logo
news image

করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতগণের মর্যাদা

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
করোনাকে বলা হয় একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যারা শরীক হয়েছেন তারা সবাই যোদ্ধা। কেউ সম্মুখ সারির যোদ্ধা, কেউবা নেপথ্যে থেকে এই যুদ্ধে সহায়তা করছেন। এই যুদ্ধের মাঠে-ময়দানে শরীক হয়ে কেউ মারা যাচ্ছেন, কেউ বা শরীক না হয়েও ঘরে বসে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয়ে অকালে আত্মাহুতি দিচ্ছেন।
এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ খুবই শেয়ানা। তাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু কারো উপর ভর করে ফেললে অনুভব করা যায়। এই অনুভবের মাত্রা কখনও কখনও পাহাড়সম ভারী, মহা-সাগরসম অথৈ, আকাশসম অসীম। দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে করোনার কালো কামড়ের ছোঁয়া। এ পর্যন্ত (জুন ২১) সাড়ে চার লক্ষ মানুষ এই মরণ কামড়ের বিষে নীল হয়ে পরপাড়ে পাড়ি জমিয়েছেন।
যারা করোনার লক্ষণকে মেডিকেল টেষ্টের মাধমে ইতিবাচক বা নিশ্চিত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন তারা আপাত:দৃষ্টিতে ভাগ্যবানদের অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন। তাদের পরিসংখ্যানিক তথ্য সরকারী খাতায় লেখা হয়েছে। তাদের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। করোনায় মৃত একজন ডাক্তার ইতোমধ্যে সরকারী সহায়তার আনুকুল্য পেয়ে গেছেন। কেউ হয়তো ভবিষ্যতে নানা সহায়তা পাবেন।
একটি ধর্মমতে তারা হয়তো শহীদী দরজা লাভ করবেন। ইহলোক ও পরলোক দ’ুদিকেই তাদের কল্যাণ হতে পারে। আর যারা দুর্ভাগ্যবশত: মেডিকেল টেষ্টের মাধমে ইতিবাচক বা নিশ্চিত না হয়ে মারা গেছেন তাদের ভাগ্যের ক্ষেত্রে কী ঘটবে এটাই আজকের ভাবনা।
মেডিকেল টেষ্টের মাধমে ইতিবাচক বা করোনা সংক্রমণ নিশ্চিত না করেই যারা মারা গেছেন তাদের তথ্য প্রকাশিত হয়নি। কেউ তাদের সংবাদ ছাপেনি। কারণ, অনেকেই তাদের তথ্য গোপন রেখেছে। নানা ভয়ে কাউকেই জানাতে চায়নি।
অর্থাৎ, টেষ্টহীনতা তাদের করোনার সরকারী স্বীকৃতিহীনতার ক্ষেত্র তৈরী করেছে। সরকারী স্বীকৃতিহীনতা ভবিষ্যতে তাদের সরকারী সাহায্য পাবার বঞ্চনার ক্ষেত্র তৈরী করেছে। অপরদিকে এটা দেশে করোনায় মোট মৃত্যুসংখ্যা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরী করেছে। কারণ, অনেক বড় বড় দেশেও করোনায় মোট মৃত্যুসংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও জোর গলায় বলছে- চীন রাতের আঁধারে হাজার হাজার করোনা রোগীর লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে। তারা জিআইএস-এর মাধ্যমে উহানের সেই সময়ের বাতাসের গন্ধের মাত্রা নিরুপণ করে এই তথ্য নিশ্চিত হয়েছেন। যদিও চীন তা স্বীকার করে না।
আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জে প্রতিদিন বহু মানুষ করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করছে। তারা বিভিন্ন কারণে করোনা পরীক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার অনেকে বড় শহরে থেকেও করোনা টেষ্ট করার ঝুঁকি ও ঝক্কি এড়াতে ঘরে থেকেই মারা যাচ্ছেন। কারো সংক্রমণের তথ্য জানাজানি হয়ে গেলে তাকে একঘরে করা, তার বাড়িতে লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়া, এলাকায় লকডাউন জারি করা হয়। এছাড়া আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে কুসংস্কার, সামাজিকভাবে হেয় ও ঘৃণা করা ইত্যাদি খুব ভয়ানক বিষয় হিসেবে দেখা দেয়।
এছাড়া এই অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলে আইসোলেশনে রাখা, যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার ব্যাপার তো আছেই। এ ধরনের নানাবিধ পরিস্থিতির শিকার হয়ে মানুষ সংক্রমিত হয়েও করোনার তথ্য লুকিয়ে ফেলেছে। সাধারণ মানুষ ছাড়াও অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষ উপসর্গ নিয়েও বেপরোয়াভাবে চলাফেরা, কাজে যোগদান করা থেকে বিরত হননি। এমনকি নিজের অজান্তেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে অনেক সাংসদ সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ফেলেছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টিভিতে করোনায় প্রতিদিনের মৃত্যুর হিসেব দিলেও সারাদেশে উপসর্গ নিয়ে বা সন্দেহজনক মৃত্যুর কোন সরকারী তথ্য দেয় না। ফলে যারা  করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা মারা গেছেন তাদের সংখ্যা সরকারী খাতায় লেখা হয় না। এতে মানুষের মনের মধ্যে আক্ষেপ, সন্দেহ থেকেই যায়। একদিকে আপনজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে সরকারী উপেক্ষা তাদের হতাশাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
সম্প্রতি সিজিএস নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীদের এক গবেষণা থেকে মূল্যবান কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তারা বলেন- দেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে ১০৭০ জন মারা গেছেন। অনেকে বলেছেন, করোনায় মৃত্যু নিয়ে এই গবেষণা ফলাফলে জনভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।
বিবিসি বলেছে- করোনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা তুলে ধরা হচ্ছে না। সাতাশটি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে করা এক গবেষণা রিপোর্টের আলোকে বলা হয়েছে- সারাবিশ্বে সাড়ে চার লাখ লোক করোনায় মারা গেলেও সরকারী হিসেব ছাড়াও আরো অন্তত: এক লাখ ত্রিশ হাজার মানুষ করোনায় মারা গেছেন। হাসপাতালের বাইরে করোনায় মৃত্যূগুলো নিয়ে এসব দেশ মোটেও তৎপর নয়।
মৃত্যু লুকানো রোগ প্রথম চীন থেকে শুরু হয়েছে। রাতের আঁধারে হাজার হাজার বেওয়ারিশ লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে চীনা প্রশাসন। এখন এই প্রবণতা দেশে দেশে ছড়িছে পড়েছে।
মানুষের অধিকার হরণ করে তথ্য গোপন করে অনেক দেশ। আবার তথ্য লুকিয়ে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রবণতা রয়েছে অনেক দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায়। এটাকে তারা কৌশল মনে করে। এভাবে মানুষের মনে ও মুখে কুলুপ এঁটে দেয় তারা। জনগণ জীবন হারানোর ভয়ে নিজেদের জীবন সুরক্ষা করার তথ্যগুলো প্রকাশ করতে দ্বিধা করে। এভাবে মানবতা লুকাতে লুকাতে একসময় লুটিয়ে পড়ে।
সত্য তথ্যে সুরক্ষা আসে। মানবতার কল্যাণ হয় সততার মাধ্যমে। তবুও একশ্রেণির লোভী, ক্ষমতালোভী মানুষ অসততা, মিথ্যেকে পুঁজি করে টিকে থাকার জন্য সত্যকে আড়াল করে, সততাকে ধমক দেয়। এটাই ইতিহাসের কালো দিক, বর্বর চমক। এটাই সভ্যতা ধ্বংসকারী উপাদান।
যাহোক, আমাদের দেশে যারা টেষ্ট ছাড়াই করোনা মহামারীর শিকার হয়ে মারা গেছেন তারা সরকারী খাতায় নিবন্ধিত না হলেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস অনুযায়ী মহান আল্লাহ্র হিসেবের খাতায় নিবন্ধিত হবেন। ইহকালে নানা কারণে বিড়ম্বনার শিকার হয়ে মারা গিয়ে শহীদী মর্যাদা লাভে ব্যর্থ হলেও পরবর্তী জীবনে সেখানে তারা ইসলাম ধর্মমতে শহীদী দরজা লাভ করবেন। কারণ, মহান আল্লাহ্র হিসেবের ক্ষেত্রে কোন ভুল হয় না বলে পবিত্র কোরআনে সুস্পস্ট নির্দেশনা আছে।
করোনায় মানুষ এখন প্রচন্ড রকম সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। গোটা বিশ্ব এখন চরম বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চরম পর্যায়ে চলে গেছে এই ভয়াবহ সংক্রমণ। অধিক জনসংখ্যা ও ঘন জনবসতি হওয়ার ফলে বাংলাদেশের অবস্থা বেশী নাজুক। আমাদের চলতি বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ্রে পরিমাণ পরিবর্তন করে অনেকটা বাড়ানো দরকার। সেই অর্থ দিয়ে অনেকগুলো নতুন পিসিআর ল্যাব তৈরী করে দৈনিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার রোগীর জন্য টেষ্ট সুবিধা দেয়া দরকার। এভাবে করোনা টেষ্টসংখ্যা বাড়িয়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে বিনা টেষ্টে মৃতসংখ্যা বন্ধ করা দরকার।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি যেহেতু মানুষের মৌলিক বিষয় ও মানবাধিকার সেহেতু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বা হয়নি তা জানতে পারা প্রতিটি মানুষের প্রাধিকার পাবার যোগ্য। মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিত করার জন্য করার জন্য রাষ্ট্র বদ্ধপরিকর, অন্তত: তার সংবিধানে। চিলি কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে ইতোমধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীদেরকে সরকারী তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেছে। আমাদের দেশেও যারা ইতোমধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকেও করোনায় মৃত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারী তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করা উচিত।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top