logo
news image

অনলাইনে জালিয়াতি ও ভূয়াসীমে জুয়া

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
সেদিন আমাজন জঙ্গলের আদিবাসীদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমিত না হওয়ার চমকপ্রদ কাহিনী খুঁজছিলাম ইউটিউবে। একটি চ্যানেলে পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত এই বনের ওপর কিছু তথ্য বিবরণী তুলে ধরা হয়েছে। আমাজনের আয়তন ২.১ বর্গ কি.মি.! শুনেই খটকা লাগলো আমার। আবার শোনার চেষ্টা করলাম। মনে হলো তথ্যটি সঠিক নয়। তাই আবারো কয়েকটি ভিন্ন উৎস যাচাই করে নিশ্চিত হলাম এই রেইনফরেষ্টের মোট আয়তন হচ্ছে ৫.৫ মিলিয়ন বর্গ কিমি.। ভাষ্যকার তার কথায় ভুল বলেই গেলেন এবং হয়তো এখনো বলে যাচ্ছেন। তার এই বক্ত্যব্যের ওপর অনেকে সংশোধনী দিয়ে মতামত দিলেও এই মারাত্মক ভুলসহ অনেক ভুলতথ্য বহাল তবিয়তে থেকে গিয়ে মানুষকে ভুল শিখিয়েই চলেছে।
গেল রমজান মাসে ইউটিউবে বাচ্চাদের আজান প্রতিযোগিতা শুনেছিলাম। সেখানে সেমি-মঙ্গোলীয় চেহারার ইন্দোনেশীয় এক স্কুলগামী বাচ্চার সুমধুর কন্ঠে আজান শুনে বিমোহিত হয়েছিলাম। তার পরনে স্কুল ড্রেস ছিল এবং সে শ্রেণিকক্ষে কাঠের বেঞ্চের পাশে সহপাঠিদের সামনে দাঁড়িয়ে আজান শোনাচ্ছিল। হয়তো কেউ একজন মোবাইল সেটে রেকর্ড করে সেটাকে নেটে ছড়িয়ে দিয়েছে। আজান শুনতে আমার বেশ ভাল লাগে। তাই সময় পেলে মাঝে মাঝে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের বিচিত্র কন্ঠের বৈচিত্র্যময় আজান শোনার চেষ্টা করে থাকি। সপ্তাহখানেক পূর্বে ইউটিউবে ‘চীনা বাচ্চার সুমধুর আজান’ নামে একটি পোষ্ট দিলে আমার নজরে আসে। একজন মহিলা সেই ইন্দোনেশীয় বাচ্চার সুমধুর কন্ঠের আজানটিকে রিমিক্স করে বিকৃত করে ছবিটিতে রং মেখে চীনা বাচ্চার আজান বলে নতুন করে পোষ্ট দিয়েছেন। তার লজ্জা, ধিক্কার, ঘৃণা, ভয় কোনটাই নেই? দর্শকগণ এর বিরুদ্ধে খারাপ মন্তব্য করতে ছাড়েননি। সামান্য কটি লাইক বাড়িয়ে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্যে পরিবেশনের মাধ্যমে বেশী আয় করার ধান্ধাবাজি করে তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন।
মাত্র দু’টি উদাহরণ তুলে ধরলাম। কিন্তু এভাবে প্রতিদিন কতশত, কতহাজার ফেক নিউজ, ফেক গান, ফেক মাছধরা, অখাদ্য রান্না-বান্না, ভুল বাংলা উচ্চারণ, ফেক চিকিৎসার নামে আধুনিক ডাক্তারী-কবিরাজী, যৌন উত্তেজক মাদক বিক্রি, ভুল পরামর্শ হয়তো আপনাদের অনেকের নজরে এসেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, গালাগালি করা, কাদা ছোড়াছুড়ি করা, জোর করে অথবা মিথ্যে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গোপন ছবি ধারণ করে ছড়িয়ে দিয়ে চরিত্র হনন করা, মুক্তিপণ আদায় করা ইত্যাদি যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অস্ট্রিয়া থেকে সেফুদা নামের এটি চ্যানেলে বাংলাভাষায় দেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা, চিত্র তারকা, খেলোয়াড়-এর নামে যেসব অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হচ্ছে তা আমাদেরকে মানুষ নামের কলঙ্ক বানাতে আর বেশী দেরী করবে না বলে মনে হয়। সভ্যমানুষ এসব অন্যায়-অসভ্যতাকে কীভাবে সহ্য করে যাচ্ছেন সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের কর্তৃপক্ষের অনেকে হয়তো বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন অথবা চোখ বুঁজে সহ্য করে যাচ্ছেন।
ইউটিউব এখন মানুষের মহান শিক্ষক। কারণ ইউটিউবে অনেক ভাল বিষয় রয়েছে। তবে অনেকের পোষ্টকৃত তথ্যে ভুল, বিকৃতি এবং মিথ্যাচারের বেহায়াপনা দিন দিন এই প্লাটফরমটিকে নষ্ট করে পঁচিয়ে ফেলেছে। অনেকে ভুল শিক্ষা, ভুল চিকিৎসা, ভূয়া বিনিয়োগ করে ধরা খেয়ে ভুক্তভোগী হয়ে লজ্জা পেয়ে চুপ মেরে গেছেন।
করোনা সময়ে মানুষ ঘরে থেকে শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে এখন অলস-কুঁড়ে হয়ে গেছে। ভার্চুয়াল জগতের বিচরণ মানুষকে আরো বেশী মোহগ্রস্থ করে ফেলেছে। ঘরে বসে কিছু একটা করার মাধ্যমে দু’পয়সা আয় করার নেশা এখন বড় পেশায় পরিণত হয়েছে।
এই পেশায় অনেকের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কিছুই নেই। ধৈর্য্য নিয়ে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ক্রিয়েটিভ কিছু করে মানুষের উপকার করা হবে সে ধরনের কোন নীতি-দর্শন নেই। বরং অতি অল্প সময়ে প্রতারণা ও ধাপ্পাবাজি করে কীভাবে নিজের আখের গোছানো যেতে পারে সে ব্যাপারে হীন প্রচেষ্টা চালানোর কৌশলগুলো যেন মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনলাইনে ধোঁকাবাজি, জালিয়াতি ও অবৈধ জুয়ার আসর বসিয়ে মানুষের ধন-সম্পদ লুটে নেবার আয়োজন চলছে চারদিকে।
অনলাইন জুয়া সাধারণ ক্যসিনোর ভার্চুয়াল সংযোজন। এর মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করতে একটি ফোন নম্বর প্রয়োজন হয়। এরপর সেই ফোন নম্বর দিয়ে একাউন্ট তৈরী করা হয়। সেই একাউন্ট থেকে বিকাশের মাধ্যমে ভার্চুয়াল কয়েন বা বিট কয়েন কেনা হয়। জুয়াড়ীর তথ্য গোপন রাখার শর্তে তাদেরকে ভূয়া ফোনসিম সরবরাহ করা হয়। এই নতুন ভূয়া সিম ব্যবহার করে বিভিন্ন বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে ভার্চুয়াল কয়েন বা বিট কয়েন কেনাবেচা চলে। জুয়াড়ী নিজের টাকা ফুরিয়ে ফেললে স্বর্ণলঙ্কার, আসবাব, জমি, বাড়ি সবকিছু বন্দক রেখে ভার্চুয়াল কয়েন কিনে তাৎক্ষণিকভাবে জুয়া খেলা চালিয়ে যেতে পারেন। কোন কোন দেশে এসব জুয়াড়ী টাকার অভাবে খেলার নেশায় মত্ত হয়ে দামী গাড়ি, নিজের বান্ধবী অথবা স্ত্রীকে বন্দক রেখে জুয়া খেলে স্বর্বশান্ত হয়েছেন! এজন্য পরবর্তীতে মাফিয়াদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত তৈরী  তে দেখা গেছে। পাচিংকো নামক লাইভ জুয়ায় এসব ঘটনা হরদম ঘটতে শোনা যায়।
আমাদের দেশে প্রবাদ আছে ‘জুয়া খেললে ধূয়া হয়’- অর্থাৎ টাকা-পয়সা, সম্পদ সবকিছু হারিয়ে জুয়াড়ী একসময় পথে বসে যায়। জুয়াড়ীরা নেশাখোরও হয়ে থাকে। লোভের নেশায় লাভের নেশায় পুঁজি শেষ হয়ে যায় ওদের। এভাবে বিত্তশালী জুয়াড়ীরা পথের ভিখারী হয়ে পড়ে। এটাই জুয়া খেলার পরিণতি ও জুয়াড়ীদের সবিশেষ নিয়তি।
ক্যাসিনোকান্ডে ভাটা পরার পর থেকে করোনাকান্ড পৃথিবীর জুয়াবাজদেরকে অনলাইনের দিকে টেনেছে। আমাদের দেশের অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সিলেট সীমান্তের ওপারে ট্যুরিষ্ট শহর শিলং ও টাটানগর থেকে। যেখানে অনেক বিদেশী পর্যটক আসেন ও দেশী শ্রমিক কাজ করেন। তাদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বহুকাল ধরে এই পেশা ও নেশা চালু থাকলেও করোনা সময়ে এটা আমাদের দেশে অনলাইনে ব্যপ্তি লাভ করেছে।
এর মাধ্যমে আধুনিক অপরাধ যেমন গ্যাংবাজি ও মাদক ব্যবসা নবরূপে নবসাজে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে- টেকনাফ সীমান্তে কড়াকড়ির ফলে ইয়াবা ঢুকতে না পেরে গভীর সমুদ্র দিয়ে চালান আসছে। সেপ্টেম্বর ২০ তারিখে গভীর সমুদ্রের ট্রলারে ৭০ লক্ষ ইয়াবার চালান ধরা পড়েছে। এছাড়া ক’মাস ধরে আমাদের দেশের ছোট-বড় সব শহরে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ছুরিকাঘাত করে পথচারীর স্বর্বস্ব লুন্ঠন ও হত্যার মত অপরাধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিষয়গুলো খুবই উদ্বেগজনক।
ভুলে ভরা অনলাইনের তথ্য আমাদের জীবনটাকে ভুলুন্ঠিত করছে। বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অনলাইনের ভুল তথ্য শিখে নিজেদেরকে অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করে চলেছে। অনলাইনের সবধরনের তথ্যভান্ডার ও এ্যপসগুলোতে যথার্থ, সঠিক তথ্য সন্নিবেশিত করার উপর এক্ষুনি কড়া নজর দিতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে। অনলাইনে ভূয়া, মিথ্যা তথ্য পরিবেশনকারীদের চিহ্নিত করার জন্য জন্য সাইবার ক্রাইম ক্ষেত্রে কর্মরতদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অথবা নতুন দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে একাজের সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
এছাড়া ভূয়া, মিথ্যা তথ্য পরিবেশন থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মোটিভেশনাল কর্মসূচি শুরু করা উচিত। তা না হলে কোমলমতি নবীন প্রজন্ম ডিজিটাল পদ্ধতির গতির মত নকলজ্ঞানে, ভূয়া তথ্যে প্রভাবিত হয়ে ভাগাড়ের আবর্জনা হাতড়িয়ে প্রতারিত হবে। এই অবস্থা বেশীদিন চলতে দিলে আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা দ্রুত অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে। কোন কোন ওয়েবসাইটের তথ্য যথার্থ এবং পড়াশুনা ও গবেষণার জন্য নির্ভরযোগ্য এ ব্যাপারে পৃথিবীর অনেক দেশে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। আমাদের দেশে ইন্টারনেটের তথ্যভান্ডার ব্যবহারকারীদের জন্য এবিষয়ে একটা গাইডলাইন থাকলে তা তাঁদের জন্য অনেক সহায়ক হবে।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top