logo
news image

কারো চার-পাঁচটি কারো একটিও নেই

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
পাট ধুচ্ছে পঞ্চগড়ের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা অর্জনের প্রচেষ্টা ওদের। করোনা সময়ে বসে না থেকে পড়াশুনার বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য পরিবারের ওপর চাপ না দিয়ে কিছু বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছে কেউ কেউ। করোনা সবার মত ওদের পড়াশুনার নিয়মটা এলোমেলো করে দিয়েছে। কারণ, এখন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় না। কিন্তু অনলাইনে শিক্ষকগণের ক্লাশে যোগ দেয়ার জন্য স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটার কিনতে হয়, মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহারের জন্য মেগাবাইট কিনতে হয়। স্কুলের বাচ্চাদের এখন ফ্রি খাবারও জোটে না। তাই ওদের অভিভাবক ও পরিবারের ওপর বহুমুখী চাপ।
উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটের বেঙ্গল ডুয়ার্স রেললাইনের পার্শের গ্রামগুলো যেমন তিস্তা-ধরলার পানিতে ভেসে তছনছ গেছে, তেমনি মধ্যাঞ্চলের সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থেকে পূর্বের সুনামগঞ্জ, দক্ষিনাঞ্চলের ভোলা, বরগুনার আমতলী পর্যন্ত পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে বার বার তলিয়ে যাচ্ছে। এ যেন এক বিভীষিকাময় অবস্থা। করোনা, বন্যা, জলোচ্ছাস সবকিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ ভীষণ নাজেহাল। ফসল, গবাদিপশু, ব্যবসা হারিয়ে কর্মহীন মানুষের ত্রাহি অবস্থা কিছুতেই দূর হচ্ছে না।
প্রায় ছয় মাস গত হলো করোনার প্রকোপ এই বাড়ছে এই কমছে বলে বেঁচে থাকার তাগিদে সবকিছু শিথীল করে মানুষ পথে নেমেছে। কাঁচের ঘরে বসে কেউ ঘোষণা দিচ্ছেন বিপদের, কেউ ঘোষণা দিচ্ছেন আশ্বাসের, কেউবা হতাশার। সাধারণ মানুষ কোনটাই শতভাগ বিশ্বাস করতে না পেরে হতাশা ও আস্থাহীনতার মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য নিজ নিজ উপায়ে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সবকিছুই একটা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। করেণ ওদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এখন নেটওয়ার্কভিত্তিক। ওরা এবং ওদের শিক্ষকগণ সবাই নেটে, সবাই ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে মিশে গিয়ে কর্মঘন্টা ভুলে জ্ঞানচর্চ্চায় ও জ্ঞান বিতরণে রত। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় চরমভাবে বাঁধ সেধেছে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের বিষয়গুলো। শিক্ষার্থীরা করোনাকালে কেউ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অট্টালিকার ঠান্ডা ঘরে নিয়নের আলোয় উচ্চ গতির ফাইবার অপটিক্সের অথবা ওয়াই-ফাই সম্বলিত অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস হাতে ভার্চুয়াল ক্লাসে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। কারো হাতে চার-পাঁচটি আধুনিক ডিভাইস, কারো একটিও নেই। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিভাইস ধার দেয়ার বা এজন্য বিনা সুদে লোন দেয়ার কথা বলা হলেও সেই আশায় থেকে থেকে অনেকের মধ্যে হতাশা দানা বেধেছে। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যবস্থা করা হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীতা দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে খুবই নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এই মুহূর্তে এটা চরম শিক্ষা-বৈষম্য সৃষ্টি করে তুলেছে। কেউবা পুকুর পাড়ে, নদীর তীরে, সাগর কূলে, বিদ্যুৎহীন, ইন্টারনেট সংযোগহীন প্রত্যন্ত এলাকায় বসে অন্ধকারে কোনা-ঘুপচিতে হতাশায় বার বার অসহায় অবিভাবকের কাছে নিস্ফল আব্দার করে যাচ্ছে- তাহলে কি আমি ফেল করবো? আমার কি লেখাপড়া হবে না?
বাধ্য হয়ে কোন অভিভাবকবে হালের গবাদি পশু বিক্রি করে দিয়ে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দিতে হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসছে। কিন্তু ডিভাইস কেনাটাই তো শেষ কথা নয়। ওটা চালু রাখার খোরাক দিতে হবে তো! বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। ওকে চার্জ দিতে বাজারে যেতে হয়। বার বার চার্জ দেয়া ও মোবাইল নেটওয়ার্ক কিনতে অর্থের দরকার। এতগুলো কোর্সের ক্লাস, এত লম্বা সময় অনলাইনে বসে থাকা যায় না। তার ওপর কিছুক্ষণ পর পর বাফারিং ও গতিহীনতায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়ির পার্শ্বের মাঠে গিয়েও কথা শোনা যায় না। পাওয়ার পয়েন্টের লেকচারগুলো তো লোডই হয় না। ধুত্তরি ছাই বলে অনেকের আক্ষেপ। অনেকে লজ্জায় সেকথা প্রকাশ করতেও চায় না। ওদের বন্ধুদের মুখে শোনা গেল-যখন কোন প্রশ্নেত্তোর পর্বে কোন সাড়া মেলে না তখন।
কেউ শুরু করলেও শেষ অবধি ভার্চুয়ালি ক্লাসে থকাতে পারে না-মূলত: লো স্পীড ও খরচ বেশী হবার ভয়ে। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে যদি চলতো তবুও ভাল। কিন্তু ক্যাপাসিটি না বাড়ালে এ ধরনের স্পিড ড্রপ স্মার্ট ডিভাইস অপব্যবহার করে শিক্ষার্থীদেরকে চালাকির মাধ্যমে বড্ড আউটস্মার্ট করে তুলবে।
এদিকে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সাথে কার্যকর বা কোন ধরনের চুক্তি না থাকায় শিক্ষকগণ নিরবিচ্ছিন্নভাবে সংযোগ না পেয়ে ভালভাবে ক্লাশ নিতে পারছেন না। এছাড়া ফ্রি ই-সেবাদানকারী ক্লাউডস্ এ্যাপস্ প্রোভাইডারা তাদের এ্যাপস্ ব্যবহারের জন্য কিছুক্ষণ পর পর ডলারে বিল দাবী করে জানালা বন্ধ করে দেয়ার নজির তৈরী হয়েছে। চল্লিশ মিনিটের আগেই সংযোগ কেটে দেয় বলে অভিযোগ  এসেছে। যেটা এই করোনাকালীণ সময়ে খুবই ন্যক্কারজনক। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংশয়ের ব্যাপার থাকায় অনেক শিক্ষক পড়া বুঝাতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছেন এবং খোলা মনে ভাল বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এটা মুক্তচিন্তা ও আধুনিক শিক্ষাকে সংকুচিত করছে বলে অনেক অভিযোগ এসেছে। অনেক একাডেমিক সভায় এসব বিষয় নিষ্পত্তির জন্য দাবী করা হলেও কর্তৃপক্ষ এগুলো আমলে না নেয়ায় অনলাইন পড়াশুনা একটা দায়সারা বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে।
দেশে বাজার ভর্তি বিলাস দ্রব্য, যার ভোক্তা বিত্তশালীরা। আয়-ব্যয়ের বৈষম্য চরম হওয়ায ভার্চুয়াল শিক্ষা ব্যবস্থা একটা বিশেষ শ্রেণির জন্য সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার আধুনিক শিক্ষাসামগ্রীতে ভরপুর। উচ্চমূল্য দিয়ে এসব ডিভাইস অনেকের কেনার সামর্থ্য নেই। বিত্তবান পরিবারের শিক্ষার্থীরা বায়না ধরার আগেই নতুন নতুন ডিভাইস কিনে নিয়ে ক্লাসে অংশ নিতে পারলেও দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা সেকথা ভাবতেই পারছে না। ফ্রি সেবা না পেলে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে।
বাঁচার তাগিদে মানুষ ঘরের বাইরে বের হলেও করোনা নিয়ে হার্ড ইমিউনিটি তৈরী ব্যাপারটা খুব নিকটের বিষয় নয় এবং অতি সহজ নয়। আমাদের মত অসম পেশা, নৃ-গোষ্ঠী ও জনবিন্যাসের দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরীর জন্য প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে আরো বেশী শ্রেণি-বিভাজন তৈরী করবে। এই প্রচেষ্টায় যারা মাঠে-ঘাটে নিত্যদিনের জীবিকা সংগ্রহে সংগ্রাম করছেন তারাই আক্রান্ত হয়ে নির্মূল হতে পারে। কারণ, ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র মূল কথা হলো, ঘরের বাইরে যাও কাজে মিশে যাও, বাঁচার চেষ্টা কর। তারপর ’মইরা-টইরা যা থাকে’। ইংরেজি ‘হার্ড’ কথাটির মাধ্যমে ‘পশুর পাল’ বা দলভূক্ত প্রাণি বুঝায়। একই নৃ-গোষ্ঠীর বা গোত্রের প্রাণিদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ তৈরী করা অর্থে এটা বেশী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অপরদিকে, আমাদের দেশ থেকে করোনা এমনি এমনি চলে যাবে এমন কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেসব দেশ এমনটি ভেবে অগ্রসর হচ্ছিল তাদের তৃতীয় সংক্রমণ শুরু হওয়ায় বিপদ বেড়ে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়া পুনরায় স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। রাজস্থানে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি দেয়া হয়েছে। জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে গিয়ে ৭৬ হাজার শিশু কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছে।
আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়িয়ে ৩ অক্টোবর করা হয়েছে। এটা ভাল সতর্কতা। তবে পরিস্থিতির জন্য আবারও যদি ছুটি বাড়াতে হয়? সেজন্য এখন আমরা শিক্ষার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে যেসব খরচ করছি তা দিয়ে একটি পরিকল্পিত, টেকসই ও কার্যকর ভার্চুয়াল শিক্ষা অবকাঠমো তৈরীর কথা কেন ভাবা হচ্ছে না? করোনা যদি নির্মূল হয়েও যায়, তাহলে সেগুলো দিয়ে আমরা নির্বিঘ্নে বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত দু-একটি ব্যাচে ভার্চুয়াল সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি করে আগামীতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তিসংকট দূর করতে পারব বলে মনে হয়। এতে আমাদের অপচয় রোধ হবে এবং ভর্তি সংকট কেটে যাবে। অথচ এজন্য আমাদের দেশজ প্রচেষ্টায় শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারকদের কোন প্রচেষ্টা এপর্যন্ত কোথাও চোখে পড়ছে না। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি দেয়াটা জরুরী।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top