logo
news image

মজ্জায় ময়লা ত্বকে সাবান-সুগন্ধি

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
শ্রাবণের ছয় তারিখে ঢাকার জলাবদ্ধতা ও ভয়ংকর যানযট দেখে আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পূর্বের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমি তখন ঢাবি-র ছাত্র ছিলাম সেই সময়কার কথা। ঢাকার মেরুল বাডায় আমার এক আত্মীয় থাকতো। সেই সুবাদে মেরুলে ঘন ঘন যেতাম। সেখানে একদিন এক বিদেশিনী ভাবীর দেখা। তিনি ইউরোপের এক দেশের ডাক্তার। আমাদের এক বড় ভাইয়ের সাথে বিদেশে এক সাথে ডাক্তারী করতে করতেই পরিচয় ও বিয়ে। ভাইয়ের সাথে সাথে তিনিও বাংলাদেশকে খুব ভালবাসেন। তাই সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। সেবার কোরবানির ঈদের সময় বন্যা হওয়ায় ছুটি বেশ লম্বা হয়েছে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়া হয়নি। সেই সুবাদে ঢাকায় প্রায় সব আত্মীয় বাড়িতে ঈদের দাওয়াতে বিদেশিনী ভাবীর সংগে দেখা হয়ে যেত। তিনি আমাদের দেশের এত এত ঈদের খাবারের আয়োজন দেখে বিস্মিত হয়ে যেতেন। বেচারী ক’দিন ধরে ‘রিচ ফুড’ খেতে খেতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন।
তাই খেতে বসে গল্প করতেন বেশী। বিশেষ করে আমার সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় আমি ওনার দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ইত্যাদি নিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইতাম। তিনিও সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন। আমাদের শহরের চেয়ে গ্রামগুলো তার ভাল লাগতো বলে জানাতেন। তবে তখনকার গ্রামের রাস্তা মোটেও ভাল ছিল না। এমনকি একবার গ্রামে বন্যার সময় তাঁর রাস্তায় চলার অভিজ্ঞতার কথা বলে বলতে সেদিনের মেরুল বাড্ডা ‘গ্রামের’ কথা বলতে শুরু করলেন। রাতে বেড়াতে আসায় তাঁর কাছে মেরুল বাড্ডাকে সেদিন গ্রাম মনে হয়েছিল। আমার আত্মীয়ের বাসাটি একটু ভিতরে হওয়ায় একটু দূরে খোলা জমিতে গাড়ি থামিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে বাসায় ঢুকতে হতো।
মেরুল বাড্ডা গুলশান থানার মধ্যে হলেও তখনও আজকের মত কোন নতুন বিল্ডিং ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে মৌচাক এসে গুলিস্তান-রামপুরা মুড়িরটিন বাসে রামপুরা টিভি গেটে আসতে হতো। তখনও রামপুরা ব্রীজ তৈরী হয়নি। সেখানে একটি বেইলী ব্রীজ ছিল। তাই বড় বাস কুড়িলের দিকে আসতে পারতো না। রামপুরা ব্রীজ পার হয়ে রিক্সায় উঠে মেইন রাস্ত্ার ওপর রিক্সা থেকে নেমে হেঁটে মেরুলের ভেতর ঢুকতে হতো। এরপর আরো ভেতরে যেতে চাইলে গুদারাঘাটে নৌকায় পার হয়ে পশ্চিম পাড়া দিয়ে গুলশান শুটিং ক্লাবের দিকে যাওয়া যেত। বর্ষাকালে এসব রাস্তায় কখনও হাঁটু পানি, কখনও কোমর পানির বন্যা বয়ে যেত। তখন হাতির ঝিল এলাকার বদ্ধ পানি সরানোর জন্য রামপুরা ব্রীজ এলাকায় অর্ধশত পাম্পিং মেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে রাস্তার পূর্বদিকে পানি ফেলে দেয়া হতো। এখনও রামপুরা ব্রীজ ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করারা অন্যতম কড়িডোর। কিন্তু রামপুরা ক্যানেলের ভাটিতে বিভিন্ন অপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প তৈরী হওয়ায় প্রাৃকতিকভাবে ঢাকার বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যাবার গতি রুদ্ধ হয়ে গেছে। তাই ২০২০ সালে এসেও সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার জলবদ্ধতা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
যাহোক, সেদিন খেতে খেতে ভাবী বললেন, তোমাদের বাসাগুলোর ড্রইংরুমের সাজসজ্জা বেশী। অনেক গুছানো, বেশ ভাল। ভেতরের কক্ষে এত জিনিষ কেন রাখ? এ ছাড়া শহরের রাস্তা, কাঁচা বাজার এত নোংরা কেন? আমি কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। তখন ঢাকার রাস্তা ছিল অনেক বেশী খানা-খন্দকে ভরা। বর্ষার দিনে পানি ও খরার দিনে ধূলায় ভরপুর। রাস্তার লাইটপোষ্টগুলোতে এত আলোর ব্যবস্থা ছিল না। গাড়ি পার্কিং ও সিগন্যালবাতিও তখনও ছিল না, এখনও কার্যত: নেই। কাঁচা বাজার মানেই ময়লা, রক্ত ও কাদায় মাখামাখি করা অস্বাস্থ্যকর এবং চিৎকার কোলাহলের জায়গা। ভাবীর পর্যবেক্ষণে ছিল আমাদের সবার ড্রইংরুমের সাজসজ্জা। এটা যেন মুখে ফেসপাউডার মেখে নিজের নোংরা শরীরটাকে আড়াল করার মত কিছু একটা।
অনেকদিন পর বিদেশিনী ভাবীর কথাটা মনে পড়লো। করোনার কদর্য সময়ে কালো টাকা উপার্জনের ঘৃন্য পন্থার ফাঁদ পাতা মানুষগুলোর সংবাদ দেখতে দেখতে মনটা ঘৃণায় ভরে যাচ্ছে। এসময় আমাদের মেকী পোষাকধারী প্রতারকদের করোনা সনদ বিক্রির কৌশল দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলছি। আন্ডার মেট্রিক মানুষ কিভাবে গন্ধওয়ালা গতরে ব্রান্ডের পোষাক চড়িয়ে সমাজের উঁচুস্তরের মানুষগুলোকে অতি সহজে ধোকা দেয়! ওরা ভানুমতির খেল দেখিয়ে সবাইকে কুপোকাত করে কিসের জোরে?
সেই জোরটির উৎস হলো কালো টাকা। ধরা পড়ার পর দম্ভ করে তাকে বলতে শোনা যায়- শতাধিক রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী তার কাছে সুবিধা নিয়েছে। এখন বিপদের সময় কেউ কাছে ভিড়তে চাচ্ছে না!
রিজেন্ট- জে.কে কেলেঙ্কারী তাহলে আমাদেরকে কী শিক্ষা দিচ্ছে? কালো টাকার ছড়াছড়ি কি বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত বইছে? সমাজের ওসব উঁচু মানুষেরা কি তাহলে শাহেদদের কাছে জিম্মি হয়েই রয়েছে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত জিরো টলারেন্স কি শুধুই কথার কথা?
কালো টাকার কথা শুনলেই আমাদের মেরু-রজ্জুতে শিহরণ জাগে কেন? এবারের বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা দুর্নীতিকে উস্কে দেয়। তাই এই ব্যবস্থা বহাল রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স শুধু মুখের কথা হিসেবেই থেকে যাবে। এর পক্ষে অর্থনীতির যত ব্যাখ্যাই হাজির করা হোক না কেন কার্যত: এ টাকার কোন সঠিক হিসেব নেই, তাই বরকত নেই। কারণ করোনা কিংবা বন্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে কি সেই অর্থ দিয়ে মোকাবেলা করতে পারবেন?
আমাদের মজ্জায় মিথ্যার শিহরণ যার কারণে বিনা নমুনা টেষ্টে করোনার সত্য সনদ বিতরণ। এগুলো মানুষের মনের উপর দুষ্ট ও শয়তানি বুদ্ধির প্রতিফলন মাত্র। কালো টাকার প্রভাবে মদ-জুয়া, সুদ-ঘুষের উপর ভেসে বেড়ালে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীত্ব  এসে বাসা বাঁধে, মগজে দুষ্টুমি খেলা করে। মানুষ ন্যায়-অন্যায় ভুলে যায়। এ অবস্থায় শুধু করোনার কদর্যতা মাথায় নিয়েও মানুষ পশুত্ত্বে নেমে যেতে পারে। এ পর্যায়ে না গিয়ে একজন মানুষ কীভাবে বিনা পয়সায় টেষ্ট করার অনুমতি নিয়ে এসে বিনা টেষ্টেই মরণঘাতী সনদ উচ্চমূল্যে বিক্রি করে? আমাদের সমাজ এমন উন্মাদ তৈরী হতে কি ন্যাক্কারজনকভাবেই না উদার হস্তে সহায়তা করে যাচ্ছে!
এসব উন্মাদ সৃষ্টির রুট সবার অজানা নয়। জালিয়াতি-জুলুম করে জীবন-জীবিকা চালানো, কালো টাকার উপর পদ-পদবী কিনে ভেসে বেড়ানো, সুদ-ঘুষের উপর বসতি গড়া, মদ-গাঁজার উপর উন্মাদনা তৈরী করা একজন ঈমানদার তথা নীতিবান মানুষের কাজ নয়। এভাবে ময়লা তৈরী করা ও ময়লা খাওয়ার লোকের প্রাচুর্য্য বেড়ে যায়। নদীর মিঠা পানির স্রোত যেমন সমুদ্রে গিয়ে মিশে মিষ্টতা হারিয়ে লোনা রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজে ভাল মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় এবং চোর-বাটপারের সংখ্যা বেশী হওয়ায় নীতিবান মানুষগুলো অনৈতিকতার চাপে হারিয়ে যায় অথবা চুপটি করে থাকে। ফলে আমাদের মত সমাজ দুর্নীতিতে ভরে গিয়ে অন্যায়ের মহাসমুদ্রে রূপ নিতে দেরী হয় না।
আইনের সাথে সুশাসনের সম্পর্ক নিবিড়। সুশাসন না থাকলে আইনের সঠিক প্রয়োগ করা কঠিন। এছাড়া আইনের ভয় হলো সাবানের ফেনার মত। এ দিয়ে শরীরের ময়লা ঘষে পরিষ্কার করা গেলেও মনের ও মজ্জার ময়লা বের করার জন্য সঠিক মোটিভেশন দরকার। ভাল মোটিভেশন দিতে ও নিতে হলে সুশিক্ষা দানের ব্যাপারটি এসে যায়। সুশিক্ষা মানুষের মধ্যে ভিতর-বাহির মিলে একটি ন্যায়াবরণ তৈরী করতে পারে। এই ন্যয়াবরণ তৈরী না হলে মানুষের মধ্যে নৈতিক প্রতিবন্ধিত্ব কালো ছায়া ফেলে। তাই অন্যায় কাজ ও অবৈধ আয়ের উৎসের হাতছানি থেকে একজন নীতিবান মানুষকে সতর্ক থাকতে হয়।
আমাদের প্রচলিত জিরো টলারেন্স প্রক্রিয়া অন্যায়ের উৎস মুলোৎপাটন করার ব্রত থেকে শুরু করতে হবে। এজন্য সমাজের উচু-নিচু সর্বস্তরের সবাইকে আত্মশুদ্ধি করে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে- শুধু মুখে ফেসপাউডার মেখে এবং শরীরের ত্বকে সাবান-সুগন্ধি মেখে বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়, ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতি দূর করা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।
নিত্যনতুন ময়লা তৈরী করা, ময়লায় বাস করা ও ময়লা ভক্ষণ করা মানুষগুলোকে চিহ্নিত করবে কে? একটি অতি মুনাফালোভী শ্রেনি আমাদের ভৌত উন্নয়ন কাজের খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নামে জনভোগান্তি তৈরী করে রাজধানীকে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য ভাগাড়ে পরিণত করে তুলেছে। প্রতিবছর রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়নের নামে এত কাজ করা হলেও সামান্য বৃষ্টিতে রাজপথে থৈ থৈ বন্যা যেন আমাদের প্রকৌশলিক দৈন্যতার হীন প্রতিচ্ছবিকে নগ্নভাবে চিত্রায়িত করে বিশ্বব্যাপি উপহাস করছে। এদের কারণে টোকিও শহরের চেয়েও রাজধানী ঢাকায় যে কোন স্থাপনা তৈরীর খরচ তিনগুন বেশী। কিছুদিন আগে জাপানীজ ঠিকাদারগণ ঢাকায় স্থাপনা খরচের এত আনুষাঙ্গিক ব্যায়ের বাহার দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
তাই এদেরকে ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে না পারলে আমাদের বাজার, রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, বসতবাড়ি সবজায়গায় অনবরত উটকো দুর্গন্ধ বের হতে থাকবে। এই দুর্গন্ধের মাত্রা একটু বেশী হলে এই ইন্টারনেটের যুগে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় ছড়িয়ে ন্যানো-পিকোর চেয়ে আরো বেশী গতিতে পৃথিবী ছেড়ে গ্রহ-গ্রহান্তরে ছড়িয়ে যাবে। তখন শুধু বিদেশিনী ভাবী নয়, কিংবা কুয়েতের কারাগারে আমাদের সাংসদ নয় অথবা ইটালীর মিলান এয়ারপোর্ট থেকে প্রবাসীদের দেশে ফেরতই নয়- ভবিষ্যতে মর্ত্যরে সব জায়গায় বাংলাদেশীদের প্রতি ঘৃণার আওয়াজ শোনা যেতে পারে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top