logo
news image

ভার্চ্যুয়াল শিক্ষায় টেকসই রূপান্তর

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
অধুনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই একটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে। সীমিত আকারে অফিস, ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ায় মিটিং করা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্স চালানো, অনলাইন পাঠদানের জন্য ক্লাশ নেয়ার সরগরম অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নি:সন্দেহে এটা একটা বিরাট আধুনিক পরিবর্তন। করোনার প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় এই ধরনের পরিবর্তনের হাতছানি নিয়ে অনেক ভাবনার উদ্রেক আমরা দেখতে পেয়েছি। মনে হচ্ছে, করোনার আক্রমণ এই পরিবর্তনে একধাপ গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনেকে ভেবেছেন, এই তো ক’দিন। করোনা গেলেই ক্লাসে ফিরব, তাই আপাত: মন্দের ভাল শিক্ষার্থীদেরকে ঘরেবন্দী  রেখে একটু ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য অনলাইনে সাময়িক পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হোক। সেই হিসেবে অনেক প্রতিষ্ঠান সেটা চালু করে দিয়েছিলেন। কিছুদিন পর গবেষণায় দেখা গেল- নানা কারণে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী সেটার নাগাল পায়নি, ফলে তারা সুফলও পায়নি।
এদিকে এখন বলা হচ্ছে- করোনা এখুনি বিদায় নেবে না। আগামী দু’এক বছরে চলে যাবে কি না সন্দেহ। তাই আমাদেরকে দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী থাকতে হবে। জুন ২৬ তারিখে এক সেমিনারে বলা হয়েছে- আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের পিক সময় এখনও আসেনি। জুলাই মাসে সেটা হতে পারে। সংক্রমণের উচ্চগতি ও মৃত্যুহার দেখে এখন তাই মনে হচ্ছে।
তাই করোনা যাক্ বা থাকুক, শিক্ষায় ভার্চ্যুয়াল রূপান্তরকে স্থায়ীভাবে সাজিয়ে আধুনিক শিক্ষাকাঠামো নিয়ে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা করতে হবে। সেটার প্রস্তুতির সময় এখুনি। সরকারীভাবে শিক্ষার রূপকল্প ২০৪১ পরিকল্পনার সাথে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় যদি একটি শক্ত অবকাঠামো দাঁড় করানো যায় তাহলে সেটা শিক্ষার আধুনিকায়নকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। এর মাধ্যমে শিক্ষাব্যয়ের অনেকটা সংকোচন হবে এবং অপচয় রোধ হবে। তাই এ্টাকে সাময়িক দায়সারা গোছের কাজ না ভেবে শুরুতেই একটি মজবুত কাঠামো তৈরীর চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করা ভাল।
এজন্য যেসব কাজে হাত দিতে হবে সেগুলো বিভিন্ন মাঠ গবেষণায় প্রায় অনেকটাই বের হয়ে  এসেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত মাঠ গবেষণা ফলাফলে জানা গেছে- অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পাঠদানের অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। অনেক সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য একসংগে একসেস্ দেবার মত নিজেদের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেই। অনেক সংখ্যক শিক্ষার্থীর আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। অনেকেই গ্রামে-গঞ্জে বাস করায় নেট একসেস্ নেই এবং যাদের রয়েছে, তাদেরগুলো ধীর গতি সম্পন্ন।
শহরাঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ পেলেও তারাও ততটা তৎপর বা মনোযোগী নয়। সব মিলিয়ে শতকরা ৩০-৫০ ভাগ অনলাইন ক্লাশে অনুপুস্থিত থাকে।
অনেক ছেলেমেয়ে অনলাইনে বিনোদন করতে ভালবাসে। কিন্তু অনলাইন পড়াশুনা ও পরীক্ষা দিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। অনেকে অনলাইন ক্লাসে বসে শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কিন্তু কানের হেডফোনে গান শোনে। পরে বন্ধুর কাছে রেকর্ড করা ক্লাশ লেকচার পেতে ধর্ণা দেয়।
তবুও সকল সমস্যা মিটিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পাঠদানের অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এজন্য একটি কমন প্লাটফরমের কথা শিক্ষামন্ত্রী সংসদে বলেছেন। এই প্লাটফরম তৈরীর কাজটা কিভাবে হবে এবং কতদিনের মধ্যে সেটা বাস্তবায়ন করা যাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আরেকটি বিষয় কেউ ভাবেননি। সেটা হলো- এপর্যন্ত নেটে যে তৎপরতা দেখা গেছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত তরুণ ও নবীন শিক্ষকদের প্রচেষ্টা। নবীন শিক্ষকরা ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে বেশী অংশগ্রহণ করছেন। প্রবীণ বা বয়স্ক শিক্ষকগণ আধুনিক প্রযুক্তি ও শিক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে। তত্ত্বীয় ও মানবিক ধারার বিষয়গুলোতে এই প্রবণতা বেশী দেখা যায়। তাঁদের কেউ কেউ এগুলো পছন্দ করেন না। কেউ আবার ঘোর সমালোচনা করেন পাওয়ার পয়েন্টে স্লাইড ব্যবহার করে ক্লাশ নেয়ার। ক্লাসে গিয়ে সিলেবাস ও টপিক বহির্ভূত আলোচনা করে সময় কাটানো শিক্ষক এখনও অনেক আছেন। অনলাইনের ক্লাস কেউ রেকর্ড করতে পারে এই সংকোচে তারা এই আধুনিক ব্যবস্থায় মোটেও সায় দেন না বরং অনেকে এর সমালোচনা করেন। যদিও কোন গবেষণায় এই ধরনের সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়নি তথাপি এটার ওপরও খানিকটা গুরুত্ব দেবার সময় এসেছে।
কারণ, অনেকে গবেষণা নেটওয়ার্ক অনুসন্ধান ও অনলাইন লাইব্রেরীর কাছে ঘেঁষেন না। কম্পিউটােের টাইপ করতেও জানেন না। ই-কন্টেন্ট তৈরী করতে জানেন না। এ ব্যাপারে তাদের নিজেদের মাইন্ড সেট করাটাও বেশ দুরুহ ব্যাপার।
এখন আসি সমস্যাগুলো উতরে অনলাইন শিক্ষায় আমাদেরকে কিভাবে সফলকাম হতে হবে সে বিষয়ে।
গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য সরঞ্জাম ধার দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার লাইব্রেরীতে যেভাবে বই ধার দেয়া হয় সেভাবে নোটবুক, নেটবুক, ল্যাপটপ, পামটপ, স্মার্টফোন, রাউটার, হেডফোন ইত্যাদি কার্ডের মাধ্যমে ধার দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা বাবা-মা ও অভিবাবকদের আয়ের সার্টিফিকেট দেখে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেবার আশু জরুরী ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো কেনার জন্য বিভাগগুলোকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। অথবা কেন্দ্রীয়ভাবে ভাল ব্রান্ডের মেশিনপত্র কিনে দ্রুত সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্র্যাকটিক্যাল রিসার্চ ও ফিল্ডওয়ার্কের জন্য বিকল্প ভাবনায় গ্রেডিং প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওপেন বুক সিস্টেমে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অনলাইনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যেটা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত রয়েছে। আমাদের দেশে সারদা পুলিশ একাডেমীতেও অনেক কোর্সর ওপর ওপেন বুক পরীক্ষা নেয় হয়। বিশেষ করে আইন ও জটিল তত্ত্বীয় বিষয়গুলোর জন্য।
অনেক জায়গায় উপস্থিতি, এ্যাসাইনমেন্ট ও ক্লাশ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রেডিং দেয়ার পদ্ধতি বেশ প্রচলিত।
এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে শুধু লেকচার শুনলে বা অংশগ্রহণ করলেই কোর্স সমাপনীর পরিবর্তে শুধু অংশগ্রহণের সনদ দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে ক্লাসের মধ্যেই প্রশ্নত্তোর পর্ব থাকে এবং টকশোর মত কোন বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য সুযোগ দেয়া হয়। এতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও উৎসাহ জানা যায়। আমাদের দেশেও সেটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে পরীক্ষাভীতি ও নকল প্রবণতা কমে আসবে। অর্থাৎ, কোর্সের ওপর কোন শিক্ষার্থীর মনোযোগ বা মাইন্ড সেট কতটুকু তা পর্যবেক্ষণ করেই একজন শিক্ষক সেই কোর্সের গ্রেডিং সনদ দেয়ার সুপারিশ করবেন। এতে শিক্ষার্থীর মনোযোগ বাড়বে ও ফাঁকিবাজি করার  প্রবণতা কমে জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি মূখ্য হয়ে দাঁড়াবে।
এই মুহূর্তে ইন্টারনেট সহজলভ্য করা, ফ্রি মেগাবাইট প্রদান করার জন্য ফোন কোম্পানীগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া দরকার।
শিক্ষকগণ অনলাইনে ক্লাশ নেয়ার পর তাদের ক্লাসের সফ্ট কপিগুলো ই-মেইল, ড্রপবক্স, আইক্লাউড, ইত্যাদিতে সংরক্ষণ করে সেগুলোর উপর আ্ইডি নম্বর দিয়ে ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীর জন্য ওপেন একসেস্ দিলে যারা কোন কারণে বুঝতে পারেনি বা ক্লাস মিস  করেছে তারা পরে সেগুলো নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবে।
করোনার এই কঠিন সময় দীর্ঘ হলে হেলায় কালাতিপাত করা চলবে না। এ সময়ে যেভাবেই হোক আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মূল্যবান জীবনের প্রতি যত্ন নিয়ে পড়ায় অবিচল থাকতে হলে অনলাইন শিক্ষাকে একটি টেকসই অবকাঠামোয় রূপ দেয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top