logo
news image

বন্যপ্রাণি সদরে-মানুষ অন্দরে

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
এমন একটা অসহায় পৃথিবীর কথা কেউ কি আগে ভেবেছেন? শহরের রাজপথে গাড়ি নেই, মার্কেটে মানুষ নেই। বন্দরে ক্রেনের শব্দ নেই, রেলপথে ঘড় ঘড় করে যন্ত্রশকটের চাকা ঘুরছে না। কলকারখানায় তালাবন্ধ দৈত্যাকার মেশিনের সব ইউনিট। সব নিঝুম। নিরিবিলি, শুনশান। সুযোগ নিয়ে রাজপথের নিয়ন বাতির উজ্জল ঝলমলে আলোয় ঘুড়ে বেড়াচ্ছে বন্য প্রাণির দল!
হ্যাঁ, এটাই এখন গোটা বিশে^র এক চরম বাস্তবতা। অদৃশ্য এক অনুজীবের ভয়াল আক্রমণে মানুষ নিজ নিজ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। অজানা এক আতঙ্ক এবং মৃত্যূভয় গোটা মানবজাতিকে আড়ষ্ট করে তুলেছে। কারণ, মৃত্যুভয়ের চেয়ে বড় ভয় আর নেই।
জ্ঞানের দাবীদার মানুষ করোনার টিকা আবিষ্কার করতে গিয়ে এর নিত্য-নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কাছে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। মানুষ আজ বড্ড অসহায়। চতুর মানুষ কৌশলে পৃথিবীর সকল প্রাণিকে বশ করে গলায় দড়ি পরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। অবশ করার উপাদান দিয়ে গুলি করে হিংস্র প্রাণি ধরে, খাঁচায় আবদ্ধ করে হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে সার্কাস দেখানোর সময় প্রভুত্ব করলেও ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের কাছে আপাতত: নতজানু হয়ে নিজেই ঘরবন্দী জীবন যাপন করছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য মানুষের এই ঘরবন্দী জীবনের যন্ত্রণা এখন বহুমূখী। তাই তারা এখন বন্য প্রাণি বা অন্য কিছুর দিকে তাকানোর সময় পাচ্ছে না। প্রাণিরা কথা বলতে না পারেলেও মানুষের আচরণ বোঝে। এমনকি তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পেয়ে থাকে।
করোনা দুর্যোগে মানুষের নিষ্ক্রিয়তার সুবাদে আশেপাশের বন্যপ্রাণিদের মধ্যে বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। রাস্তা, সমুদ্র সৈকত, বিমান বন্দর, পার্ক, বসতভিটার বাগান সবকিছুতে বন্যপ্রাণিকে অবাধে আনাগোনা করতে দেখা যাচ্ছে।
কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে প্রথমবারের মত গোলাপী ডলফিনের ঝাঁক এসে সাঁতার কাটছে, বাহারী কচ্ছপ ও কাঁকড়ারা খেলা করছে। মানুষের পায়ের চাপ না থাকায় সৈকতে সাগরলতা ফুল শোভা ছড়াচ্ছে। নেপালের রাস্তায় অবাধে গন্ডারকে বিচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। ভারতের কেরালা ও গোয়ার সমুদ্র বীচে হাজার হাজার কচ্ছপ এসে উষ্ণ বালুতে ডিম পাড়ছে। উত্তরাখন্ডের রাস্তায় হরিণ, খাটাস; দিল্লীর রাস্তায় হনুমান, নীলগাই নির্ভয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বানর, ময়ূর তাদের প্রিয় সঙ্গীনিকে উদোম রাস্তায় নাচ দেখাচ্ছে।
ইটালীতে পর্যটকশূণ্য ভেনিস নগরীর খালগুলোতে নৌকার দাপটে সবসময় পানি ঘোলা থাকতো। তাই সেখানে মাছ দেখা যেত না। এখন পর্যটক না থাকায় ভেনিসের খালের পানি টলটলে পরিষ্কার। তাই সেখানে নানা রঙ্গের রঙীন মাছ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র ছেড়ে ইকুয়েডরের রাস্তায় সীলেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তেলআবিবের রাস্তায় শিংওয়ালা বন্যছাগল, আমেরিকা, কানাডার রাস্তায় বন্য ভেড়া, বলাগা হরিণ অবাধে চলাফেরা করারা সংবাদ পাওয়া গেছে। প্রাণিগুলো নির্ভয়ে বসতবাড়ির বাগানে ঢুকে গাছপালা খেয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতিতে ওদের এখন অবাধ স্বাধীনতা। মানুষের সাড়া নেই। মানুষ তাদেরকে এখন তাড়াও করছে না। তাই তারা বর্ডার পেরিয়ে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছে। বসতবাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। প্রাণিরা হয়তো কৌতুহল ভরে তাকিয়ে ভাবছে এত মানুষ গেল কোথায়?
করোনার কারণে লকডাউনে সারা পৃথিবীতে কলকারখানা বন্ধ। উৎসব বন্ধ, তাই আতশবাজির বিকট শব্দ বন্ধ। গাড়ি বন্ধ তাই তেল পোড়ানো বন্ধ। স্বভাবতই: কাবর্ণ নি:সরণ বন্ধ থাকায় বাতাস পরিষ্কার হওয়া শুরু হয়েছে। খনি, ভারী স্থাপনা তৈরী বন্ধ থাকায় পৃথিবীর কম্পনের মাত্রা কমে গেছে।
বেলজিয়ামের রয়্যাল অবজারভেটরীর বিজ্ঞানীরা করোনা সংক্রমনের ফলে লকডাউনের পর প্রথম কাঁপুনি কম হবার প্রবণতা দেখেন। লসএঞ্জেলস্-এর ক্যালটেক বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর এত কম কাঁপুনি ও দুলুনি দেখে বিস্মিত হয়েছেন।
এরকম একটি শব্দহীন, দুলুনীহীন, কাঁপুনিহীন, আতশবাজির চোখধাধানো ঝলকহীন, ভয়হীন পৃথিবীকে বন্যপ্রাণিরা বহুদিন মিস্ করেছে। পৃথিবীটা এক সময় ওদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এতদিন মানুষ তাতে বাধ সেজেছে। করোনার জন্য ওরা এবার সুযোগ পেয়েছে। তাই এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তারা নেমে পড়েছে মানবালয়ের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াতে।
মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঘরে বন্দী ভয়ার্ত জীবনকে বেছে নিয়েছে। মানুষ পৃথিবীর সবচে’ দয়ালু আবার সবচে’ হিংস্র প্রাণি। সব প্রানি মানুষকে খায় না কিন্তু মানুষ সব প্রাণিকে ভক্ষণ করে থাকে। চীনের প্রকাশিত খাদ্য তালিকা থেকে আমরা জেনে গেছি মানুষের রসনা পূজার বাহার। আফ্রিকা তো আছেই।
পৃথিবীটা সবার বাসস্থান। তাই এটা আবার অভয়ারন্য হোক সবার জন্য। করোনায় ঘরবন্দী মানুষ ঘর থেকে দরজা খুলে বের হবার সুযোগ পেলে যেন আবার সর্বভূক হয়ে না যায়- জ্ঞানী মানুষ যেন সবার জন্য দরদী হয়, সেই কামনায় থাকি।
কারণ, অচিরেই ধেয়ে আসছে আরো বড় বিপর্যয়। অতীতের মহামারীগুলোতে পৃথিবীর সকল দেশ এভাবে একসংগে আক্রান্ত হয়ে পড়েনি। তখন একজনের বিপদে অন্যজন, একদেশের বিপদে অন্যদেশ দ্রুত হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই শঙ্কা বেশী। কেউ কারো দায়িত্ব নিতে সাহস পাচ্ছে না। তাই প্রবাসীরা বিদেশী কর্মস্থল ছেড়ে চাটার্ড বিমান ভাড়া করে হলেও নিজ নিজ দেশে দ্রুত আসছে ও চলে যাচ্ছে। মানুষ হন্যে হয়ে নিজ নিজ দেশে, নিজ ঘরে ঢোকার জন্য উদগ্রীব হয়েছে। পাশাপাশি বন্য প্রাণিরা বন থেকে বাইরে বের হয়ে মানুষের দুয়ারে ভিড় করছে। কেউ কেউ বলছেন ওরা খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ের দিকে আসছে। তবে যাই বলা হোক না কেন, বন্য প্রাণির এই আচরণ মানুষের জন্য ভয়ংকর বিপদের আলামত। অবলা প্রাণিরা যে কোন দুর্যোগের আভাস টের পায় ও বিরুপ আচরণ শুরু করে।
করোনাতঙ্কের কঠিন সময়ে এরূপ অশনি সংকেতের সাথে একটি অর্থনৈতিক মন্দা বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বিপর্যয়ের ঢেউ সামলানো খুব কঠিন। এজন্য মানুষের আগামী জীবন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই আগামীর পরিবর্তন যেন একদিকে নৈতিকতা ও অন্যদিকে জীবে প্রেম ও পারস্পরিক ভালবাসার নতুন ধারায় উদ্ভাসিত হয়ে একটি নতুন পৃথিবী জন্ম নেয়- সেই আশায়।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top