logo
news image

করোনার সমষ্টি সংক্রমণকালেও ঠগ-বাটপার

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
করোনা নিজে এক অদৃশ্য দানব। এই দানবের চরিত্র বহুরূপী, এর সৈন্যসংখ্যা অজানা, যারা সব দেশের সবাইকে একসংগে গুলি করতে ক্ষমতাবান। বাংলাদেশে এখন চতুর্থ পর্যায়ে এসে ডাক্তার, পুলিশ, জনতাসহ চারদিকে করোনার সমষ্টি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতারক ও ঠগবাজদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। করোনার আক্রমণের ফলে আমরা মানবরুপী ঠগ-বাটপার দানবদেরকেও দেখার দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়েছি। এই করোনা-কঠিন দ্বিবিধ বিপদের সময়ের মাঝে এবার আমরা রমজানের রোজা পালন করছি। এখন ঠগ সমষ্টিকে রূখতে হবে আবার করোনার সামাজিক সংক্রমণও ঠেকাতে হবে।
কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছেন না কবে, কীভাবে এই অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যাবে। তাই অসহায়ের মত অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঘরে বসে যুদ্ধ করে চলেছি। যারা বাইরে করোনা যোদ্ধা হিসেবে এই অদৃশ্য অনুজীবের সাথে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ রয়েছেন সেই সকল বীর চিকিৎসক, সেনানীদের আত্মাহুতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো একদিন গর্বভরে স্মরণ করবে। পাশাপাশি এই দু:সময়ে যারা অসহায় মানুষের ক্ষুধার অন্ন চুরি ও আত্মসাতে মত্ত হয়েছেন তাদেরকেও জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে থাকবে।
করোনা মানুষের ভয়ংকর স্বরুপকে উন্মোচিত করার সুযোগ এনে দিয়েছে। তাই এখন একদিকে রোগের ভয়, অন্যদিকে ঠগের ভয়। করোনা নেই কোথায়? দেশ, মহাদেশ, মহাসাগরে ভাসমান প্রমোদতরী, রণতরী, আকাশে উড়ন্ত বিমান সবকিছুই করোনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়েছে। আর প্রতারক, ঠগ নেই কোথায়? অন্য সব জায়গার কথা আপাতত: বাদ দিলাম। সেদিন সংবাদে পড়লাম, চীন থেকে করোনা প্রতিরোধের জন্য কমদামী মাস্ক কিনে এনে তার গায়ে এন-৯৫ মাস্কের সিল মেরে হাসপাতালে সাপ্লাই দেয়া হয়েছে। ফলে চিকিৎসকগণ নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংগে পাঞ্জা লড়ছেন! এই ঠগবাজদের ধিক্কার জানানোর কোন ভাষা আছে কি? মহান আল্লাহতায়ালার রহমতের কথা এক্ষণে উহ্য রাখলাম। আমাদেরকে তো আগে নিজেরা বাঁচার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তার বা হাসপাতালের শরনাপন্ন হতে হবে। কিন্তু চিকিৎসকগণ মরে গেলে রোগীদের বেঁচে থাকার আশা-ভরসা আর কিভাবে জেগে থাকতে পারে?
সেদিন ইলিশ মাছ ফেরী করে বিক্রি করতে এসেছিল একজন। পদ্মার বড় ইলিশ বলে হাঁকডাক দিচ্ছিল। দাম কম। কয়েকটি তাজা চক্চকে ইলিশ লেজ ধরে তুলে দেখালো। একবার পরখ করে দেখে আমার সহকর্মী বললো- মনে হয় ভাল হবে। কিনতে পারেন। কিনতে গেলে দেখা গেল তার কাছে শুধু উপরের তিনটিই আসল ইলিশ। তিন স্তরের ট্রে এবং হাঁড়ির ভেতরের অন্য সবগুলোই ওমান থেকে আমদানীকৃত সার্ডিন বা চন্দনা মাছ। যেগুলো ইলিশের মত দেখতে-কিন্তু ইলিশ নয়। আমি ওই মাছগুলো চিনে ফেলায় শুধু উপরের তিনটি ইলিশ কিনতে চাওয়ায় সে আর আমার কাছে মাছ বিক্রি করত রাজী নয়। অর্থাৎ, যারা ইলিশ চেনেন না তাদেরকে ভিন্ন মাছ দেখিয়ে ঠকানো হয়ে থাকে। এটা তার ঠগের ইলিশ ব্যবসা!
এবারে ইফতারীর বাজার সীমিত করা হয়েছে। যারা রাস্তা-ঘাটে ইফতারীর পস্রা সাজিয়ে বসেন তাদের অনেকেরই সেই দিনের রান্নাকরা পুরো সামগ্রী বিক্রি হয় না। বাসীটা ফেলে দেয়ার নিয়ম। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা বাসী খাবার পরদিন পুরনো তেলে ভেজে আবার বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। যেটা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু ঠগবাজরা কি সেকথা আমলে নেন?
ঠগবাজি আমাদের দেশে সামাজিক জঞ্জাল স্বরুপ। ঠগবাজি সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়। অর্থ ও সম্পত্তির লোভে ঠগবাজির ঘটনা ঘটে। ঠগবাজরা নগদ অর্থের মোহে একাজে প্রবৃত্ত হয়। আমাদের দেশে অনেক ধরনের ঠগবাজ আছে। যেমন- আপনি রাস্তায় ট্রাক চালাচ্ছেন। ট্রাফিক ইশারা করে ট্রাকটি থামালো। আপনার কাগজ দেখতে চাইলে আপনি দিলেন। কিন্তু বলা হলো- বেশী স্পীডে গাড়ি চালিয়েছেন, গাড়ি ফিট নয় অথবা এই গাড়ির কাগজ ভূয়া। এজন্য মামলা দেয়া হবে। এভাবে ব্যস্ত রাস্তায় আপনাকে আটকিয়ে হয়রানী করে জ্যাম তৈরী করে ফেললেন। অনেক ড্রাইভার নিরুপায় হয়ে কিছু নগদ সেলামী দিয়ে চলে আসেন। কারণ, তার হয়তো ড্রাইভিং লাইসেন্স নকল। এভাবে উভয়ের ঠগবাজি একটি সমস্যা থেকে আরেকটি সমস্যার জন্ম দেয়। এভাবে তৈরী হয়েছে আমাদের ভেজালে জর্জরিত একটি ঠগবাজির সমাজব্যবস্থা।
একই ধরনের সমস্যার কথা জানা যায়- যখন পত্রিকায় সংবাদ হয় মৃত রোগীকে কয়েকদিন যাবত আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে। এভাবে দুধের মধ্যে পানি, চালের মধ্যে নুড়ি-পাথর, বিল্ডিং বানানোর উপকরণ হিসেবে রডের বদলে বাঁশ দিয়ে অথবা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকের পিএইচডি থিসিস নকল, ইত্যাদি নানা ধরনের ঠগবাজির উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।
অসুন্দর পরিবেশ লোভের কারণ। মনের গরীবি থেকে অর্থ-সম্পদ, পদলোভ ও নারীলোভ সব ধরণের ঠগবাজি করাকে উস্কে দেয়। ঠগবাজি বিবেকের শত্রু। ঠগরা শুধু চোর-ডাকাত নয়। এরা মানবতার শত্রু।
এভাবে মানবতার শত্রুরা বেড়ে গিয়ে সারা পৃথিবীতে আস্ফালন শুরু করতে থাকলে যুগে যুগে আল্লাহর ক্ষুদ্র সৈন্যরা সেই ঠগবাজদেরকে শায়েস্তা করেছে। নমরুদের জন্য মাছি, আব্রাহার জন্য আবাবিল, পঙ্গপাল ও করোনা ভাইরাস ইত্যাদি এসে মানুষের নৈতিকতা ও বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্ট করছে।
এখনো জোর গলায় বলা হচ্ছে- উহানের ল্যাব থেকেই দুর্ঘটনার ফলে করোনা ছড়িয়েছে। কারণ এর আগে প্রকৃতির নরহত্যা একসাথে সবদেশে এতদিন ধরে চলতে দেখা যায়নি। তবে এর পক্ষে যেমন যথেষ্ট প্রমাণ নেই, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তেমন সুস্পষ্ট নয়। যার অর্থ, কিছু দুষ্ট মানবই এই দানবের পৃথিবীতে আগমনের পিছনে দায়ী। অর্থাৎ, মানুষ যখন রাক্ষস হয়, ঠগ-বাটপার হয়, জুলুম করে সীমা লঙ্ঘণ করে তখন আল্লাহর ক্ষুদ্র সৈন্যরা হুকুম পেয়ে ধরাতলে নেমে আসে।
তাই জেগে উঠুক মানবতার গুণাবলী। মরে যাক ভেজাল, নিষ্ঠুরতা। পবিত্র রমজানের জ্যোতি পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিক সব ঠগবাজদের আত্মাকে। সৃষ্টি হোক নতুন মানুষের। যে মানুষের আত্মা বলবে- আমার আয় সৎ, নির্ভেজাল। আমি কাউকে ঠকাই না, প্রতারণাও করি না। আমার বসতবাড়ি হালাল, গাড়ি হালাল, কাপড় হালাল, খাদ্য হালাল। আমার বচন সত্য। আমি মুমিন, আমার রোজা পরিপাটি, আমার ইবাদত খাঁটি।
তাহলে আর ভয় কেন? করোনা সংকট কোন বড় মুছিবত নয়। এই সংকটে আমার যদি মরণ লেখা হয়ে থাকে তথাপি আমার আত্মা কোন ভয়ের কারণে আড়ষ্ট নয়। এজন্য আমি বিশ্বাস করি আমার আত্মমর্যাদা, সার্বিক সৎ দায়িত্বশীলতা ও পবিত্র সত্ত্বাকে। এরূপ বোধদয় আমাদের অশান্ত মনকে প্রশান্তি দিতে পারে। আসুন আমরা নিজ ঘরে বসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নিকট এই কঠিন বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য প্রার্থনা করি ও ধৈর্য্য ধারণ করে অপেক্ষা করি।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top