logo
news image

ওসব ছাড়াও...

মো. আব্দুল হামিদ।।
‘সরকার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করায় লিপস্টিক কোম্পানির মালিকের আত্মহত্যা’—খবরের শিরোনামটি দেখেছেন? আমি সেটা পড়ার সময় ভাবছিলাম—আহারে, ক’দিন আগেই না ঘটা করে শেখানো হলো সৌন্দর্য কাদের যেন অধিকার! তাহলে সেই ‘অধিকার’ হরণ করার দায়ে করোনার বিরুদ্ধে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে এখনো মামলা দায়ের করা হচ্ছে না কেন?
একবার ভাবুন তো, যদি কোনো গোষ্ঠীর চাপে বা সরকারের নির্দেশে জি-বাংলা ও স্টার জলসার সিরিয়াল বন্ধ করা হতো, বিউটি পার্লারগুলো খুলতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতো কিংবা বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, মিলান ও ম্যানচেষ্টারের ফুটবল ক্লাবগুলো বন্ধ রাখা হতো অথবা এবারের অলিম্পিক গেমস স্থগিত করার ঘোষণা দেয়া হতো, তাহলে গোটা দুনিয়ায় ‘...অধিকার রক্ষা পরিষদ’গুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া এসব কর্মকাণ্ড বন্ধে ভূমিকা রাখাদের বিরুদ্ধে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত? কিন্তু হায়, আজ সংশ্লিষ্ট সবাই কষ্ট পাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলা যাচ্ছে না! কী আজব এক অবস্থা, তাই না?
ভাবছেন, হঠাৎ করে এসব ভাবনা মাথায় এল কেন? আসলে পরপর কয়েকটা নিবন্ধ বেশ সিরিয়াস প্রকৃতির হয়ে গেছে। তাই ভাবলাম জটিল কোনো বিষয়ে না গিয়ে দৈনন্দিন জীবনে ‘অপরিহার্য বলে গণ্য’ কিন্তু সেগুলো ছাড়াও দিব্যি চলে—এমন কিছু বিষয়ে আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করি। কারণ সংবাদের নিয়মিত উৎসগুলো প্রতিনিয়ত মন খারাপ হওয়ার মতো তথ্য চোখের সামনে হাজির করছে। তারপর বিশ্লেষণগুলোও যদি হতাশায় ভরপুর থাকে, তাহলে অনেকটা দমবন্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই চেষ্টা করছি ওপথে না হাঁটতে। দেখা যাক, কতটা সম্ভব হয়!
তবে হ্যাঁ, প্রথম বাক্যের শিরোনামটি কোনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার নয়। নিতান্তই মজা করে এক বন্ধু ফেক নিউজের লিংকটি পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেটা পড়ার সময় মনে হলো, সত্যিই তো, মেমসাহেবদের কতদিন হয় বিউটি পার্লারে যাওয়া হয় না। বিখ্যাত সব স্পা অ্যান্ড পার্লারে নাম না জানা ব্র্যান্ডের মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী দিয়ে (এক্ষেত্রে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী ব্যবহারে পারসোনা ও ফারজানা শাকিল’স মেকওভারকে ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা’ ভিডিওটি দ্রষ্টব্য) এক্সটেরিয়র চুনকাম করা হয় না! ম্যাজম্যাজ করা শরীরটা চাঙ্গা করা হচ্ছে না!
অনেক সাহেবেরই প্রায় ছয় সপ্তাহ হলো সেলুনে আধশোয়া হয়ে আয়েশ করে শেভ করা, চুল ছাঁটা আর সব শেষে গা-টা বানিয়ে নেয়া হয় না! স্বাভাবিক সময় হলে এটা মেনে নেয়া যেত? অসম্ভব, কিছুতেই না। আর এভাবে চলতে থাকলে কত প্রতিষ্ঠানের কর্মী-মালিকদেরই যে (আত্মহত্যা না হলেও) দেউলিয়া হওয়ার দশা হবে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
আচ্ছা, আপনি কী জানেন শুটিং বন্ধ থাকায় প্রায় দেড় মাস হলো জি-বাংলা, স্টার জলসা ও অন্যান্য হিন্দি সিরিয়ালের নতুন কোনো এপিসোড রিলিজ হচ্ছে না? রিপিট টেলিকাস্ট দেখতে দেখতে অনেকের পুরনো পর্বগুলোর দৃশ্য ও সংলাপ মুখস্থ হয়ে গেছে। অন্য সময় হলে এমন কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নির্ঘাত ঝাড়ু মিছিল শুরু হতো।
জীবনের এমন ‘অপরিহার্য উপাদান’ সরবরাহে ব্যর্থতার দায়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করলেও অবাক হতাম না। আর পরিবারের কোনো সদস্যের চাপে ওসব সিরিয়াল দেখা বন্ধ হলে তো মান-অভিমান, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, সংসার ত্যাগ, এমনকি দু-চারজনের আত্মহত্যার ঘটনাও এরই মধ্যে কানে আসত। অথচ এখন দিব্যি চলছে। আসলেই করোনা খুব দুষ্টু। কোটির ওপরে নিবেদিতপ্রাণ দর্শক (প্রিয় পাত্র-পাত্রীর মুখদর্শন ব্যতিরেকে) তীব্র মনোবেদনা ভোগ করছে, তবুও তার সামান্য করুণা হচ্ছে না!
আপনাদের হয়তো মনে আছে, কয়েক বছর আগে এমন ঈদগুলোয় ‘পাখি’ ও ‘কিরণমালা’ ড্রেস কিনে না দেয়ায় বেশ ক’টি আত্মহত্যার খবর মিডিয়ায় এসেছিল! পাখি ড্রেস কিনে না দেয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদের খবরও পড়েছিলাম। স্বাভাবিক সময়ে যদি বলা হতো—এবার ঈদে নতুন কোন পোশাক কেনা হচ্ছে না, আপনার পরিবারের সদস্যরা তো বটেই, এমনকি কাজের মেয়েটার হুংকারে বাসায় টেকা মুশকিল হতো।
কিন্তু এ বছর সরকার সদয় হলেও দোকান মালিকদের ‘অসহযোগিতায়’ বুঝি নতুন ড্রেস ছাড়াই ঈদ করতে হবে! চাল-ডাল-ওষুধের মতো অনলাইনে ঈদের ড্রেস কেনার সুযোগ না থাকাটা খুবই অন্যায়, তাই না? কয়েক লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গার ক্রেতা সোনামণি আর শখের বসে কলকাতায় শপিংয়ে যাওয়া ভাইয়া-আপুদের এবারের ঈদ যে কী নিদারুণ কষ্টে কাটবে, সমব্যথী ছাড়া তা বোঝা সত্যিই কঠিন!
নিজ প্রয়োজনে দেশের নেতৃস্থানীয় ‘আ’ আদ্যাক্ষরযুক্ত ফ্যাশন হাউজের আউটলেটগুলোয় কালেভদ্রে যেতাম। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে ঈদের মাসখানেক আগে গিয়েও আক্ষরিক অর্থেই কোণঠাসা হয়ে পড়তাম। গিজগিজ করা ভিড়ে অনেক সময় ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও মিলত না। মাঝেমধ্যে দমবন্ধ অবস্থা হতো। ফলে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম।
ভাবছি সেই ফ্যাশনসচেতন গোষ্ঠীর সদস্যরা (বিশেষত আপু ও আন্টিরা) এই শহরেই আছেন। অথচ চিরচেনা সেই পথ মাড়াতে পারছেন না। তাদের জন্য এই শোক সহ্য করা না জানি কতটা কঠিন! এমন দুর্ভাগা ঈদ যেন আর কখনো তাদের জীবনে না আসে। অবশ্য ওয়ার্ল্ড হাজব্যান্ডস অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) নাকি এই ঘটনায় করোনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে!
তবে হ্যাঁ, নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রমাণে একদম পিছিয়ে নেই বঙ্গবীরেরা। করোনা শুধু নেবে, কিছুই দেবে না, তা কেমন করে হয়? বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে নিজের ফেসবুকের হোমপেজ একটু সচেতনভাবে ঘুরে আসুন। দেখবেন উগান্ডার মানচিত্রের আদলে তৈরি জিলাপিরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা (না করে উপায় আছে, তাহলে যে সেহরি খাওয়া ছাড়াই রোজা রাখতে হবে!), কাঁচকলার সঙ্গে আদার অতুলনীয় স্বাদের রেসিপি, রুটি সেঁকার প্রশিক্ষণ পর্ব, বুয়ার চেয়েও উত্তম ঘর মোছার দক্ষতা প্রদর্শনে তা সয়লাব।
আরো আছে। করোনা না এলে জাতি জানতেই পারত না যে বাংলার ঘরে ঘরে কত্তো ভালো সব ‘নাপিত’ রয়েছে! একপর্যায়ে আমার সন্দেহ হলো—কার বউ কত ভালো চুল কাটতে পারে তার বুঝি (অনলাইন) রিয়েলিটি শো চলছে। কারণ শুধু ছবি দিয়ে অনেকেরই মন ভরছে না, ভিডিওসহ হাজির হচ্ছেন! আর যারা বেলতলা যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বে জাতিকে জানান দিয়েছেন, তাদের কথা না হয় না-ই বললাম।
কতদিন হয়ে গেল বেরসিক পুলিশের জন্য দুনিয়ার জটিল সব বিষয় সমাধান করা যাচ্ছে না। বাঙালি গলির মোড়ে চায়ের দোকানে বসতে না পারলে চীনই যে গোটা দুনিয়ায় ছড়ি ঘোরানোর জন্য নভেল করোনাভাইরাস ছেড়েছে, সুলতান সুলেমানের মতো মৃত্যুর পর কে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা বোঝার জন্যই কিম জন উন কয়েক দিন মরার ভান করে পড়েছিলেন, বরিস জনসন ভুল পলিসি গ্রহণের দায়ে ইমপিচমেন্টের হাত থেকে বাঁচতেই আইসিইউতে শুয়েছিলেন, ট্রাম্প যে ইনজেকশন প্রস্তাব করেছে, তা অন্তত ট্রায়াল হওয়া দরকার ছিল...এমন বিষয়গুলো সুরাহা হবে কেমনে?
তাছাড়া সিরিয়ার তিন বছরের মেয়েটা যে মৃত্যুর আগে ‘আল্লাহকে সব বলে দেয়া’র কথা ঘোষণা করেছিল, তার অভিযোগের ভিত্তিতে নাকি সাত মাস লকডাউনে থাকা কাশ্মীরি তরুণীর প্রার্থনায় (সৃষ্টিকর্তা যেন বিশ্ববাসীকে লকডাউন করে বোঝান যে তারা কতটা কষ্টে আছে) করোনা ধরাধামে এসেছে...মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এ বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও চায়ের কাপে ঝড় ওঠা অতীব জরুরি! কিন্তু পাষাণ করোনা ‘গরিবের এই পার্লামেন্ট’ বন্ধ করে দিয়ে আমাদের যে কত বড় ক্ষতি করছে, সে কি তা জানে?
প্রায় দুই মাস হলো তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া শিশুটার প্রাইভেট ও কোচিং দুটোই মিস হচ্ছে। তার বুঝি ‘আইনস্টাইন’ কিংবা নিদেনপক্ষে ‘বিদ্যাসাগর’ হওয়া এবার আটকেই গেল! গর্ভধারিণী মা হয়ে সেটা সহ্য করবেন কী করে? তাই তো অনেকেই তোড়জোড় করছেন বাউবির দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে হলেও প্রাইভেট টিউশনটা চালু রাখতে। নইলে অন্য শিশুরা এগিয়ে যাবে, আপনার সন্তানের কী হবে?
কিন্তু প্রাইভেট টিউটররা নাকি ইদানীং বড় কঞ্জুস হয়ে গেছেন। তাদের ওয়ান টু ওয়ান ট্রিটমেন্ট আর এমবি খরচ দিয়ে নাকি পোষাচ্ছে না! আর সেটা সম্ভব হবেই-বা কী করে? তারা তো ভেড়ার পালের মতো দলবদ্ধভাবে জ্ঞান বিতরণে অভ্যস্ত। অতি চালাক অভিভাবকরা নাকি সেটা ধরতে পেরে পুরো ব্যাচের পয়সা একাই খসাতে রাজি হচ্ছেন, সঙ্গে ইন্টারনেট খরচও...তবু করোনাকে বুঝিয়ে দেবেন—সন্তানকে বিদ্যাসাগর বানানোর মিশনে কোনো রকম ছাড় নয়!
করোনা-পূর্ববর্তী জীবনে যে ডাক্তাররা নিজের শরীর ও মনের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ নিয়ে হলেও গভীর রাত পর্যন্ত চেম্বার করতেন, তাদের জন্য বড় মায়া লাগত। তাদেরই-বা কী দোষ? প্রতিদিন নগদ টাকার ‘গন্ধ শোঁকা’র অভ্যাসটা কি হঠাৎ করেই ছাড়া যায়? হাইস্কুল-কলেজের যে স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ানো ছিল আফিমের নেশার মতো, তারাও যে খুব কষ্টে করোনাকাল অতিবাহিত করছেন, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। ঠিক তেমনিভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক স্যার-ম্যাডাম দিনে দু-তিনটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধূলি না দিলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর না হলেও নিজেদের দম বন্ধের উপক্রম হতো! হূদয়হীন করোনা তাদেরও ঘরে আটকে রেখেছে।
ফাস্টফুড অ্যাডিক্টদের কতদিন হয় প্রিয় বার্গার, পিৎজা, স্যান্ডউইচ, ফ্রায়েড চিকেন বা চিকেন নাগেট খাওয়া হয় না। ফুচকা, চটপটি কিংবা আচার খাওয়ার জন্য অনেকেরই জিহ্বার পানি ঠেকিয়ে রাখা মুশকিল হচ্ছে। অনেকদিন হলো তুচ্ছ অজুহাতে দলবেঁধে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া হয় না। কতদিন হয় চাইনিজ, থাই, কন্টিনেন্টাল ডিশগুলো আপনার সাক্ষাত্বঞ্চিত।
কতজন নতুন চাকরি, পদোন্নতি কিংবা জন্মদিনের ট্রিট না দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। যেনতেন অজুহাতে পার্টি থ্রো করা যাচ্ছে না। করোনা ভয়ে অধিকাংশই অতি পছন্দের আইসক্রিমের ধারেকাছেও ঘেঁষছে না। আর যে শীতল পানীয় ছাড়া চলতই না, সে ব্যাপারেও পরিস্থিতি তাদের সংযমী হতে বাধ্য করছে। এ তো শুধু মহামারী নয়, ডাকাতের মতো সবাইকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে!
পূর্ববর্তী রমজানগুলোয় পোড়া মবিল দিয়ে ভাজা জিলাপি, শতবার পুড়ে আলকাতরা রূপধারী তেলে ভাজা পেঁয়াজু, আলুর চপ আর বেগুনি ছাড়া ইফতারির কথা ভাবা যেত? প্রশ্নই ওঠে না। পুরান ঢাকার ইফতারি বাজারের কথা স্মৃতি থেকে এত সহজে বিদায় নেয়ার কথা না। সারা দিন রোজা রেখে শরীরের যেটুকু উপকার হতো, ইফতারির সময় তার বারোটা বাজাতে আমরা ছিলাম বদ্ধপরিকর।
অথচ কড়াকড়ি লকডাউনের কারণে (রোজার শুরুর দিকে) এগুলো ছাড়াই বেশ চলছিল! যেই না ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট’ বিবেচনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একটু শিথিলতা প্রদর্শন করেছে, আর যাবে কোথায়? বীর বাঙালি করোনা ভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনপূর্বক আসরের নামাজের আগেই প্রতিদিন নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে!
রাজশাহী বাটার মোড়ে জিলাপি ক্রেতাদের দীর্ঘ সারি দেখে ভাবছিলাম—ওই সময়ে ত্রাণের জন্যও কি এত মানুষ ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত? আসলে দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা কিনি, তার কত ভাগ জীবনধারণের জন্য সত্যিই দরকারি? মার্কেটিং বিশারদরা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে মানুষ দরকারে জিনিস কেনে না। তারা কেনে যে জিনিসগুলো ‘তাদের দরকার বলে বিশ্বাস করানো হয়!’ তার প্রমাণ চান? আজকেই সব দোকানপাট খুলে যাক। দেখবেন হাজার হাজার মানুষের লেস, ফিতা, চুরি, ইমিটেশন গহনা ছাড়া চলছেই না! ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁকের কবিরাজ পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই একথা সমভাবে প্রযোজ্য।
কখনো ভেবেছেন, বস্তি বা ফুটপাতে রাত্রিযাপন করা মানুষটিও কিন্তু আপনারই মতো? বিশ্বাস হয় না? জন্মের সময় আপনার শরীরে কি তার চেয়ে একটা হাড়ও বেশি ছিল? নাকি তার রক্ত লাল আর আপনারটা নীল ছিল? অথচ আপনার বাসায় থাকা ৯৫ পারসেন্ট জিনিস না থাকার পরেও সে আপনার মতোই মাঝেমধ্যে চরমমাত্রায় পুলকিত হয়, কখনো কষ্ট পায়।
আসলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকলেই আপনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সুখের অধিকারী হবেন, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। একবার ভাবুন, ছাত্রজীবনে টাকা-পয়সা তেমন ছিল না, হল বা মেসে একটা মাত্র বেডের কর্ণধার ছিলেন। ডাইনিংয়ের সেই খাবার, পায়ে হেঁটে ক্লাসে যাওয়া, ৫ টাকার বাদাম কিনে ছয়জনে ভাগ করে খাওয়া...তার পরও জীবনটা কত সুন্দর ছিল, তাই না?
মন খুলে হাসতে পারতেন, ইচ্ছে হলেই বেসুরো গলায় গেয়ে উঠতেন, পকেটে পয়সা নেই, তাতে কী? নিউমার্কেটে ঝকঝকে তকতকে জিনিসগুলো দেখেই মনটা ভরে যেত। আজ আপনার বিশাল বাসা, দামি ফার্নিচার, আমদানি করা কার্পেট ও ঝাড়বাতি, প্লাজমা টিভি, ব্র্যান্ডেড গাড়ি, আরো কত কী...কিন্তু তখন মনের গভীরে সর্বদা যে ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করত, আজ কোথায় যেন সেটা হারিয়ে গেছে!
তখন দাওয়াত ছাড়াই বিয়ের অনুষ্ঠানে খেতে বসতেন। আর এখন? খুব কাছের মানুষদের দাওয়াতও এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন। সুখ-দুঃখের একান্ত অনুভূতিগুলো শেয়ার করার মতো মানুষের অভাব আপনার লক্ষ-কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স কি পুষিয়ে দিতে পারছে? তাই শুধু সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে যারা সুখী হতে চান, করোনা তাদের জন্য বড় এক শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শিক্ষা নেবেন কিনা, তা নিতান্তই আপনার ব্যাপার। তবে বোধোদয়ের এমন সুযোগ ইহজীবনে দ্বিতীয়বার না-ও আসতে পারে।
যারা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলেও থরো চেকআপের অজুহাতে সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড যেতেন, যারা মাতৃভূমে তারকা খ্যাতি, লাখো ভক্তের ভালোবাসা দু’পায়ে দলে এ দেশ তাদের সন্তানদের ‘বসবাসের উপযোগী নয়’ ভেবে বউ বা জামাই কোটায় স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যারা দেশের টাকা পাচার করে দুনিয়ার স্বর্গে পা রেখে চরম স্বস্তি বোধ করেছিলেন, তারাও আজ অসহায়, বড় বিপন্ন বোধ করছেন।
স্বদেশের চেয়ে স্বপ্নের দেশে অধিক মৃত্যুহার তাদের বিচলিত করছে। অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতার প্রভাব কোনো কিছুই যেন আজ তাদের সাহায্য করতে পারছে না! সেকেন্ড হোমের পাসপোর্ট থাকার পরেও নির্মম বাস্তবতা তাদের সেসব দেশে ঢুকতে অ্যালাউ করছে না। তাই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর জন্য করোনা সত্যিকার অর্থেই এক ‘ওয়েকআপ কল’ দিচ্ছে।
যদি তা শুনতে পান, তবে নিজ জন্মস্থানের দিকে তাকান। যেখানে আপনার নাড়ি পোঁতা রয়েছে, স্মৃতিময় শৈশব কেটেছে। করোনায় মৃত্যু হলেও অন্তত কিছু মানুষ সেখানে আপনার জন্য চোখের জল ফেলবে। আপনার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করবে। কিন্তু এই নগরে উচ্চপদ, বিস্তৃত ব্যবসা, ঝাঁ-চকচকে গাড়ি, বহুতল ভবন, কংক্রিটের রাস্তা...এগুলো কাউকে চেনে না। সাততলা বাড়ির মালিক (করোনা আক্রান্ত হয়ে) সিঁড়িতে পড়েছিলেন—একটু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি! বাসার ভেতরে বউ-সন্তান, আশপাশের ফ্ল্যাটে বন্ধু-পরিজন অথচ তিনি একা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, দৃশ্যটা কল্পনা করা যায়? ভাগ্যিস, কিছু স্বেচ্ছাসেবক মানবিকতা দেখিয়ে মরদেহটা সৎকার করেছেন।
অথচ এর সিকি ভাগ পয়সা খরচ করেও যদি আপনি গ্রামে (বা নিজ এলাকায়) একটা কিছু করেন, ছিমছাম বাড়ি, ফুল-ফলের বাগান, পুকুর কিংবা দীঘি খনন করেন, সামর্থ্যের মধ্যে এলাকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, সুখে-দুখে তাদের পাশে দাঁড়ান, তবে দুঃসময়ে সেখানে ফেরার জন্য কোনো ভিসা লাগবে না! যেকোনো পরিস্থিতিতে সেখানকার প্রকৃতি ও মানুষ মায়ের মতোই আপন করে কাছে টেনে নেবে। বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো ‘অক্সিজেন ব্যাংক’ দুনিয়ায় আর কোথায় পাবেন, বলুন তো?
এবারের ঈদে দেশ-বিদেশে শপিং কিংবা বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়া হচ্ছে না, সেটা নিশ্চিত। তাই এ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থ আপনার পরিচিত গরিব-অসহায় মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে অন্য রকম এক ‘ঈদ উদযাপন’ করা যায় না? এতদিন তো শুধু নিজের সুখের কথা ভেবেছেন। অন্তত একটা ঈদে সুবিধাবঞ্চিত, অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান। কোনো রকম ফটোসেশন ছাড়াই তাদের হাতে তুলে দিন ঈদসামগ্রী ও কিছু অর্থ।
দেখবেন পৃথিবীতে এখনো অকৃত্রিম ভালোবাসা বেঁচে আছে, যা এতদিন চাকচিক্যময় পরিবেশ আমাকে-আপনাকে উপলব্ধি করতে দেয়নি। কিন্তু এবার ঘরবন্দি অবস্থায় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার যথেষ্ট সময় পেলাম। কল্পনা করুন ‘আপনি করোনায় আক্রান্ত’—শুধু এ তথ্যটা জানার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের মানুষের আচরণ কেমন হবে।
দেখবেন সবকিছু নিতান্তই অর্থহীন মনে হবে। আপনার প্রিয় মানুষগুলোকেও মুহূর্তেই বড় অচেনা লাগবে। অথচ তাদের সুখের জন্য এতদিন নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত পাননি! অর্থ-সম্পদের পাহাড়, ক্ষমতার দাপট, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবকিছুকে বোঝা মনে হতে শুরু করবে। প্রিয় সিরিয়াল, স্পোর্টস বা ফিল্মস্টার, বিউটি বা জেন্টস পার্লার, নতুন ড্রেস, খাসা জিলাপি—কোনো কিছুই আর আপনাকে আকর্ষণ করবে না। কারণ ওসব ছাড়াও জীবন অনেক সুন্দর। আরো কিছুটা সময় মুক্ত বাতাসে দম নেয়াকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ও আরাধ্য বস্তু বলে অনুভূত হবে।
তাই আপনার চেনাজানা অন্তত একটি (সম্ভব হলে আরো বেশি) পরিবারের ঈদ উদযাপনের ভার আপনি নীরবে বহন করুন, দেখবেন অকৃত্রিম, অনাবিল এক স্বর্গসুখ আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, অর্থ গোবরের মতো। এক জায়গায় জমা থাকলে তা দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। কিন্তু তা ছড়িয়ে দিলে চারপাশটা উর্বর হয়। এবারের ঈদ আপনার সামনে সেই এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে। দেয়ার আনন্দ উপভোগ থেকে নিজেকে আর বঞ্চিত করবেন না, প্লিজ। আঁধার পেরিয়ে, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে আমরা আরো মানবিক হব—আপাতত এটাই প্রত্যাশা।

* মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top