logo
news image

আব্বা আপনাকে মনে পড়ে

নিজাম উদ্দিন স্বপন।।
আব্বা আপনি জানতেন আমি একটু পেটুক স্বভাবের,
যেখানেই দাওয়াতে যেতেন আমাকে সঙ্গে নিতেন,
শেষবার গেলাম আপনার বাইসাইকেল এর পেছনে বসে
নানার মৃত্যুর প্রায় মাস খানেক পর, সে এক এলাহী কান্ড,
কলাগাছের বাকল থেতলে তৈরী, বিশাল ওয়ান টাইম প্লেট,
এমনকি সেখানে ডাল-দুধ পর্যন্ত ম্যনুতে ছিল।
আপনি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক,
মাঝে মাঝে আপনার স্কুলে যেতাম,
ছাত্ররা আপনাকে খুব ভয় পেত, অংক স্যার বলে কথা,
শুনেছি ছাত্রাবস্থায় আপনাকে সবাই অংকের জাহাজ বলত,
কিন্তু আপনি কখনোই আমাকে একটা চড়তো দূরের কথা,
জোরে বকা দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না।
আপনার জীবনযাপন ছিল খুব সাধারন।
লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়েই স্কুলে যেতেন,
কিন্তু আপনার ব্যাগ-এ একদিন আবিষ্কার করলাম পজামা!
জানলাম স্কুল পরিদর্শক এলে আপনি লুঙ্গির উপর-ই
তাড়াহুড়ো করে পড়ে নিতেন পাজামা, মনে হলে এখনও হাঁসি পায়।
রোজার ইফতারে আপনাকে কাছে পেতাম না,
আপনার জন্য আম্মা একটু বেশি-ই ইফতার দিতেন,
রাস্তায় যাদের পেতেন তাদের নিয়ে-ই ইফতার সারতেন।
সব ভাইবোন কে কিছুটা সংসারে সাহায্য করতে হতো,
কিন্তু আমার বেলায় ছিলেন আপনি একচোখা,
আম্মাকে বলতেন সে শুধু পড়ালেখাই করবে,
সেই জন্যই মনে হয় এখনও অকর্মন্য-ই রয়ে গেছি।
আপনাকে কেউ পুলিশ-আদালত কেসের সাক্ষী মানতো না,
কারন আপনি নাকি মিথ্যে স্বাক্ষ্য দিতেই পারতেন না!
আপনার আয় ছিল সামান্য, কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তির পর
শীতে বাজারের সবচেয়ে বেশি দামের সুয়েটারটাই কিনে দিতেন,
চাহিদার চেয়েও বেশি পাঠাতেন আম্মা বারন করলেও,
কেন জানি আমার প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস,
আম্মা চাইতো ডাক্তার হই,
আপনি চাইতেন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়ে শিক্ষক হই,
বিদেশে থাকার সময় আপনি আমার সাথে কথা বলার জন্য,
জেলা শহরে এসে অন্যের টেলিফোনের কাছে বসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘন্টা,
ফোনের ওপ্রান্তে ছালাম দিলে শব্দ করে উত্তর দিতেন।
আপনি চলে যাবার কয়েকদিন আগেও,
যখন আপনি চলার শক্তি হারিয়েছেন,
আমার সাথে কথা বলতে অস্থির ছিলেন,
সবাই পাজকোলো করে আপনাকে পাশের স্কুল মাঠে নিয়ে যায়
মোবাইল নেটোয়ার্ক পাবে বলে।
আপনাকে শেষ কথা জিজ্জাস করেছিলাম খেয়েছেন কিনা?
বলেছিলেন 'জুস খেয়েছি,
কেমন আছেন বলতেই, বলে উঠলেন, ভালো আছি,
সবসময় এর মতই, ক্যন্সার আপনার শরীরকে পরাস্ত করলেও
মনকে পারেনি হারাতে, আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা,
এক আকাশ স্নেহ, এখনও আমাকে মাঝে মধ্যেই ঘুমুতে দেয় না,
বলতে পারিনি ভালোবাসি আপনাকে হাজারো সমূদ্র সম,
দেখা হয়নি আপনার শেষ বিদায় বেলায়, সে অবেলায়,
যে ছিলাম আপনার সবটুকু জুড়ে, ওই বুকের মহা সমূদ্রে।
শেষ বিদায়ের শুভ্রবসনে আপনাকে না দেখা,
আমাকে একটা উপকার করেছে, আপনাকে আমার ভেতরে রেখেছে চির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি করে, রঙীন অবয়বে ।
আপনি কি পারেন না একটি চিঠি লিখতে ওপার থেকে,
তাঁর কাছে বিশেষ অনুমতি নিয়ে, তাঁকে বলে দেবেন,
আপনার স্নেহের স্বপন, আপনার পরশের প্রতীক্ষায় প্রতিনিয়ত
স্বপ্ন দেখে যায়, আব্বা ডাকার ব্যকুলতা মনে পুষে রেখে,
নিজের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আব্বা আব্বা ডেকে অস্থির করে তুলে,
ছোট্ট ছেলেটা চোখের কোণের জল মুছে দিয়ে বলে বাবা কাঁদছ কেন?
আমি ফ্যালফ্যাল করে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকি,
অনন্ত শূন্যতার দিকে।

* ড. নিজাম উদ্দিন স্বপন, ১৬।০৫।২০২০

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top