logo
news image

প্রথম ভেল্কি স্পুৎনিক পাঁচ নাকি অজানা?

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
এখনও প্রশ্নের শেষ নেই। সবার জবাব অসম্পূর্ণ। টিকা তৈরী নিয়ে তীব্র আন্তর্জাতিক দৌড়ের মধ্যে মাত্র দু’মাসেই যথার্থ নিরাপত্তা সুরক্ষা ছাড়াই কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধের টিকা চূড়ান্ত করে ফেলেছে রাশিয়া। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলাকালে ঘোষণা এসে গেছে শগিগীর ৫০ মিলিয়ন ডোজ বাজারজাত করার। বিদেশী অনুজীব বিজ্ঞানীদের অনুমোদন ছাড়াই টিকা আবিষ্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার আশা রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের।
প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের গবেষকগণ তেমন কিছু না বললেও সেখানকার অনেক রাজনৈতিক নেতা ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ এটাকে বাঁকা চোখে দেখছেন, কেউবা বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন। তবে যেটাই করা হোক না কেন, করোনা পীড়িত বিশ্বের মানুষের কাছে একটি কার্যকরী প্রতিষেধক দরকার। বিচলিত মানুষ মনে করছে- যেভাবে পারা যাক্, থামিয়ে দেয়া হোক করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের আগ্রাসন। আর যেন তর সইছে না কারোই। এজন্য ইতোমধ্যে বিশ্বের ২০টি দেশের প্রতিনিধিরা রাশিয়ার কাছে আগাম টিকা পাবার জন্য আবেদন করে ফেলেছে। এ পর্যন্ত ১০০ কোটি ডোজের আবেদন এসেছে। এ জন্য বিশ্বের পাঁচটি দেশে ৫০ কোটি  ডোজ টিকা তৈরীর প্রস্তুতি নিয়েছে রাশিয়া।
গত ১১ আগষ্ট রাশিয়ার ‘গ্যামেলিয়া রিসার্চ ইন্সটিউিট অব এপিডেমিওলজি এন্ড মাইক্রোবায়োলজি’ কোভিড-১৯ এর টিকা আবিষ্কার করেছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুকূল্যে এই গবেষণা কাজ  চলেছে। তৃতীয় ট্রায়ালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের মেয়ে অংশগ্রহণ করছেন। তার শরীরে টিকার ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে। অন্যান্যদের মত ইঞ্জেকশন নেয়ার পর তার শরীরের তাপমাত্রা বেড়েছিল, এখন সবকিছু স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে আছে।
রাশিয়ার ডাইরেক্ট ইনভেষ্টমেন্ট ফান্ডের প্রধান বলেছেন, এই গবেষণার একটা মজবুত ভিত রয়েছে। এই টিকাতে যে ভাইরাল পার্টিকেল ব্যবহার করা হয়েছে তা বিভাজিত হয়ে প্রতিলিপি তৈরীর ক্ষমতা রাখে না। বরং এই টিকার ডোজে শরীরের ‘বি’ কোষ সক্রিয় হয়ে শরীরে এন্টিবডি তৈরী করে। পাশাপাশি ‘টি’ কোষ সক্রিয় করে শরীরে শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম গড়ে তুলবে। তারা বলেছেন, এই টিকার একাধিক ট্রায়াল হয়েছে। এটা শতভাগ নিরাপদ। এই আবিষ্কৃত টিকা জার্মাানী, চীন ও যুক্তরাজ্যের টিকার চেয়ে নিরাপদ বলে দাবী তাদের। প্রথমদিকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি, স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষকদের মধ্যে এই টিকা ব্যবহার করবে।
সারা বিশ্বে বহুদিন ধরে একটি কার্যকরী টিকা আবিষ্কার করার জন্য প্রতিযোগিতা চলে আসছে। জানা গেছে এজন্য ১৫০ দেশে কাজ চলছে। আমাদের দেশেও টিকা তৈরীর প্রচেষ্টা চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিকট মোট ৬টি প্রতিষ্ঠান তাদের আবিষ্কিৃত টিকার জন্য নিবন্ধনের জন্য তালিকাভুক্তি করেছে। সেখানে তার মধ্যে তিনটি তৃতীয় ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে এবং বাকী তিনটির তৃতীয় ট্রায়াল চলছে। জানা গেছে রাশিয়ার তৈরী টিকা ১২ আগষ্ট পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য অপেক্ষা করছে। এর মধ্যেই রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে তাদের প্রতিক্ষীত প্রথম প্রতিষেধক স্পুৎনিক পাঁচ, একশতভাগ নিরাপদ এবং শীগগীর বাজারে আনা হবে। ইসরাইলি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইউলি এদেল ষ্টেইন বলেছেন, রাশিয়ার টিকার তৃতীয় মাত্রার পরীক্ষা তারা করতে আগ্রহী। ট্রায়ালের পর এটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য প্রমাণিত হলে টিকা কিনতে রাশিয়ার সংগে তারা আলোচনায় বসবে। তবে টিকা নিয়ে এত দৌড় ঝাঁপ দেখে মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রাজনীতি ও ব্যবসার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
রাশিয়ার মানুষ মনে করছে এটা একটা চমক। এটাকে তারা টিকা আবিষ্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার সাফল্য ভাবছে এবং ১৯৫৭ সালে প্রথম চন্দ্রাভিযানের মহাকাশযান স্পুৎনিক উৎক্ষেপণ সময়কার সোভিয়েত সাফল্য মনে করছে।
রাশিয়ার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ঘোষণায় বিস্মিত। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তাদের কাছে প্রথম হওয়া বড় কথা নয়- টিকার জন্য নিরাপত্তা ও কার্যকরীতার বিষয়টিকে তারা প্রাধান্য দেয়। মার্কিন স্বাস্থ্য ও হিউম্যান সার্ভিসেস মন্ত্রী প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন কে আগে করবে এটা কোন প্রতিযোগিতা নয়। আমাদের ৬টি ভ্যাকসিন দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। রুশ ভ্যাকসিন কেবল দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করলো। এমনকি তারা শুরুর ট্রায়ালগুলোর তথ্য প্রকাশ করেনি। আমাদের কাছ এর সঠিক তথ্য নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় রাশিয়ার টিকা নেই। তবে রাশিয়ায় থাকা বাংলাদেশী চিকিৎসক ও জানিয়েছেন, যে প্রক্রিয়ায় স্পুৎনিক পাঁচ তৈরী ও ট্রায়াল হয়ে এগিয়ে গেছে তাতে এ পর্যন্ত মনে হয়েছে এটা শতভাগ নিরাপদ। আমাদের দূতাবাস কাজ শুরু করেছে টিকা পাবার জন্য। বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার সুসস্পর্ক রয়েছে তাই আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই টিকা পেতে পারি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানা, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, চীনের সিনোভ্যাক এবং আরো অনেক কোম্পানি তাদের ভ্যাকনিন নিয়ে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়লে চলে গেছে তবে সেগুলো কবে বাজারে আসবে তার সময় জানা যায়নি। চীনের সিনোভ্যাক তাদের তৃতীয় ট্রায়লের জন্য বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী। সেজন্য তারা আইসিডিডিআর-বির মাধ্যমে আবেদন করেছে। অন্যদিকে তারা সৌদি আরবেও আবেদন করেছে। আমাদের দেশে চীনের টিকা নেয়া হবে কি না সে ব্যাপারে আগামী সপ্তাহে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কারণ অনেকে একাধিক সোর্স থেকে টিকা সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছেন।
করোনা সমস্যা সমাধানে অনেক আশার বাণী শুনতে শুনতে মানুষ হতাশ। আমরা সবাই জানি কারো হাতে এই মুহূর্তে কোন যাদুকরী সমাধান নেই। একটা ভাল সংবাদের জন্য আমরা সারাদিন চেয়ে থাকি টিভির পর্দার দিকে। সারা বিশ্বের মৃত্যুর খবরগুলো আমাদেরকে যাপরনাই ব্যথিত করে তোলে প্রতিদিন। এই সময়ে যাদের পরিবারে কেউ অথবা নিকটাত্মীয়রা আক্রান্ত তাদের কষ্টের শেষ নেই। অনেকের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
পৃথিবীর সকল মানুষ এভাবে একইসংগে এমন কঠিন মুছিবতের মধ্যে আগে কখনো মুখোমুখি হয়েছিল কি-না জানা নেই। তবে সৃষ্টির সেরা মানুষ বার বার মহাবিপদে পড়েও বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়েছে। জ্ঞানের এই সামর্থ্য মহান সৃষ্টিকর্তাই মানুষকে দিয়েছেন। টিকা আবিষ্কারে প্রথম স্থান যিনি লাভ করুন না কেন- দিকে দিকে করোনাকে জয় করার জন্য মানুষের বেঁচে থাকার যে নিরলস প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তা অচিরেই একটি সফল টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে কার্যকরী সমাধানের উপায় খুঁজে সুফল বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি।

 * প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top