বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস ও শুণ্য সীমারেখায় সাংবাদিক
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
অবশেষে পাওয়া গেছে সাংবাদিক কাজলকে। অপহরণের সাত সপ্তাহ পর ফটো সাংবাদিক ও দৈনিক পক্ষকাল সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলকে যশোরের বেনাপোল থানার সাদিপুর সীমান্তের শুণ্য সীমারেখায় ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে বিজিবি কর্তৃক আটক দেখিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত ১০ মার্চ তাঁর অফিস থেকে বের হবার পর সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে তাঁকে। তাঁর আশেপাশে অপরিচিত লোক ছিল। এতদিন উধাও থাকা কাজল হঠাৎ পাসপোর্ট ছাড়া ভারত থেকে ফিরতে চাইলেন কেন? একটি পত্রিকায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছে-‘সাংবাদিক কাজল যখন পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া ভারতে গিয়েছিলেন তখন কি সবাই আইসোলেশনে ছিলেন?’
নিজ দেশে কেউ কি কখনো অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে? অপ্রিয় হলেও সত্য, এতে ‘মুক্ত সাংবাদিকতা দিবসে সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিচ্ছবিকে নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’
সাংবাদিকতাকে সীমারেখায় বাঁধা যায় না। সত্য-মিথ্যা যাই ঘটুক যা আসল তাই তাঁরা লিখবেন। নিজের প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার কোনরূপ সীমাবদ্ধতা থাকলে সেটা অপরাপর সবার জানার কথা। এছাড়া তাঁদের লেখনীর মধ্যে সীমা বলে কিছু নেই। কিন্তু আজকাল কথায় কথায় তাঁদেরকে নির্দিষ্ট সীমা বলে দেয়া হয়, সন্ত্রাসী, অপরাধী সাজানো হয়। নির্যাতন করা হয়। স্বার্থান্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর স্বার্থের মধ্যে একটু টান পড়লেই নেমে আসে খড়গ, বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা।
কিছুদিন আগে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান কুড়িগ্রামের মত সীমান্ত জেলাশহর তথা মফস্বলে বসে বাংলা ট্রিবিউনে সাংবাদিকতা করে জাতীয় মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছেন। টিভিতে করোনার খবরকে পিছনে ফেলে গভীর রাতে ওঁর নিজ বাসায় হানা দেয়া ও নির্যাতন করে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে সরকারী অফিসে ও ভোরে কারাগারে প্রেরণ করার পরের ঘটনাগুলোর চমকপ্রদ তথ্য সকল চ্যানেলে সাড়ম্বরে প্রচারিত হয়েছে। খবরটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল ফটো সাংবাদিক শহীদুল আলমকে ডিবি কর্তৃক তুলে নেয়ার কথা।
মাত্র একদিন আগে চীনের উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতনের ওপর ভাইরাল হওয়া একটি জঘন্য ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হঠাৎ চোখে পড়েছিল। শত শত নিরীহ, নিরস্ত্র মুসলিম যুবককে সশস্র বাহিনীর সদস্যরা পিছনে হাত বেঁধে বুটের লাথি, বন্দুকের বাটের গুঁতো ও মেরুদন্ডে বড় সূঁচ জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে দিয়ে অবশ করিয়ে একটি ঘরের মেঝেতে সবাইকে গাদাগাদি করে ঠেশ দিয়ে রেখেছে। সবার রক্তাক্ত দেহ নিথর, কোন সাড়া শব্দ নেই। এমন ভয়াবহ ও করুণ নির্যাতনের দৃশ্য দেখার পর কার মনটা ঘৃণা ও ধিক্কারে বিষিয়ে না উঠে!
মনে হচ্ছিল, কিসের আধুনিক মানব সভ্যতা? কিসের সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠান? কিসের কল্যাণরাষ্ট্র হবার স্বপ্ন? যুগ যত আধুনিক হচ্ছে মানুষের উপর মানুষে নিপীড়ন নির্যাতনের মাত্রা ও ভয়াবহতাও যেন তত বেড়ে চলেছে। সাথী হয়েছে শিক্ষিত নামধারী দায়িত্বশীল কিছু মানুষের অনৈতিক কাজ। যেগুলোকে আজকাল সাজানো নিগ্রহের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করা বলা হয়ে থাকে। মধ্যযুগের বর্বরতা সভ্যযুগে এসেও করা হচ্ছে কেন, কার ইশারায়?
বৃটিশরা বহুদিন পূর্বে এখান থেকে চলে গেলেও তাদের অনেক বর্বর আইন এই ভূমিতে আজও কার্যকর আছে। আমাদের মগজে থাকা তাদের কালা কানুন আজও মামদো ভুত হয়ে তাড়া করে বেড়ায়। তাইতো আমাদের দেশে জনসেবকগণ নিজেদেরকে মুখে জনসেবক ও জনগণের বন্ধু হিসেবে প্রতীয়মান করার চেষ্টা করলেও কার্যত: এখনও বন্ধু হতে পারেননি। এ দেশে জনসেবার জন্য দায়িত্ববানরা নিজেদের কাজ ও দায়িত্বকে বিশেষ ক্ষমতা মনে করেন। গণতন্ত্রের কথা বেমালুম ভুলে যান। তাইতো ক্ষমতা ফলাতে গিয়ে জন-নির্যাতনের ঘটনা বার বার তৈরী করে ফেলেন। আজকাল সভ্য দুনিয়ায় কোথাও প্রাচীন ধারণার আমলাতন্ত্র না থাকলেও আমাদের দেশে সেই ছায়া বলবৎ রয়েছে। দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতির সাথে পেশাদারী রাজনীতির যোগসূত্র থাকায় অনেক সময় দিনকে রাত করার ঘটনাও খুব সহজে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের হাতিয়ার হবার ফলে অপরাধ করেও পার পেয়ে যান। এজন্য মাঠ পর্যায়ের একজন জুনিয়র সরকারী কর্মকর্তাকেও প্রায় কোটি টাকা দামী বিলাসী গাড়ি দিয়ে খুশি রাখতে হয়। গাড়ি মেইন্ট্যানেন্সের জন্য প্রায় বেতনের সমপরিমান অর্থ ভাতা হিসেবে যোগান দিতে হয়। মোট জনসংখ্যার কতভাগ আমরা সরকারী চাকুরী করি-তা শিক্ষিতজনেরা নিশ্চয়ই ওয়াকেবহাল আছেন। আমাদের মত চল্লিশ ভাগ উচ্চ শিক্ষিত বেকারের দেশে সেটা নিতান্ত দৃষ্টিকটু মনে হলেও তাতে কার কিবা যায় আসে? অনেক প্রশাসক তো সচরাচর সেবক হতে দ্বিধা করেন।
সংবাদে জানা গেছে, সাংবাদিক রিগ্যানের মামা বলেছেন- ‘‘মদ-গাঁজা দূরে থাক, কোনদিন তাকে সিগারেটেও টান দিতে দেখিনি।’’ সে মাদকাসক্ত নয়। তাই যদি হয় তাহলে তার বাসায় হঠাৎ ৪৫০ গ্রাম মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা আসলো কীভাবে? ওসব জড় পদার্থের তো হাত-পা নেই। কোনভাবে কেউ সেখানে এনেছে। এসব মাদকের উপস্থিতি কীভাবে হলো-সেটা আশু তদন্ত করে বের করা দরকার। একইভাবে সাংবাদিক কাজল পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া ভারতে কীভাবে ঢুকেছিল, বাংলাদেশ সীমানায় রাতের আঁধারে কিভাবে এসেছিল- এগুলোরও যথাযথ তদন্ত করা দরকার।
আমাদের দেশে সাজানো নিগ্রহ করার অনেক উদাহরণ আছে। নিরীহ মানুষকে ফাঁসানোর জন্য মদ-গাঁজা, ইয়াবা, হেরাইন গোপনে ভিকটিমের ডেরায় রেখে দিয়ে জোর করে ছবি তুলে মামলা করার ঘৃণ্য অনেক ঘটনা উন্মোচিত হয়ে প্রচারিত হয়েছে। অনেক ভালমানুষও এসব অনৈতিকতা ও অন্যায়কে কর্ম-কৌশল বলেন। এসকল জঘন্য কর্ম-কৌশল ও ন্যাক্কারজনক বিষয়কে পাপকাজ মনে করেন না। ঘুষের অর্থ পকেটে পুরে নিয়ে পুনরায় অজু করে। মদ খাওয়া হারাম। বড় বড় গোঁফের মধ্যে পানি লেগে গেলে সেটা খাওয়া হারাম। তাই বড় গোঁফ উঁচু করে তুলে ধরে মদ পান করে। যাতে গোঁফের মধ্যে মদ স্পর্শ না করে। হারাম-হালাল বা ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করার দিব্যজ্ঞান তাদের মধ্যে ততটুকুই বিদ্যমান। আমাদের সমাজে, প্রশাসনে, বিশ্বাসে এ ধরনের নড়বড়ে ঈমানদার মানুষের অভাব নেই। অথচ, তারা নিজেকে পাকা ঈমানদার মনে করে নিয়মিত মসজিদে যায়। এসব ভন্ড, প্রতারকদের জন্য বিশ্বের এই আপদকালীন মুহূর্তে খারাপ কিছুর অভিশাপ দেয়াকে অনেকে শ্রেয় মনে করতে পারেন।
বলা হয়ে থাকে- ‘যে যতটুকু জলে নামে সে ততটুকু ভিজে।’ সে হিসেবে-‘যে অন্যকে জ¦ালায় সেও জ¦লে’। কোন মানুষ বা সাংবাদিক যদি কাউকে অন্যায়ভাবে জ্বালিয়ে থাকেন তবে তারও শাস্তি হওয়া উচিত। অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন লেখার জন্য তিনি কোন ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা করে থাকলে তা প্রতিকারের জন্যে নির্দিষ্ট আইনী নিয়ম কাুনন রয়েছে। এজন্য অসভ্য, বর্বরতা অনুসরণ করে বিচারের আগেই তার উপর নির্মম নির্যাতন চালানোর অধিকার কারো নেই।
এখন যারা দিনকে রাত ও রাতকে দিন বানানোর জন্যে বিশেষ ক্ষমতাবান হয়ে কৌশলে মুখে সবকিছুকে পাল্টিয়ে দিচ্ছেন একটা সময় তাদের ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। সত্য, ন্যায় ও নৈতিকতার চর্চ্চা মানুষকে সেটাই শেখায়, সেটাই অনুশীলন করতে বলে, যুগে যুগে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বস্তরে শুধু সত্যের অনুশীলনই পারে কোন দেশে একটি টেকসই উন্নয়নের আবহ সৃষ্টি করতে।
আর এই আবহ সৃষ্টির কাজটা বর্তায় একদল স্বাধীনচেতা অকুতোভয় সাংবাদিকের দৃঢ় মনোবলের ওপর। বিচ্ছিন্ন না থেকে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হবার সময় এখন।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য