logo
news image

দাস ব্যবসায়ী-বর্ণবাদীদের মূর্তি ভাঙ্গার হিড়িক ও বোধোদয়

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছোটকালে কবিতা পড়েছিলাম-‘কলম্বাসের মত কেবা পৌঁছে যাবে নতুন দেশ’। হ্যাঁ, কবিতার চরণটিতে আমেরিকার আবিষ্কারক ইতালীর অভিযাত্রী ক্রিষ্টোফার কলম্বাসের কথাই বলা হয়েছে। কত বড় মাপের নাবিক, কত বড় জ্ঞানী-গুণী মানুষ তিনি। সেভাবেই চেনে তাঁকে সবাই, বিশেষ করে আধুনিক প্রজন্মের জন্য পাঠ্যবইয়ে সেভাবেই তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে। গোপন করা ছিল তাঁর অনেক তথ্য। সম্প্রতি মিয়ামীতে কলম্বাসের মূর্তি ভাংচুর করা হয়েছে। বোষ্টনে মূর্তির মাথা ভেঙ্গে লেকের পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। ভাস্কর কার্লো বিয়স্কির তৈরী দশ ফুট উচ্চতার ব্রোঞ্জের মূর্তিটি গ্রানাইটের বেদীতে বসানো ছিল। ১৯৩১ সালে ইতালীয় আমেরিকানরা নগর কর্তৃপক্ষকে এই মূর্তিটি উপহার দিয়েছিলেন।
স্থানীয় আদিবাসীগণ তখন থেকে এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয়দের উপর ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। যেটা স্থানীয় আদিবাসীদেরকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। তাই তারা কলম্বাসের মূর্তিকে সম্মান জানানোর ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়ে আসছিলেন। পুলিশি বর্বরতা ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের এই সময়ে দেশটিতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মূর্তি ভাঙার হিড়িক শুরু হয়েছে। একজন এ্যক্টিভিষ্ট ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি-তে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পীকার ন্যান্সী পেলোসি কংগ্রেসর প্রতি দৃষ্টি করে মার্কিন কংগ্রেস ভবন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধকালীন কনফেডারেট নেতা ও সৈন্যদের ১১টি মূর্তি সরিয়ে নেয়ার আহবান জানিয়েছেন।
এরপর বিপি-ব্যাডেন পাওয়েল। পুরো নাম রবার্ট ষ্টিফেনসন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলেওয়েল। আমি নিজে একজন স্কাউট হওয়ায় সেই ছোটকালেই এতবড় নামটি মুখস্থ করতে হয়েছিল। এরপর দু’টো বিশ্ববিদ্যালয়ে রোভার স্কাউট নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওনার বড় নামটি কতশত রোভারদেরকে শিখিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পরম শ্রদ্ধায় সারা বিশ্বে ব্যাডেন পাওয়েলকে স্মরণ করা হয়ে থাকে। হঠাৎ টিভিতে এই গুণীজনের মূর্তি অপসারণের ছবি দেখে খুব খারাপ লাগলো। এত বই পড়েছি ওনাকে নিয়ে কোথাও কোনদিন তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ সম্পর্কিত কোন লেখা চোখে পড়েনি। কেউ কোন বক্তৃতায় এমন কথা শুনিয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। জানা গেছে- তিনি বর্ণবাদীদেরকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
লন্ডনের ডকল্যান্ডস্রে জাদুঘরের বাইরে বিখ্যাত দাস ব্যবসায়ী রবার্ট মিলিগ্যানের মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। জ্যামাইকায় তাঁর ৫২৬ জন দাস ছিল। এসব দাস তাঁর সুগার প্লান্টেশনে কাজ করতো। এছাড়া তাঁর জাহাজ ও কফির ব্যবসা ছিল। ক্রেণ দিয়ে তার মূর্তি সরানোর সময় উল্লসিত জনতা হাততালি দিয়ে সমর্থন করছিল। এছাড়া বৃষ্টলে দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলষ্টনের একটি ভাস্কর্য আন্দেলনকারীরা ভেঙ্গে ফেলেছেন।
ইউরোপ আমেরিকার আন্দোলনের ঢেউ পেরিয়ে কেনিয়ার নাইরোবীতে বৃটেনের রাণী ভিকোটারিয়ার একটি মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে-কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করার পর মিনিয়াপোলিসে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা এখন সারা বিশ্বের ঐতিহাসিক বর্ণবাদ বিরোধী আন্দেলনকে জাগিয়ে দিয়ে এক কঠোর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। মিনেসোটার রাজ্য ক্যাপিটাল এর একদল লোক কলম্বাসের মূর্তিকে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে উপড়ে ফেলেছেন। এটা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষেভের বহি:প্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে।
আসলে প্রতিটি বড় বড় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় ও পরিবর্তনের অব্যবহিত পরে বিভিন্ন মূর্তি ও স্থাপনার ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। সোভিয়েত পট পরিবর্তনের সময় লেনিনের মূর্তিকে ক্রেন দিয়ে সরাতে দেখা গেছে। ইরাক যুদ্ধের পর সাদ্দাম হোসেনের মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। কত ঐতিহাসিক স্থাপনা, বালাখানা যুদ্ধের সময় আক্রোশের বশে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। প্রতিহিংসা, দ্বেষ, ক্রেজ, উন্মাদনার বলি এরকম আরো কতশত ঘটনা রয়েছে তা এখানে বলাই বাহুল্য।
এর অর্থ হলো- কেউ ক্ষমতাধর হয়ে মূর্তি ও স্থাপনা তৈরী করে, বা স্থাপনা স্থাপনকারী ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে নতুন কেউ ক্ষমতাধর হয়ে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়, গায়েব করে দেয়া হয়। এর নাম ক্ষমতার দাপট। হায়রে ক্ষমতা, হায়রে মূর্তি!
নদীর একূল ভাঙ্গে, ওকূল গড়ে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম, এটাই তো নিয়তি। এতসব জেনে শুনেও কিছু মানুষ আগ্রাসী হয়ে উঠে। সবলরা পশুর মত দুর্বলদের ওপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবলরা দুর্বলদেরকে কাজে লাগায় পশুর মত। কখনওবা দুর্বলদের দ্বারা তৈরী ও উপার্জিত সম্পদ দখল করে, জমা করে। তারা শুধু জমা করে ক্ষান্ত হয় না, পাচার করে অথবা নিরাপত্তা অনুসন্ধান করে বিদেশে স্তুপ করে রাখে- সেগুলো আবার কে চুরি করবে, কে দখল করবে বা কে ভোগ করবে তা উপলব্ধিতে আনতে পারে না। এউ উপলব্ধিহীন মানুষেরা যুগে যুগে পথহারা হয়, ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। তবুও একশ্রেণির মানুষ মূর্তি তৈরী করে তার মাধ্যমে নিজেকে জাহির করে দীর্ঘকাল বেচেঁ থাকার অপপ্রয়াস চালায়।
তারা জানে, বৃষ্টির আঘাতে পাথর ক্ষয়ে যায়, নশ্বর পৃথিবীতে ভাস্করগুলো স্থায়ী হয়না। তাদের মৃত্যুর পর পশুপাখি সেগুলো নষ্ট করে, ময়লা করে, অপমান করে। অথবা ইতিহাসের উল্টোপিঠের মত তার অপছন্দকারীরা ক্ষমতাধর হলে সেগুলোকে গলায় রশি বেঁধে রাস্তায় টেনে নিয়ে বেড়িয়ে পৈশাচিক আনন্দ করে অথবা মাথা ভেঙ্গে লেকের পানিতে ফেলে দেয়। এরকম কত ঘটনাই এই ধরাধামে হরদম ঘটে চলেছে। তবে কেন জেনেশুনে মহৎ ও গুণীজনের মূর্তি বানিয়ে এমন অনাগত অপমানকে আহব্বান করা হয়? ব্যাডেন পাওয়েলের মত একজন নীতিবান আদর্শ মানুষ যদি বলতেন শুধু নিজে অপরের অধিকার হরণ করছি না -এটাই যথেষ্ট নয় বরং সমাজে অন্য যে কেউ অপরের অধিকার হরণ করুক, এটাকেও সমর্থন দেয়া যাবে না। তাহলে আজ এই ঘটনা ঘটতো না। অথবা, তাঁর মত একজন বিশ্বনন্দিত নীতিবান মানুষের মূর্তি যদি আজ মুখ ফুটে বলতে পারতো- আমি বর্ণবাদকে আসলে সমর্থন করিনি বা করেছি তাহলে সেটা বানানোর একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেত।
কলম্বাস বা ব্যাডেন পাওয়েলের মূর্তি সরিয়ে সেই জায়গায় হয়তো এখন জর্জ ফ্লয়েডের মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে দেয়া হবে। বড় ভুল হয়েছে বলে আবার কেউ কোন একদিন সেটা অপসারিত করলেও আশ্চর্য্য হবার কিছুই থাকবে না, হয়তো প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না। দেশে দেশে বরেণ্য মানুষের মূর্তি বানানো আর মূর্তি অপসারণের অপরাজনীতি এখন নতুন কিছু নয়। তবে হেয় করার এই কৌশলটি খুব দৃষ্টিকটু মনে হয়। প্রোথিতযশা ও বরেণ্য মানুষের মূর্তি বানানো আর মূর্তি অপসারণের অপরাজনীতি না করার জন্য অনেক ঐশী নির্দেশনা ও এর অনেক অনেক ঘটনার কথা ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষী হিসেবে রয়েছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করলে এইসকল ভাঙ্গা গড়ার খেলা নিয়ে হা-হুতাশ চলতেই থাকবে বৈ কি?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top