logo
news image

আদার গাছ হলুদ হয়ে গেছে

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
প্রতিদিন ভারী ভারী কথা বলি, কঠিন ভাষায় লিখি, ফোনে বেশীক্ষণ কথা বলি না- ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা শুনতে হয় ইদানীং। বিশেষ করে করোনার সময়টাতে ঘরবন্দী জীবনে লেখা-পড়ার টেবিলে দীর্ঘসময় কাটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সেটাই সময় কাটানোর জন্যে হয়তো আমার জন্য বেশী ভাল ছিল।
এখন শুরু হয়েছে অনলাইন সেমিনার, ক্লাস, মিটিং ও আড্ডা নামক নানা ধরনের দেশী-বিদেশী মত বিনিময় সভা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সংসারের কাজ। বাসার কাজের লোক ঠিকমত আসে না। তারা তো আর ভার্চুয়াল কেনাকাটা ঠিকমত আয়ত্ব করতে পারে না। ফলে শপিং, কাঁচাবাজার-ঘাটও করতে হয়, বিল দিতে হয়, ফ্লেক্সি লোড, বিকাশ করা, আরো নানা কাজের বাহার এসে দৈনন্দিন সময়টাকে খুব ছোট করে দিয়েছে।
প্রতিটি বাসায় কেউ স্মার্ট ফোন, কেউ ল্যাপটপ, কেউ ডেস্কটপ, কেউ স্মার্ট টিভিতে ইউটিউব, কেউ ক্যাবল টিভিতে নিজের পছন্দনীয় অনুষ্ঠান বেছে নিয়ে সময় পার করছেন। এর মধ্যে রান্না, গোসল, ঘরগোছানো, নামাজ, ঘুম, ব্যায়াম, পেটস্ নার্সিং, গার্ডেনিং ইত্যাদিকেও নিজের দায়িত্ব অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়ে মানিয়ে ফেলে ঘরকন্নায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সবাই। যান্ত্রিক ডিভাইস দিয়ে সবার জীবন নির্দিষ্ট ছঁকে বেঁধে গেছে।
গোল বাধে, যখন এক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ চলে যায় তখন। এসি বন্ধ হলে বড়দের চেয়ে ছোটরাই অধৈর্য্য হয়ে যায়। সবাই নিজ নিজ ঘর থেকে চিৎকার দিয়ে উঠে। দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকলে আইপিএস-এর ব্যাটারীর চার্জ চলে যায়। শেষ সম্বল সিলিং ফ্যানও ক্যাচ ক্যাচ করে বন্ধ হয়ে যায়। তখন শুরু হয় বিপত্তি।
এমন এক সময় সবাই বিরক্তির সুরে বক বক, বিদ্যুৎ বিভাগকে অভিযোগ করে। তবে এমন মুহূর্তে বাসার সবাইকে একত্রে পাওয়া যায়। এই সময়টাকে ভালভাবে কাটানোর জন্যে অনেক বাড়িতে বয়স্কগণ নতুন পদ্ধতিতে নানা পরিকল্পনা এঁটেছেন। আমাদের যৌথ বাড়ির দাদু তো এরকম সময়ের জন্য সদা প্রস্তুত। তাঁর কাজ হলো, প্রথমেই সবাইকে জড়ো করে মিষ্টি কথা বলে শুকনো খাবার সাপ্লাই দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করা। চানাচুর, মুড়ি, চা, বিস্কুট, চিপস্, লজেন্স কী নেই তার ঘরে? সবকিছুই যেন আগেই আয়োজন করা আছে। আসলে বড়রা আজকাল বাড়ির সবাইকে কাছে পান না। তাদের মনের মধ্যে জমানো কথা অনেক বেশী মজুত থাকলেও সবার ব্যস্তার জন্য কারো সাথে সেগুলো শেয়ার করার উপায় নেই। করোনা পরিবারের সবাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেও যেন ডিভাইসে ইন্টারনেট নামক যাদু দিয়ে সবাইকে বেশী স্বার্থপর করে তুলেছে। তাই বিদ্যুৎ চলে যাবার সময়টা দীর্ঘ হলে দাদুর জন্য সেটা সুখের সময়।
ক’দিন ধরে চলছে শ্রাবণের একটানা রুম-ঝুম বৃষ্টির গান। হঠাৎ বাতাসে গাছের ডাল ভেঙ্গে বিদ্যুৎ তার ছিড়ে যাওয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আজ দাদুর ঘরে সবাই ভিড় জমিয়েছে। ঘরটিও বেশ বড়। ক্যারম, সাপলুডু, দাবা খেলার ব্যবস্থা আছে। গামলায় করে তেল, পিঁয়াজ, চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে আনতে বলা হলো। দেশী পিঁয়াজ ও খাঁটি সরিষার তেলের ঝাঁঝ খুব বেশী। বয়সে অতি ছোটরা তেমন খেতে পারে না। বড়রা মজা করে উপভোগ করে।
দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী আবাসিক কাজের বুয়া ময়নার মা এই আইটেমটি তৈরী করতে সিদ্ধহস্ত। সেদিনও মজা করে ঝালমুড়ি বানিয়ে নিয়ে এলো।
গামলাটি সবার রেখেই বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো- আজ পৃথিবী থেকে কারেন্ট চলে গেছে। তাই দুপুরের রান্না হবে না।
সবাই ওর কথা শুনে বুঝে না বুঝে হেসে উঠলো। আজাদ ভাই বলল, ময়নার মা, কী হয়েছে আবার বুঝিয়ে বল তো। সে বললো- মামী বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করে জেনেছেন- আজ পৃথিবী থেকে কারেন্ট চলে গেছে। সবাই ওর কথায় অবাক হলেও আমি হইনি। আসলে সে পিডিবি-কে পৃথিবী মনে করেছে, সে পিডিবি জানে না, কিন্তু পৃথিবী শব্দটা জানে। তাই ওটাই বলেছে। সবাই ওর কথা আসল মর্ম বুঝতে পেরে আবার হো হো করে হেসে উঠলো।
আজ ভাত রান্না হবে না। বিদ্যুৎ নেই তাই সিলিন্ডারের গ্যাসের চুলায় সংক্ষিপ্ত খাবার রান্না হবে। সেটা খিচুড়ি ও ডিমভাজা। ব্যাস, এই খাবার অনেকেরই পছন্দ। বিশেষ করে বৃষ্টি দিনে। দাদু বললেন, খিচুড়িতে আদাকুচি দিতে বলিস্। একটু পুদিনা পাতা তুলে এনে আদা ও তেঁতুল দিয়ে ভর্তা করতে বলিস। হাজার হোক, দাদু হলেন বনেদী ঘরের সৌখিন খাদক। এত সুন্দর রান্নার নির্দেশনা শুনে আমাদের জিভে পানি আসার জোগাড়।
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পুদিনা ও আদা দু’টোই বাইরের জমিতে আছে। এই ঘন-বৃষ্টিতে কে তুলতে যাবে? চিনে জোঁক ধরবে তো। ময়নার মা কিছুতেই বৃষ্টিতে বাইরে যেতে পারবে না বলে দিল।
এদিকে পুদিনা ও আদা না হলে তো আজকের খিচুড়ি খাওয়টাই মাটি হয়ে যাবে। তাই জোঁক ভয় পায় না এমন কাউকে তুলতে যেতে বললো। সবাই না না করলেও শিলু ভাইকে জোর করে পাঠানো হলো পুদিনা ও আদা তুলতে। অনেক সময় পেরিয়ে সে এসে জানালো- পুদিনার গাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। আর আদার গাছ হলুদ হয়ে গেছে। ওর কথা শুনে আবার সবাই হেসে উঠলো। আদার গাছ কেন হলুদ হয়ে যাবে? একজন বলল, রে বোকা কী বলছিস তুই? আম গাছে কি লিচু ধরে?
দাদু বলল, আসলে ও ঠিকই বলেছে। আদা হলুদ হবে কেন? আসলে ক’দিন ধরে অতি বৃষ্টিতে পানিতে ডুবে ডুবে আদা গাছের পাতাগুলো হলুদ রং ধারণ করেছে। বৃষ্টি বন্ধ না হলে ওগুলো হয়তো মরেই যাবে।
এরপর খিচুড়ি রান্না হয়ে দাদুর ঘরেই চলে এলো। এই ঘরটি অনেক বড়। তাঁর অনেক বুকশেলফ্। প্রতিটি নানা বইয়ে ঠাসা। আমরা আজকাল বই পড়তে চাই না। অথচ, তিনি ভারী চশমা দিয়ে প্রতিদিন কোন না কোন বই পড়েন।
মজার খিচুড়ি খেতে খেতে দাদুকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো। একজন বলল, দাদু বলতো করোনা কবে বিদায় নেবে?
দাদু বিবিসি শোনেন নিয়মিত। বাংলা- ইংরেজি তো বটেই, তিনি হিন্দি, উর্দ্দু, আরবী, ফারসী এসব ভাষাতে পারদর্শী। ভোয়া, ডয়সেভেলে ইত্যাদিও শোনেন নিয়মিত। দাদু বললেন, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিবকে গতকাল বলতে শুনেছি- কোভিড-১৯ এর কোন জাদুকরী প্রতিষেধক এখনই পাওয়া যাবে না। আগামী এক দশকেও এই মহামারীর জীবাণু মরে যাবে না। তাহলে তুমি আধুনিক মানুষ, তুমিই বলো- করোনা কবে বিদায় নেবে?
আমিতো কোন ভাল লক্ষণ দেখছি না। কারণ, সবাই শুধু অবুঝের মতো কথা বলে। দিনকে রাত, রাতকে দিন করার তালে থাকে। করোনা শুরুর পর থেকে এর ঘটনশুরুর কারণ নিয়ে অদ্যাবধি লুকোচুরি, মিথ্যাচার, প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে বহু নামকরা দেশের বিচক্ষণ মানুষেরা। তারা একে অপরকে দোষারোপ করছে। মহামারীতে মৃত্যুর মোট সংখ্যাটা সত্যিকার অর্থে মিডিয়াকে বা মানুষকে জানানো নিয়েও তারা জালিয়াতি, চোগলখুরির আশ্রয় নিচ্ছে। গতকাল শুনেছ না- বিবিসি বলেছে, ইরানে কোভিড-১৯ এর আক্রমণে মোট মৃত্যুসংখ্যা ৪২ হাজার। ওদের সরকার বলেছে মাত্র ১৪ হাজার। আমাদের ঘরের টিভিতে কি কিছু শুনেছ? নাকি সারাদিন ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে ফুঁসফাস কর?
আসলে সব দেশের সরকারই যেন করোনা সংকটে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে। অনেক নেতা নিজেরাই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, অনেকে হীনমন্যেতায় ভুগেন। তাই চাপাবাজি করতে লজ্জা পান না। এজন্য তারা তথ্য গোপন করা, দম্ভ করা, গলাবাজি করা, মিথ্যা বলা থেকে নিজেদেরকে নিবৃত্ত রাখতে অপারগ। চায়না করোনামৃতদের লাশ গুম করেছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও প্রতিবাদ করে যাচ্ছে।
আজকের বিদেশী খবর শুনেছ তোমরা? গতকাল লেবাননে এমোনিয়াম নাইট্রেটের গুদামে ভয়ংকর বিস্ফোরণের সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন ওটা আক্রমণ। আজ আবার বলছেন, ভুল হয়েছে- ওটা বিস্ফোরণ। আমাদের ছোটবেলায় পত্রিকার দেখতাম ইসরাইলের সাথে ওদের যুদ্ধ, প্রায়শ: প্রথম পাতায় বিমান হামলার ছবি ছাপিয়ে লেখা হতো ‘বৈরুত জ¦লছে’। আজকে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে চলচিত্রকার জুড শেহাব বলেছেন- হচ্ছে- ‘বৈরুত কাঁদছে, বৈরুত চিৎকার করছে মানুষ এখন ক্লান্ত’। সাত বছর পূর্বের শাসকরা জাহাজে করে মোজাম্বিক নিয়ে যাবার পথে বৈরুত বন্দরে ২৭৫০ টন এমোনিয়াম নাইট্রেট সহ একটি জাহাজ আটক করেছিল। এগুলো সার অথবা বারুদ তৈরীর জন্য ব্যবহৃত হতো। সেই আটককৃত জাহাজের এমোনিয়াম নাইট্রেটগুলো অযত্ন-অবহেলায় গুদামে অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল। সেগুলোতে হঠাৎ বিস্ফোরণে দেড়শ কি.মি. পর্যন্ত বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১৩৭ জন প্রাণ হারিয়েছে, বন্দরে বহিনোঙ্গরে রাখা জাহাজে পর্যন্ত আগুন ধরে গেছে। একটি বাংলাদেশী জাহাজও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আমাদের দেশীয় চারজন নাবিক মারা গেছে। একটি দুর্বল দেশের এত মারাত্মক ক্ষতির প্রকৃত কারণ উদ্বঘাটনের জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবী করছে লেবাননের মানুষ। এ অবস্থায় কে তাদের সহযোগিতা করবে কে ক্ষতিপূরণ দেবে তা পরিষ্কার নয়। করোনার এই ভয়াবহ সময়ে লেবাননের মানুষ চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে।
আমাদের ঘরের টিভিতে দু’জন আইন প্রণেতা বলেছেন- বিশেষজ্ঞদের সকল আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে আমাদের দেশে করোনা নাকি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। অথচ জুলাই ৪ তারিখে সেই সংখ্যা বেড়ে ৫০ জন এবং ৬ তারিখে ৩৯ জন ছিল। ওনাদের বিবৃতি পত্রিকায় পড়ে একজন পাঠক লিখেছেন, তাহলে তিনি কেন ঘরের মধ্যে বসে আছেন? রমনা পার্কের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড় দিয়ে প্রচার করুন করোনা নিয়ন্ত্রিত। আরেকজন লিখেছেন- দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাহলে আগামীকালই খুলে দেয়া হোক।
দাদু বলতে লাগলেন, দেশে এখন করোনার নমুনা কতজন মানুষ টেষ্ট করতে আগ্রহী, জান? কেন আগ্রহী নন সেটা উপলব্ধি করতে পারো? কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে হাসপাতালে নমুনা টেষ্ট করতে গিয়ে যদি পরে শুনি আমার নমুনা বালতিতে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আমাকে ভূয়া রিপোর্ট ধরিয়ে দেয়া হয়েছে তাহলে কেউ সেই হাসপাতালে  পুন:বার যেতে আগ্রহী হবে? এই সংকটময় সময়ে হাসাপতালের বেডগুলো কেন ফাঁকা পড়ে আছে, সেকথা জানো?
সেদিন দেখলে না- বেশ ক’বছর আগে থেকেই মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁস হয়ে চার হাজার ভূয়া ডাক্তার ভর্তি হয়েছে। চুরি করে ভর্তি হয়ে ওরা কি আসলে কোন সঠিক বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করেছে? নাকি নকল করে মানুষকে মেরে ফেলার কৌশল আয়ত্ব করেছে? দাদুর মুখের খাবার ঠোঁট বেয়ে বাইরে পড়ে যেতে লাগলো। তিনি রাগে, ক্রোধে গড় গড় করতে লাগলেন।
এইসব চুরি করে ভর্তি হওয়া নকল ডাক্তারের কাছে মানুষের নেগেটিভ রিপোর্ট পজেটিভ হয়ে যায় টাকার বিনিময়ে। এরা কি কোনদিন গবেষণা করে ভাল কিছু বের করতে পারবে? টিকা আবিষ্কার নিয়ে মার্চ মাস থেকে শুধু হৈ চৈ শুনে আসছি। এখন শুনছি আগামী এক বছরেও কার্যকরী টিকা বাজারে আসার সম্ভাবনা নেই!
ময়নার মা যে বলল, পৃথিবী থেকে কারেন্ট চলে গেছে, কথাটা সে ঠিকই বলেছে। জুলুম, জালিয়াতি ও নকলবাজির কারণে মানুষের মগজ থেকে ধৈর্য্য হারিয়ে গেছে। অন্যায়, দুর্নীতি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও শয়তানির প্রভাবে মানুষের মননে ক্রমাগত ময়লা জমে জমে শিরা-উপশিরা কলুষিত হয়ে গেছে। মানুষের গঠনমূলক চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছে। অর্থের লোভ আর দুষ্ট মনোভাব নিয়ে তারা মৌলিক গবেষণা করবে কীভাবে?
শুধু গবেষণা নয়, সেবা ক্ষেত্রে দুষ্টদের প্রাধান্য প্রবল। কারণ ঘুষ দিয়ে চাকুরী লাভ তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে কাজ করার চেয়ে বেপরোয়া আচরণ করতে সাহস যোগায়। এজন্য পারিবারিক আর্থিক দুর্বলতা থাকার পরও নূরজাহানের মত সর্বসাকুল্যে ২৮ হাজার টাকা বেতনভূক কম্পিউটার অপারেটরকে চাকুরী লাভের চার বছরের মাথায় এক কোটি বিশ লক্ষ টাকা দামের প্রাডো গাড়িতে চড়ে অফিসে আসতে দেখা যায়।
অথবা পিওনের পাঁচটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়। তারও পরিবার সোয়া কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করে। কেউ কেউ নিজে ২৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে সন্তানকে মাসিক ষোল হাজার টাকা বেতনের স্কুলে পড়ায়। তিনি বলতে লাগলেন, আমি যখন সরকারী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক তখন আমার এক উপ-সচিব বন্ধুর বেতন স্কেল আমার স্কেল সমান ছিল। সেই সময়ে সে গাড়ি-বাড়ির মালিক হলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিত না। এরপর আমার সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতো না, এখনও নেই।
রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের ফলে ওয়ার্ড লেভেলের নেতারা নদী দখল করে, বন উজাড় করে ফেলে, পাহাড় কেটে আবাসন প্লট বিক্রি করে বালিশে টাকা ভরে রাখে। কোন কোন নেতারা করোনা-বন্যার ত্রাণের ডাল, তেল চুরি করে শোবার খাটের পাটাতনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে উপরে ঘুমায়। এইতো চরিত্র। এই অনৈতিক চরিত্রের মানুষগুলো সব সরকারের সময় সরকারী সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চলাফেরা করে থাকে। তারাই অর্থ ও বিত্তশালী হিসেবে ফি মৌসুমে রাজনীতির মাঠ গরম করে নির্বাচন করে, জিতেও যায়। তাদের নির্বাচনের অর্থ কি ভূতে যোগান দেয়?
দাদু আর খেতে পারলেন না। পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে উঠে গেলেন। হাত ধুয়ে ফিরে এসে বলতে লাগলেন, ক’দিন ধরে খুউব বৃষ্টি হচ্ছে রে। অতিবৃষ্টিতে শুধু আদার ক্ষেত কেন অনেক শাক-সব্জীর গাছ পানিতে ডুবে হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে। এখন বন্যায় দেশের ৪০ ভাগ পানির নিচে ডুবে আছে। বন্যার পানি টানতে শুরু হলেই ডায়রীয়া, আমাশয়, সর্দ্দিজ¦র, ইত্যাদি শুরু হবে। তোরা কেউ বাইরে বের হবি না। তবে করোনা প্রতিরোধে রোদে যাওয়া আবশ্যক। এজন্য রোদ উঠলে মাঝে মাঝে ছাদে বা বাগানে যেতে পারিস। আর হ্যাঁ, যেখানে সেখানে পানি খাবি না।
গতকালের বিবিসিতে পর্যন্ত কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে ট্যানারী মালিকদের কারসাজি ও কোরবানিকারীদের দুরাবস্থার সংবাদগুলো ছড়িয়ে গেছে সেটা দাদুকে খুব ব্যথিত  করেছে। নওগাাঁর এক গ্রামে কোরবানির চামড়াগুলো বিক্রি না হওয়ায় নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকার পোস্তায় ৪০ ভাগ চামড়া পচে নষ্ট হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দিয়ে আসা দানকৃত চামড়া বিক্রি করতে না পারায় এবং সংরক্ষণের অভাবে পচে গেছে। সেগুলো সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা বুলডোজার দিয়ে ভাগাড়ে ডাম্পিং করার ছবি টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। এভাবে মূল্যবান জাতীয় সম্পদ চামড়ার ক্রয় শৈথিল্যে এবং পচন, ডাম্পিংয়ে বঞ্চিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ দুস্থ:-এতিম শিক্ষাথীর্ বলতে বলতে দাদু আবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন।
বিড় বিড় করে বলেই চললেন- ট্যানারী মালিকরা তো রাজনীতি করে, ওরা তো অনেক ধনী ব্যবসায়ী। দেশের বিত্তশালী মানুষগুলোকে মানবিক না হলে চলবে কীভাবে? এই, তোরা কিন্তু জীবনে সব সময় সবুজ-সতেজ থাকার চেষ্টা করবি। ন্যায়ের পথে থাকবি। দেখবি মানুষ ভাল হলে দেশটা একদিন ভাল হয়ে উঠবে।
একজন একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলো। মৃদু কথা বলতে বলতে দাদু একটা বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
রাস্তার ছেঁড়া তার ঠিক না হলে তো আজ আর বিদ্যুৎ-এর দেখা মিলবে না। ময়নার মা রাতে হয়তো আর রান্না করতেই চাইবে না। করোনা ও বন্যার মাঝে প্রতারক ও লোভী মানুষগুলোর অপকর্ম যেভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশে- বিদেশে ছড়িয়ে গেছে তাতে আমাদের এই সবুজ শ্যামল দেশের প্রবাসী মানুষগুলো এই মুহূর্তে বেশ বিপদে পড়েছেন। দেশে-বিদেশে আমাদের কোটি কোটি সবুজ-সতেজ মানুষগুলোর সাদা মনে দাগ লেগে হলুদ পান্ডুর রং যেন ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে আর পীড়িত অসহায় মানুষগুলোকে উপহাস করছে। মনে হলো আদার গাছ হলুদ হয়ে যাবার মত চারদিকে সবকিছু বিবর্ণ হয়ে দিনে দিনে তিলে তিলে মহাকালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। কতদিনে তা জেগে উঠবে কেউ তার সঠিক দিনক্ষণ জানেন না। শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন জানেন কবে এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে।

 * প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top