনটাই বলেছিলেন হাবিব। বিবাহবিচ্ছেদের পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই গায়ক ও সংগীত পরিচালক বলেন, ‘দেখুন, দুজন মানুষের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ভালো লাগা ভালোবাসা কাজ করে। আবার কিছু বিষয়ের সমাধান হয় না। তেমন কিছুই আমাদের মধ্যে হয়েছে। এ কারণে আলাদা হয়ে গেছি।’

পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের  শোবিজ জগতেও বিবাহবিচ্ছেদ এখন মামুলি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে হারে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে, তাতে দেশের সাধারণ মানুষও তারকাদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন। অনেকের মতে, বিয়েটা বেশির ভাগ তারকার কাছে ছেলেখেলা হয়ে গেছে।

গত কয়েক বছরের মধ্যে অহনা, তিন্নি-হিল্লোল, মিমো, মোনালিসা, অপি করিম, মিম, হাবিব-রেহান, শখ-নিলয়, তাহসান-মিথিলা, মিলা-পারভেজ সানজারি, স্পর্শিয়া-রাফসান, বাঁধন-সনেট, নোভা-রায়হান, হূদয় খান-সুজানা, মুরাদ পারভেজ-সোহানা সাবাসহ অনেকের ঘর ভেঙেছে। আরও আগের কারও কথা বলতে গেলে শমী কায়সার-রিঙ্গো, হুমায়ুন ফরীদি-সুবর্ণা মুস্তাফা, জয়া আহসান-ফয়সাল, বিজরী-ইমন দম্পতিসহ অনেকের নাম বলা যায়।

তারকাদের সংসার ভাঙার পেছনে প্রধান কারণ হলো সন্দেহ এবং অবিশ্বাস। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, তারকাদের মধ্যে বহুগামী বিষয়টির প্রভাব বেশি। আর এ কারণেই তাদের সংসারে সহজেই টানাপড়েন দেখা দেয়, বিচ্ছেদে গড়ায় সম্পর্ক। যারা একে অপরকে সেক্রিফাইস করে চলতে পারেন তাদের সংসার ভাঙতে দেখা যায় না।

এ দেশে এমন অনেক তারকা দম্পতি আছে যারা সমপেশায় থেকেও সুন্দর বোঝাপড়ার মাধ্যমে সংসার করে চলছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সৈয়দ হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, তারিক আনাম খান-নিমা রহমান, আলী যাকের-সারা যাকের, নাঈম-শাবনাজ, ওমর সানী-মৌসুমী, বিপাশা হায়াত-তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান-মৌ, রিয়াজ-তিনাসহ আরও অনেকের নাম চলে আসে। তারা প্রত্যেকেই ভদ্র তারকা দম্পতির চমৎকার উদাহরণ।

অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের ঘাটতি থেকেই সংসার ভাঙে। একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না থেকেও সংসার ভাঙনের সম্মুখীন হয়। সংসারে ভালোবাসা না থাকলে সংসার ভাঙবেই। কারও ব্যক্তিগত জীবন যদি সুখের না হয় তাহলে শতচেষ্টা করেও সংসারের ভাঙন ঠেকানো যাবে না।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এ এইচ মোহাম্মদ ফিরোজের কথা হলো, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, হিংসা এবং অহংকারবোধের কারণে তারকাদের সংসার ভাঙে। তারকাদের মধ্যে স্বামী চান স্ত্রীর থেকে তার ক্যারিয়ার মজবুত হোক। আবার স্ত্রীর আকাঙ্ক্ষাও একই রকম। ফলে তাদের সংসার বেশি দিন টিকে না। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চান না। এমনকি সন্তানের কথাও চিন্তা করেন না। অতিরিক্ত ক্যারিয়ার সচেতনতাই তাদের সংসার ভাঙার কারণ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারিবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের পরিচালক ও সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘অন্যান্য দেশেও তারকাদের বিয়ে আর বিচ্ছেদ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। তারকাদের বিবাহবিচ্ছেদে নেতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়ে। বাংলাদেশ এখনো পারিবারিক আবহের বাইরে নয়। যখন সমস্যাগুলো তৈরি হয়, তখন পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে মিটিয়ে  ফেলা যায়। তাহলে কিন্তু ঘটনা এত দূর পর্যন্ত যায় না।’

সন্তান জন্মের পর বিচ্ছেদ সেই সন্তানের মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিচ্ছেদের ফলে এসব সন্তান মা-বাবা থেকে আলাদা হয়ে যায়। মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘আমাদের শিশুরা কিন্তু মা-বাবাকে আলাদা দেখে অভ্যস্ত নয়। যেসব দেশে দেখে অভ্যস্ত, সেসব দেশে শিশুদের দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ে নেয়। সেসব শিশু অনেক নিরাপত্তা পায়। আমাদের এখানে তো সে ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের বিবাহবিচ্ছেদ পরিবার ও পুরো সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’

মাহবুবা নাসরীন বিয়ের শুরুতে স্বামী-স্ত্রীকে সমঝোতার মানসিকতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন। বলেন, ‘সমঝোতার জায়গাটা প্রথমেই ঠিক করা উচিত। আরেকটা কথা, আমাদের অনেকেই বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবন তুলনা করি। এই তুলনাটাও কিন্তু অনেক সময় ঝামেলা বাড়িয়ে দেয়। সমস্যা হলে কাউন্সেলরের পরামর্শ যেন নেওয়া হয়। আগে পরিবার আর বন্ধুরা কাউন্সেলরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। এখন  তো মুঠোফোন ছাড়া কোনো বন্ধু নেই। এই মুঠোফোনের কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কারও কথা বলার সময় থাকে না। একাকিত্বের ব্যাপারটা অনেক বেশি কাজ করে। বিবাহবিচ্ছেদ ঠেকাতে দম্পতিদের কাউন্সেলিংয়ের অনেক সফলতা আছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তাজুল ইসলাম সাধারণ মানুষ যতটুকু মানিয়ে নিতে পারেন, তারকারা তা পারেন না উল্লেখ করে বলেন, ‘তারকারা বিয়ের বাইরে প্রেম করতে খুব ভালো পারে। বিয়ের পর একজন মানুষের মধ্যে দায়বদ্ধতা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, কম্প্রোমাইজ এসব  দেখা দেয়। কিন্তু অনেক তারকার মধ্যে এই ব্যাপারগুলোর ঘাটতি থাকে। বাস্তব জীবনে মানুষ যে অন্য রকম, এটা তাদের অনেকেরই উপলব্ধিতে থাকে না। বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই তাদের মুগ্ধতা ও মোহ ভেঙে যায়।’

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top