logo
news image

শুধুই মৃত্যু: ফেরার পথও আছে

মুস্তফা মনওয়ার সুজন।।
মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ভাঙার গল্প নিয়ে রচিত আর্থার মিলারের 'ডেথ অফ এ সেলসম্যান' নাটকটি। আমেরিকান এক সেলসম্যান সারাজীবন স্বপ্ন দেখেন পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও ঋণমুক্ত জীবনের; সে স্বপ্ন শেষ হয় নিজের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। সন্তানের স্বপ্ন পূরণেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় পিতার অক্ষমতা; আর মরনের মধ্য দিয়েই পিতা সন্তানদের জন্য সর্বশেষ চেষ্টার চিহ্ন রেখে যায়। একটি মৃত্যুর সাথে হাজারো স্বপ্নের বাঁচা-মরার গল্পের স্মৃতিস্তম্ভ 'ডেথ অফ এ সেলসম্যান'।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকান মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প বলার আমার মোটেও কোনো ইচ্ছা নেই। তবে সে সময়কার নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়া টালমাটাল বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা  নাটকের অনেক দৃশ্যই ভেসে আসছে বর্তমান বিশ্ব বিপর্যয় মুহূর্তে। মধ্যবিত্তের চেহারা মলিন থেকে মলিন; ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে ক্রমশ তামাটে হয়ে উঠছে। আগের গ্রাম ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হয়ে উঠছে শহরমুখী কারখানা নির্ভর। বিরাজমান করোনাকালের আগেই তীব্র পুঁজির দাপটে ধনীরা যতো দ্রুত ধনীতর হচ্ছে, তত দ্রুতই নেমে যাচ্ছিলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনপ্রবাহ।এরই মধ্যে সমাগত করোনাকাল।
পৃথিবীজুড়ে বৈষম্যের নিষ্ঠুরতম বাস্তবতায় শুরু হয়েছে জীবন-মৃত্যুর খেলা। আর তিলে তিলে নয়, জ্যামিতিক হারেই সাধারণ মানুষের নির্মম পরিণতির চিত্র স্ফূট হয়ে উঠছে।
সারা দেশের পরিস্থিতি এখনো টের পাওয়া না গেলেও, রাজধানী ঢাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন গভীর সংকটে পড়েছে। একমাসের বেশি সময়েই ঘরবন্দি নিম্ন আয়ের মানুষদের অবস্থা করুণ আকার ধারণ করেছে। নিম্ন আয়ের মানুষের অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠলেও, অন্তরালে রয়েছে নগরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের করুণ হাল। তারা বলতেও পারছেন না, আবার সইতেও পারছেন না। মধ্যবিত্তদের মুখে ঝুলছে তালা। এ মুহূর্তে বাড়ি ভাড়াসহ অনেকের ঋণ পরিশোধের বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরেদের অনেকে বেতন পাচ্ছেন না৷ সঞ্চিত অর্থ শেষের পথে, রয়েছে চাকরি হারানোর শঙ্কা৷ সরকারের কোনো প্রণোদনার মধ্যে তারা নেই৷ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি'র সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার আছে৷ এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ৷ মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত৷ এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে৷ এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ ছাড়া সবাই সঙ্কটে পড়েছে৷ আর এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছেন৷
 অনেকেরই বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে৷ ফলে তারা বেতন তো পাননি, উল্টো চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে দিন গুনছেন। এরা সরকারি কোন কর্মসূচির মধ্যেও নেই৷ তবে সরকার এসএমই ঋণ দিয়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে৷ তবে এই সংখ্যাও খুব বেশি না৷ বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও সহায়তার বাইরে৷
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআই'র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মধ্যবিত্তের কিছু সঞ্চয় থাকে৷ লকডাউনে তারা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে৷ এভাবে আরেক মাস চললে তাদের সেই সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে৷ বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত এরই মধ্যে নিম্নবিত্তে পরিণত হবে৷ সবচেয়ে বড় সঙ্কট হবে যখন সবকিছু স্বাভাবিক হবে, তখন বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারাবে৷
উন্নত দেশে তো বেকার ভাতা দেয়া হয়৷ বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা নেই৷ তাহলে এই মধ্যবিত্ত বেকার শ্রেণী কি করবে। সরকারের যে প্রণোদনা সেখানেও মধ্যবিত্তের কোনো অবস্থান নেই৷ বাস্তবতা হলো- বাংলাদেশে মধ্যবিত্তরা অভূতপূর্ব সঙ্কটেই পড়লো৷ সিপিডি'র মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই কারণেই আমরা নগদ প্রণোদনার কথা বলেছিলাম৷ আমাদের দেশে ছয় কোটি ১০ লাখ শ্রমিক রয়েছে৷ এর মধ্যে এক কোটি শ্রমিক দিন আনে দিন খায়৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান যারা করেন, তাদের সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ৷
আমরা সরকারকে বলেছি, একটি পরিবারে চারজন আছেন এমন একটি পরিবারকে মাসে আট হাজার টাকা হিসেবে দুই মাসের ১৬ হাজার টাকা দিতে৷ তাতে সরকারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যা জিডিপির এক শতাংশ৷ এভাবেই এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা যেতে পারে৷
করোনা দুর্যোগ যতো দীর্ঘ হচ্ছে সমাজে তত কমছে মধ্যবিত্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাব বলছে, এই অবস্থা চললে দুই মাসের মধ্যে অনেক মধ্যবিত্ত যোগ হবে দরিদ্রের তালিকায়। অসহায় মধ্যবিত্তকে সহযোগিতা করছে অনেকে।প্রতিদিন এমন কয়েকশ ফোন আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীদের নম্বরে। পরিচয় গোপন রেখে ঢাকার নানা প্রান্তে বাসার দরজায় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন তারা।
কালের এমন দুর্যোগে নানা শ্রেণী পেশার অনেকেই দাঁড়াচ্ছেন মানুষের পাশে।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে করোনা আসার পর প্রতি সপ্তাহে ক্রয় ক্ষমতা হরাচ্ছে ১ শতাংশ মানুষ। আর ২০ শতাংশ মানুষ এখন রয়েছে দারিদ্রসীমার নিচে। বলা হচ্ছে এ অবস্থা চললে, আগামী জুন নাগাদ এই হার পৌঁছবে ৩০ শতাংশে যার মধ্যে থাকবে এখনকার অনেক মধ্যবিত্ত।  
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস’র জুন ২০১৯ সালের হিসেব মতে, জুন মাসের শেষে দেশের দারিদ্র্য হার সাড়ে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের জুন মাস শেষে এই হার ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত জুন শেষে অতি দারিদ্র্য হার নেমেছে সাড়ে ১০ শতাংশে। এক বছর আগে এর হার ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। বিবিএস আরও বলছে, গত ১০ বছরে প্রায় এক কোটি মানুষ হতদরিদ্র অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
সরকারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ। ২০১৯ সালের জুন মাস শেষে অতি গরিব বা হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখের কিছু বেশি। বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি ৪৬ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে সব মিলিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া তিন কোটি মানুষ।
করোনা দুর্যোগে বিদ্যমান সামাজিক-অর্থনৈতিক সব হিসেব তছনছ করে দিয়েছে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী করোনা সঙ্কটকে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘসহ  বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর তাদেরই প্রকাশিত  বিশ্লেষণে উঠে আসছে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির দুর্দশার করুণ চিত্র।
বাংলাদেশসহ অগ্রসরমান অনেক দেশ দুনিয়ার ধনী দেশগুলোর নিম্ন শ্রেণীর সহায়ক কর্মশক্তি হিসেবে কাজ করে রেমিট্যান্স, গার্মেন্ট, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা খাত থেকে আয় করে আসছিল। বৈষম্য ভিত্তিক সেই অর্থনৈতিক ইকো সিস্টেমও করোনা মহামারি এলোমেলো করে দিয়েছে। যার প্রথম ধাক্কা এসে পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। তারপর হয়তো ধেয়ে আসছে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সুনামী।
করোনাের অতল সঙ্কট দেশকে কতোকালের পেছনে নিয়ে যায়, তার হিসেব হয়তো এখনই মেলানো কঠিন। আর সমূহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য সুনামীতে বিলীন দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা ভবিষ্যতে হয়তো ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের গবেষণার উপকরণ হবে।
তবে, শুধু হতাশাই নয়, এই মহাসঙ্কটকাল নতুন করে ভাবনারও সময়।বাংলাদেশে একাত্তর পরবর্তী সময় অনুসরণে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে টিকে থাকতে দেশের খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভাবার তাগিদ অনুভব করতে হবে। মধ্যবিত্তের তরী এখনো ডুবিডুবি।
নতুন পরিকল্পনা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিখাতসহ সরকারের বহুমুখী উন্নয়নে সৃজনশীল অদম্য এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর বাইরে তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই, শুধুই মৃত্যু; ফেরার উপায় নেই।
* মুস্তফা মনওয়ার সুজন: সাংবাদিক ও লেখক।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top