logo
news image

বার হাত বাঙ্গি তের হাত বিচি-র উৎস কী?

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীণ হলের এক ছোটভাই উত্তরের এক জেলার সরকারী বড় এক কর্মকর্তা। সে দায়িত্ব পালন করার সময় হঠাৎ একদিন আমাকে ফোন করে বসলো। আমি সে সময় একটি সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছিলাম। তাই ফোনটি কেটে দিয়েছি। ভাইব্রেশনে রাখা ফোন আবার বেজে উঠায় ভাবলাম বেশী জরুরী বলেই হয়তো সে পুনরায় কল দিচ্ছে। তাই সেমিনারের ডেলিগেটস্দেরকে ‘সরি ওয়ান মিনিট’ বলে ওর সাথে মৃদুস্বরে কথা বলে জানালাম ১০ মিনিট পরে ফোন করতে। কিন্তু সে জানালো তার এক মিনিটেই হবে। ভাই বলুনতো, আপনার এলাকায় যে সচিবের বাড়ি তিনি কোন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। তার বাড়িতে এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে আমাকে যেতে হবে। সে সুযোগে আপনাদের গ্রামের বাড়িতে ঢুঁ মেরে আসতে চাই। আপনার গ্রামের নামটা বলুন ভাই। ওর তাড়া দেখে বুঝলাম সরকারী বড় কর্তা কোথাও গেলে ঐ এলাকায় কর্মরত অধ:স্তনদের প্রটোকল দেবার ব্যাপার থাকে।
সেমিনারে ব্যস্ত থাকায় আমি একটু বিব্রত হলাম। আমদের এলাকা থেকে তখন কেউ সচিব পদে ঢাকায় কর্মরত আছেন তা মনে করতে না পারায় একটু পরে জানাবো বলে ফোনটা আবার কেটে দিলাম। পরে জেনেছি এলাকার একজন ঢাকায় একটি অফিসে কারো ব্যক্তিগত ‘সেক্রেটারী’ হিসেবে অস্থায়ী কাজ করেন। তিনি এলাকায় নিজেকে সচিব হিসেবে পরিচিতি দিয়েছেন। তাঁর বাড়িতেই অনুষ্ঠান। পরে তাকে জানিয়েছিলাম, সেই সচিব তোমার মত কোন বিসিএস পাশ করা সরকারী কর্মকর্তা নয়। এটা শুনে সে মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ।
পরে সে জানিয়েছিল, আরো একদিন কোন এক ইউনিয়ন পরিষদের সেক্রেটারী ‘সচিব’ পরিচয় দিয়ে ফোন করায় সে হঠাৎ কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে আরো জানালো- আমাদের দেশে রাতারাতি একটি বেসরকারী কলেজ বানিয়ে নিজে নিজে প্রভাষক বা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে যেমন ‘প্রফেসর’ হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়, তেমনি কোন  মহল্লার চোর তাড়ানো কমিটি, পাড়ার ক্লাব কমিটির সেক্রেটারীকে বা কোন মেসের বাসিন্দাদের বাজার খরচের হিসেব রাখার জন্য ম্যানেজারেরও একজন সেক্রেটারী বা ‘সচিব’ থাকেন। তাইতো ‘সচিব’ শব্দটি নিয়ে অনেক সময় বিব্রত হতে হয়। এই ঝামেলা এড়াতে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে মেয়র, সরকারী অফিসের বড় বসকে ‘আধিকারিক’ বলা হয়। অন্যদিকে ‘অধিকারী’ শব্দটি অনেকের পারিবারিক পদবী হওয়ায় আমাদের দেশে সেটা অফিসিয়ালী শুনতে কেমন যেন খটকা লাগে। তাই ঢালাওভাবে না ভেবে সচিবালয়ের সচিবগণের জন্য এই পদটির একটি নতুন নামকরণ হওয়া উচিত বলে সে মনে করে।
আজকাল সবাই যেমন গ্রেড-ওয়ান প্রফেসর হতে পারেন না তেমনি সবাই সিনিয়র সচিব বা সচিবও হতে পারেন না। কারণ, চাকুরীর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া, পদখালি না থাকা, ডিগ্রী ও প্রশিক্ষণ লাভের সীমাবদ্ধতায় যোগ্যতার শর্ত পূরণ না হওয়া সহ অনেকের নানা জটিলতা তৈরী হয়। তার ওপর আমাদের সমাজে অনেক মানুষ এসব পদের নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে তৎপর থাকে।
তাইতো সেদিন দুদকের গোয়েন্দা পরিচয়ে সুবিধা আদায় করতে গিয়ে একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। গেল ঈদের সময় র‌্যাবের মেজর পরিচয় দিয়ে গ্রামের গরুরহাটে প্রতারণা করেছে। সবশেষ সরকারী অফিসের একজন ড্রাইভার সুযোগ বুঝে নিজেকে সচিব পরিচয় দিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে ধনকুবের হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি-র ড্রাইভার মালেককে ‘ছায়া ডিজি’ বলা হতো। কারণ তিনি নিয়োগ-বানিজ্যের আশিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা গেছে। মালেকের আর্থিক ক্ষমতা তৈরী হবার আগে কোন সামাজিক মর্যাদা লাভের তাড়না ছিল না। যখন তার বাড়ি-গাড়ি ও ইউনিয়নের নেতৃত্ব কুক্ষিগত হয়ে যায় তখন তিনি সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য বেপরোয় হয়ে ওঠেন বলে সংবাদে জানা গেছে। আমাদের সমাজে টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে ফেলা যায়, পেশীশক্তি ব্যবহার করে সব ক্ষমতা অর্জন করা যায়, এটা তিনি আমাদের ভঙ্গুর সাম্জিক ও অনৈতিক রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে দেখে উপলব্ধি করেছেন। গত বছর কুমিল্লার এক আদালতের কর্মচারী গ্রেপ্তার হলে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন- ”বস কত ঘুষ খায়, আমি সামান্য খেলে তাতে দোষের কী দেখলেন?”
অর্থাৎ, ছোটরা বড়দের দেখে শিখে। বড়রা খারাপ বা অনৈতিক আচরণ করলে ছোটরা কার কছে ভাল হবার শিক্ষা লাভ করবে? তাঁদের এহেন আচরণ ছোটদের এবং অধ:স্তনদের কাছে একটা বড় ঘৃণাসূচক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছুঁড়ে দিতে সক্ষম!
আমার দেখা আড়াই বছরের এক বাচ্চা একদিন তার রং পেন্সিলটি নিয়ে জানালার ধারে গিয়ে সিগারেট খাবার মত করে ছাই ঝাড়ছিল। আমি বলেছিলাম, তুমি ওটা কি করছো বাবু? অতটুকু ছেলে আমার প্রশ্নের কারণটা বুঝতে পেরেছিল। সে লজ্জায় পেন্সিলটি লুকিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। তখন বুঝেছিলাম, ওর বাবা সিগারেট খান ও মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে ছাই ঝাড়েন। সেটা সে তার বাবার কাছ থেকে দেখে দেখে আয়ত্ব করে ফেলেছে এবং পেন্সিল দিয়ে প্র্যাকটিস করছে- তাও অন্য মানুষের সামনে। একই বলে পারিবারিক কু-শিক্ষা। এছাড়া সামাজিক কু-শিক্ষাও আমাদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
ড্রাইভার বাদল যখন দেখেছেন, সীমিত আয়ের পর তার আশেপাশের সবাই অবৈধ আয় করে কত্ত বৈভবপূর্ণ বিলাসী জীবন-যাপন করে চলেছে, তার সেই উপায় তৈরী করতে দোষ কী? তার নৈতিকতা শিথীল হতে হতে একদিন ভয়ংকর পশুত্বে রূপ নিয়েছে। দশতলা, সাততলা একাধিক বাড়ি আছে এবং নিজে ড্রাইভার হয়ে অবৈধভাবে একাধিক গাড়ি কিনে তার বেতনের চেয়ে তিনগুণ বেশী বেতনে ব্যক্তিগত ড্রাইভার, ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র, বডিগার্ড ইত্যাদি রেখেছেন তিনি। ঢাকার একটি মৌজায় যিনি সাতটি প্লট কেনার ক্ষমতা রাখেন তার কতবড় আর্থিক যোগ্যতা তৈরী হয়েছে তা হয়তো আরো পরে জানা যাবে। এ ধরণের মানুষেরা যদি নির্বাচনে কোন দলের নমিনেশন পেয়ে হঠাৎ ক্ষমতাধর হয়ে যান সেটাও বিচিত্র কিছু নয়।
যদিও সমাজে কিছু ভাল মানুষ এখনও আছেন। তাই সবাইকে এক পাল্লায় মাপা যাবে না, তবে এরকম অনেক খারাপ উদাহরণ আছে আমাদের দেশে। সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা হরণ করার পাশাপাশি বয়স কিছুটা বেড়ে গেলে অথবা অসুস্থ হয়ে মনের দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়লে এ ধরনের অনেক মানুষের মধ্যে তৈরৗ হয় ভূয়া আধ্যাত্মিক চেতনা। যথার্থ ধর্মীয় জ্ঞান না থাকায় তারা বহুলাংশে ধর্মীয় প্রতারকদের সংগে যোগ দেন। অথবা নিজে শিরক, বেদাত যা মনে হয় তাই চর্চ্চা করা শুরু করেন। জানা গেছে, ড্রাইভার বাদল তার পিতার কবরকে সুফীর মাজার হিসেবে প্রচার করেছেন।
পুলিশের সোর্সদেরকে একই কাজ করতে শোনা যায়। তারা নিরীহ মানুষকে ফাঁদে ফেলে নির্যাতন করে অর্থ আদায় করতে পারঙ্গম। ক্লিনিকে এইট পাশকরা আয়া ও এইচএসসি পাশ নার্স-ব্রাদার-এর জটিল অপারেশন করতে গিয়ে রোগী মেরে ফেলে মামলায় গ্রেপ্তার হবার বিষয়টিও একসময় সংবাদে জানা গেছে।
কথা হলো- এসব ড্রাইভার, সোর্স, আয়া, পিওনরা একদিনে, একা একা কোন অন্যায় করতে অভ্যস্ত হন না। তাদের পিছনে ইন্ধনদাতা থাকে। তা না হলে এসব নিম্নপদের কর্মচারীদের অবৈধ ব্যক্তিগত অস্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। উপরের সহায়তা ছাড়া তারা কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন না। আসলে তারা সবসময় একটি চেইন ধরে এসব কাজ করে থাকেন। সবক্ষেত্রে ভাগবাটোয়ারা করার বিষয়টি মূখ্য। ভাগের মা শুধু গঙ্গা পায় না-আর সবাই পায়। তাই সবাই চুপ করে থাকে। গঙ্গা নিজেই বয়ে যায়, নির্বাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে নদীতীরের মানুষের দুর্গতির সাথে সাথে চারদিকে মানুষরূপী বেপরোয়া পশুদের নৈতিকতার ভাঙ্গন দেখে। বিচারহীনতায় এবং নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে উপরওয়ালাকে  স্বাক্ষী করে বিচার দেয়।
সুশাসনের অভাবে নীতির মধ্যে দুর্নীতির বটবৃক্ষ ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়। কুশাসনের তোড়ে কালোটাকার স্রোত সমাজকে ভঙ্গুর করে, সামাজিক বৈষম্যকে প্রকট করে। নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে চারদিকে অবৈধ সুবিধাভোগীরা চুপ করে থাকে। কোথাও কোন অভিযোগ পেলে সবাই সেটাকে নির্মূল করার জন্য লোকদেখানো তোলপাড় শুরু করে দেয়। কিন্তু নিজের লাভের বখরা বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে যে কোন সমস্যা সৃষ্টির আগেভাগে সেগুলোকে প্রতিরোধ করার জন্য আগ্রহ দেখায় না। ফলে একসময়ে প্রতিরোধযোগ্য সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পেয়ে ভয়ংকর জটিলতা তৈরী করে এতবড় সামাজিক ক্ষতি সৃষ্টি করে যে সেখান থেকে সহজে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না।
এভাবে প্রায় সব জায়গায় ‘বার হাত বাঙ্গির মধ্যে তের হাত বিঁচি’ তৈরী হবার সকল আয়োজন আমরা সৃষ্টি করে ফেলেছি। তারা অন্যায়-দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সহায়তা করে যাচ্ছে। উন্নত দেশের মত আমাদের সরকারী অফিসের বসদেরকে কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। অন্যকে অর্ডার করে সময় নষ্ট না করে অফিসের গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিজেকেই করতে হবে। যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে নিজেই কম্পিউটার ব্যবহার করে জরুরী কাজ সম্পন্ন করার মানসিকতা থাকতে হবে। গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে অফিসে যাতায়তের ক্ষমতা ও যোগ্যতা থাকতে হবে। এছাড়া মেট্রো রেল চালু হলে রাজধানীতে সরকারী ছোট গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিন্তা না করে উল্টো কেন গাড়িভাতা, চালকভাতা ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এটার নাম প্রাচীন আমলাতন্ত্র, আধুনিক প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় এই ধারণা একবারেই অচল।
সরকারী অফিসের কর্মচারী, ড্রাইভার-পিওন যদি এত বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর হয়ে থাকেন তাদের এত ছোট চাকুরী করার দরকার কী? এদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত অব্যাহতি দিয়ে সে জায়গায় দরিদ্র, সৎ প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে। কেননা, বাঙ্গির চেয়ে বিচি বড় হলে সেটা তো পাকার আগেই খাবার অযোগ্য হয়ে পড়বে। অসময়ে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ নষ্ট করবে। তাই এদের দিয়ে সার্বিক পরিবেশ নষ্ট হবার আগেভাগেই সতর্কতা অবলম্বন করাটাই শ্রেয়।  

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top