সাংবাদিকতার আমার দিনগুলি
পাভেল রহমান।।
এসোসিয়েট প্রেসের টপ টেন রাইটারের একজন এডিথ লেডারার আগ্রাবাদ হোটেলে ডিনার টেবিলে বলল, ‘পাভেল, তুমি কি একটা সি ১৩০ ফ্লাইট নিতে চাও?’ আমি গলদা চিংড়িটা (মালাইকারী) বাম হাতে কাঁটা চামুচে আটকিয়ে তাকালাম ওর দিকে। এডিথ, চট্টগ্রাম উপকূলের সাইক্লোন কাভার করতে এপি টিমে কাজ করছে। আমি চিংড়ির পিসটা মুখে তুলে বললাম নিশ্চয়ই, কোথায় যেতে হবে বল। পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব এডিথকে আজ দারুন লাগছে। ঠোটে গাড় লাল লিপিস্টিক, কানে বড় ঝুলা রিং আর পরেছে ডার্ক মেরুন কালারের টপস। সারাদিনের খাটা খাটুনির পর এডিথের স্টোরি যখন ‘এ ওয়্যারে’ (আমেরিকান ওয়্যারে) ছাড়ল তখন ওর শান্তি! কাজ শেষে সেজে-গুজে ডিনারে হাজির হতেই ওর আনন্দ! এডিথ রেড ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘পাভেল তুমি কি জানো তোমাদের সিলেটে বন্যা দেখা দিয়েছে?’ আমি চমকে তাকাই- সিলেটে বন্যা? আজব, আমি সারাদিন উড়ে উড়ে ঘুড়ে ঘুড়ে হাতিয়া সন্দীপ নিয়েই ব্যস্ত। সিলেটে আবার বন্যা হলে কবে? ইনফরমেশন গ্যাপে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি আমি। এডিথ বলল, ‘হ্যাঁ, আমেরিকান মেরিন সেনারা এবার চট্টগ্রাম থেকে সি ১৩০ কার্গো প্লেন নিয়ে সিলেট যাবে। ঢাকা থেকে রিলিফ গুডস তুলতে, তারপর সিলেট। ক্যাপ্টেন জনকে জানাবো তোমার কথা, ‘দ্যেটস ওকে পাভেল?’ আমি বললাম, শিওর , আমি যাবো সিলেট।
পতেঙ্গা বিমান বন্দরে পৌঁছে গেছি সকাল সাতটায়। জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে পতেঙ্গা যেন অন্য এক বিমান বন্দর। লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকান হেলিকাপ্টার ‘সী নাইট’, ‘ব্ল্যাক হক ‘ডাবল প্রপোলার টারবাইন’, ‘পরিবহন বিমান ‘সি ১৩০ হারকিউলিক্স’। কত কত প্লেন অনবরত উঠানামায় মহাব্যস্ত পতেঙ্গা এয়ারপোর্ট।
জলপাই কালারের ড্রেস পরে জন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে হাজির হলো। ক্যামেরা হাতে ফটোগ্রাফার জ্যাকেট পরিহিত আমাকে দেখেই জন হাত তুলে বলল ‘গুড মর্নিং পাভেল’। আমি ওর সাথে হাত মিলিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করলাম । জন তাঁর সাথী অন্য ক্রুদের পরিচয় করিয়ে দিল আমার সাথে। আমাকে ইশারা করলো জন প্লেনে উঠতে আর ওরা ককপিটে উঠে গেল। আমি গিয়ে আসন নিলাম জাহাজের কেবিনে। বিশাল সি ১৩০ কেবিনটাও বিশাল। যেন বড় একটা হল রুম । আমি একা গিয়ে বসলাম ক্যানভাস কাপড়ের সীটে। আসনগুলি সব জানালার চেয়ে কিছুটা নিচুটে। মানে সীটে বসলে জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায় না। আমেরিকান মেরিনদের পরিবহন বিমানের তালিকার নির্ভরযোগ্য এক নাম c-130 cargo plane কিন্তু দুর্ভাগ্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের। এই সি ১৩০ বিমানে আমের জুড়িতে রাখা টাইম বোমায় নিহত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া । তাতে অবশ্য সি ১৩০ কোন দোষ ছিল না।
জনের ডাকে আমি সম্বিৎ ফিরে পাই। জন ককপিটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে বলল, ‘পাভেল, কি করছো একা একা?’ ‘ককপিটে এসো’। আমি বললাম ককপিটে? বিস্মিত আমি ঘোরের মাঝে জনের পিছু নিলাম সরু সিঁড়ি বেয়ে ককপিটে। ওয়াও! কি বিশাল ককপিট! পাইলট কোপাইলট দুইটি সীটের পরের লাইনে তিনটি সীট। জন বসলো বাম দিকে ক্যাপ্টেনের সীটে ওর পাশে কোপাইলট। জন আর কোপাইলটের মাঝামাঝি পিছনে বসেছি আমি। ককপিটের উইন্ড স্ক্রিন দিয়ে সামনের পুরো ভিউটা দেখতে পারছি আমি। জন তাঁর কানে হেড ফোনে কথা বলছে টাওয়ারের সাথে। পিছন ফিরে বৃদ্ধা আঙ্গুল উঁচিয়ে জানতে চাইলো ‘ঠিক আছো?’ আমরা যে যার হেড গিয়ার কানে লাগিয়েছি। ইঞ্জিন স্টার্ট করে খুঁটিনাটি দুনিয়ার সব সুইচ অন করে জন টাওয়ারের কাছে রানওয়ে ব্যবহারের অনুমতি চাইলো। তারপর ট্যাক্সি করে উত্তর দক্ষিণ রান ওয়ের সামনে বিশাল ভেঁপুর পাতিহাঁস সাদৃশ্য বিমান দাঁড় করালো জন। টাওয়ারের কাছে অনুমতি চাইলো, ‘হারকিউলিস রেডি ফর টেক অফ।’ চট্টগ্রাম টাওয়ার বললো, ‘গুড লাক এন্ড গুড বাই হারকিউলিক্স।’ আমাদের সামনে রানওয়ের নিল্ভ বাতিগুলি ঝলঝল করে উঠলো। একটু ঝকুনি দিয়ে মুহূর্তেই ২০০-৩০০-৪০০ মাইল বেগে ছুটে চলল সি ১৩০ কার্গো। আজ উত্তরে বাতাসের সিগন্যাল দিচ্ছে দিক নির্দেশক বাতাস বেলুন। আহ স্বপ্নের মত আমরা আকাশে ভাসলাম! স্বপ্নে পাড়ি দিতে ককপিটের যেন জুড়ি নেই। এখনে এলে ছোটো বেলার প্লেন চালানোর সব স্বপ্ন ভর করে মনে। মন কাড়া এক অদ্ভুত অনুভূতি এই ককপিট। মনে হয় পৃথিবীর সবচে প্রিয় স্থান আমার এই ককপিট! ককপিটে রোমাঞ্চে ডুবে যাই আমি। জীবনে শখ ছিল এই ‘ককপিটে’ কাটাবো জীবন।
আমরা ততক্ষণে কর্ণফুলী থেকে ডানে ঘুরে উড়ে চলেছি সীতাকুণ্ডর দিকে। জন নিচে তাকিয়ে সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙ্গার দৃশ্য দেখে বলল, ‘আমি শিপ ব্রেকিং এর কথা শুনেছি সুযোগ পেলে আমি এখানে আসতে চাই’। আমি বললাম নিশ্চয়ই। তোমাকে নিয়ে আসবো আমি। আমরা সীমান্তের বিলুনিয়ায় সতর্ক পাশ করলাম। ডানে ভারতের ত্রিপুরা। জন বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত মার্কিন রণতরী ‘তারোয়ার’ সাথে কথোপোকথনের সব শুনতে পারছি আমি আমার হেড গিয়ারে। কুমিল্লা দাইদকান্দির ব্রিজ পাশ করেই আমরা ঢাকার আকাশে এসে ঢুকলাম। ঢাকা থেকে রিলিফ নিয়ে আবার উড়লাম সিলেটের পথে। সিলেটে আগে থেকেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকাপ্টার আমাদের প্রতীক্ষায় ছিল। হেলিকাপ্টারে ওঠানো হলো রিলিফ সামগ্রী। চমৎকার কিছু ছবি হয়ে গেল বাংলাদেশ আর আমেরিকান মেরিনদের নিয়ে। কিন্তু আমার যে বন্যার্ত মানুষের ছবির জন্য মন উসখুস করছে। আমি কি করে ছবি তুলবো। জন বলল, ‘বন্যার ছবি তুমি তো ককপিট থেকেই তুলতে পারো, প্রয়োজন মত আমাকে বলবে আমি নিচু দিয়ে উড়বো’। আমি বললাম তোমার ককপিটের জানালার গ্লাস তো বন্ধ। গ্লাসের ভিতরে দিয়ে কি করে ছবি হবে? জন বলল, ‘একটা ব্যবস্থা হবে’। তাছাড়া আমাদের দ্রুত পৌঁছাতে হবে চিটাগাং। চলো আমরা স্টার্ট করি । অগত্যা।
সিলেট থেকে টেক অফের পর ককপিটের জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ থেকে বন্যার ছবি খুঁজছি আমি। জন একটু পর পর জিজ্ঞেস করছে ‘ঠিক আছো’? কোনদিকে যাব? আমি উপর থেকে অন্তত একটি বাড়ি খুঁজছি পানি বন্দী মানুষ সহ। বাড়ীর ছাঁদে ‘আশ্রয়ে বন্যার্তরা’ এমন ছবি। সিলেটের আকাশে বিশাল হারকিউলক্স নিয়ে উড়ছি আমরা। ককপিট থেকে নিচে তাকিয়ে আছি আমি কাঙ্ক্ষিত ছবির আশায়। জন আমাকে একটা বাড়ী দেখালো। কিন্তু দ্রুত পাস করে যাওয়ায় ও বুঝতে পারে আমি ছবিটা মিস করেছি। জন আমাকে ইশারা করলো, ‘তুমি ওয়েট কর আমি এখুনি আবার আসছি ঐ বাড়ীর উপর’। মুহূর্তে প্লেনকে ৪৫ ডিগ্রী বাঁয়ে টার্ন করালো জন। প্লেনটাকে যেন মোটর বাইকের মতই ইউ টার্ন করলো সে। আমি আচমকা নিজেকে সামলাতে পারি না। ব্যালেন্স হারিয়ে আমি জানালা থেকে ছিটকে পড়ি ককপিটের বাম দিকের জানালায়। কোন কিছু বোঝার আগেই ঘটে যায় ব্যাপারটি। আমি সামলে নেই নিজেকে। আবার উঠে এসে দাঁড়াই জানালায়। জন শঙ্কিত হয়ে উঠে ব্যাথা পেলাম নাকি? কিন্তু পর মুহূর্তে জনের হাসিতে পুরো ককপিট মজা শুরু করলো আর আমি এমন ঘটনায় আতংকে উঠি। আমাকে সহযোগিতার জন্য জনের আন্তরিকতার শেষ নেই। কিন্তু যদি কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত? আমি আতংকিত হয়ে পড়ি। মনে পড়লো কুয়েত যুদ্ধে আমেরিকানরা যত না মরেছে যুদ্ধে তারচেয়ে বেশি মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে। ওদের এডভেঞ্চারের ইচ্ছাটা অনেক বেশি। আমার তখন মাফ চাওয়ার অবস্থা! ভিককা চাই না ওস্তাদ, সামলা! আমার ছবির দরকার নাই বাবা।
জন আবার ফিরে আসতে থেকে সেই বাড়ীর দিকে। প্লেনটাকে সে আরও নিচে নামিয়ে আনে। জন বলল, ‘পাভেল তুমি রেডি তো’? সামনে আগিয়ে আসছে কাঙ্ক্ষিত সেই দৃশ্যপট। চারিদিকে পানি আর ছাঁদের উপর দেখা যাচ্ছে পরিবারটিকে। সাবজেক্ট বরাবর এগিয়ে যায় বিশাল সি ১৩০ হারকুইলিক্স। প্লেনটা একটু বেশি নিচু দিয়ে উড়ছে। আমি দম বন্ধ করে নাইকন এফ এম টু র সার্টার টিপে ধরি। কিন্তু একি? ছাঁদের উপরের বন্যার্ত মানুষ গুলি প্লেনের বিকট শব্দে আর এতো নিচুতে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে পটা পট পানিতে ঝাঁপ দিতে শুরু করেছে। পুরো ছাঁদটা মুহূর্তে খালী হয়ে যায়। আর ছাঁদের মানুষ গুলি সবাই পানিতে ঊর্ধ্ব শ্বাসে সাঁতরাচ্ছে উল্টো দিকে!
জন চিৎকার করে বলল, ‘হোয়াট হ্যাপেন পাভেল?’
আমি হতবাক - হায় আমার ছবি...!!
পাভেল রহমান। ‘ সাংবাদিকতা আমার ক্যামেরায়’।
ককপিটে জন, সি ১৩০ হারকুইলিক্স প্লেন, রণতরী তারোয়ায় আমি, ক্যাপ্টেন জন, বাঁয়ে , অন্য ক্রুরা । নব্বই দশকে আমি ।
সাম্প্রতিক মন্তব্য