logo
news image

সামাজিক ঘৃণা ত্রাণচোরদের জন্য

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি ও তাদের সাগরেদদেরকে গত ক’দিন ধরে জনগণের সামনে হাতকড়া পরিয়ে জেলে ঢুকানোর জন্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে দৃশ্য টিভিতে বার বার দেখানো হচ্ছে। এলাকার মানুষ বেজায় আহ্লাদিত হলেও দেশের বিবেকবান মানুষ লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। করোনার ভয়াল আক্রমণের এই সময়ে বিষয়টা মোটেও সুখকর নয়। কারণ অভিযোগটা সেইসব জনগণের যারা তাঁকে করোনা বিপর্যস্ত ভুখা-দু:খী মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ চুরির জন্য অভিযুক্ত করেছে। তারা নিকটস্থ থানায় বা আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদেরকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে তাদের ত্রাণ চুরির ধরন, চুরিকৃত দ্রব্যের পরিমাণ ও সেসব মালামাল রাখার গোপন জায়গা ইত্যাদি। তারা নির্বাচন করেই নির্বাচিত হয়েছিল। তারা নির্বাচন করেছে জনগণের উপকার করার অঙ্গীকার নিয়ে।
 জনপ্রতিনিধিগণ ভোটে জিতে ক্ষমতা লাভ করেছেন। জনসেবা এখন তাঁদের মহান ব্রত হওয়া উচিত। করোনার ক্রাান্তিকালে জনপ্রতিনিধিগণের জনসেবা দেয়ার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বহুদিন ধরে অনেকগুলো পরীক্ষা দিতে হবে। প্রথম পরীক্ষা দিতে গিয়ে অনেক অসৎ জনপ্রতিনিধি ত্রাণ চুরির দায়ে বহি:স্কৃত তথা বরখাস্ত হয়েছেন।
জনগণ তাদেরকে নির্বাচিত করে থাকলে সেই জনগণের জন্য তাদের দায়বদ্ধতা কোথায়? আসলে তারা জনগণের নিকট মোটেও দায়বদ্ধ নন। জনগণ হয়তো তাদের অনেককে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেনি। তাই ত্রাণ চুরির দায়ে জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করায় অনেক এলাকার জনগণ মহাখুশি। এখন সবাই ভোটচোরের সাথে সেই নৈতিকতাবর্জিত জনপ্রতিনিধিকে ত্রাণচোরও বলতে পারবে!
জনগণ বলছে ওদের মাধ্যমে ত্রাণ দেয়ার অর্থ হলো- শিয়ালের কাছে মুরগীর চিকিৎসা করতে দেয়ার নামান্তর। যারা নিজেরা প্রতারণা করে পেশীশক্তি ব্যবহার করে দিনের ভোট রাতে বাক্সে ভরে, নিজেরা গুণে, নিজের অর্থে গড়া অথবা অধীনস্থ মিডিয়ার মাধমে প্রচার করে তারা ত্রাণের চাল-তেল চুরি করবে না তো চেয়ে চেয়ে দেখবে?
তবে যারা ত্রাণ চুরির জন্য অভিযুক্ত তারা সবাই যে ভোটচোর তা বললে ভুল হতে পারে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, সবাই যে ভোটচোর তার কি প্রমাণ আছে? ত্রাণসামগ্রী চুরির দায়ে কেউ তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসাতে পারে এই পাল্টা অভিযোগ দু’একন জনপ্রতিনিধি করেও ফেলেছেন। দেশে তো অনেক ভাল জনপ্রতিনিধিও আছেন।
তবে বর্তমান করোনা ক্রান্তিকালে এতবেশী সংখ্যক জনপ্রতিনিধি চাল-তেল ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ধরনের ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ধরা পড়েছেন, বরখাস্ত হয়েছেন তা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যাপকতার যুগে ত্রাণ চুরির বহুল প্রচারিত সংবাদ দেখ-শুনে জনপ্রতিনিধিগণের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে এত বেশী সামাজিক লজ্জা, ধিক্কার ও ঘৃণা জন্মেছে যে তা বলাই বাহুল্য। এগুলো দেখে আগামীতে কোন ভাল মানুষ নির্বাচন করতে আগ্রহী নাও হতে পারেন।
নির্বাচনে জেতার জন্য একেকজন জনপ্রতিনিধি যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন তা তাদের নিয়মিত বেতন দিয়ে তুলতে গেলে কয়েক যুগেও তোলা হবে না। আগামী নির্বাচন তো এই এলো বলে। তখন আবার জিততে গেলে কাড়ি কাড়ি অর্থ পাবে কোথায়? সবার তো তেমন ব্যবসাপাতি নেই। এখন ঘন ঘন বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগও নেই। ত্রাণের মাল সবসময় বরাদ্দ দেয়াও হচ্ছে না। তাই এ্টাই বড় সুযোগ।
এই সুযোগটা এদেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আস্কারা দিয়ে লালন করা হয়। এটাই যেন আমাদের জাতীয় চরিত্র। দুষ্ট গণতন্ত্রের চর্চ্চা অব্যাহত থাকায় এই ধরনের দুর্নীতির ধারা অনুসরণ করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ মোটেও ঘৃণা করেন না, ভয়ও পান না। কারণ, তারা জানেন উপরে-নিচ সবার চরিত্রের গতি-প্রকৃতি একই সূত্রে গাঁথা। তাই অনেক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ কাউকে তোয়াক্কা করেন না। ওনারা অনেকে মনে করেন, ত্রাণসামগ্রী হলো উজানীর মাছ, বছরে একবারই উজাতে আসে। আষাঢ়ের নতুন পানিতে ডিমওয়ালা মাছ উজাতে শুরু করলে তাকে ধরে খেতেই হবে। ডিমওয়ালা মাছ ধরা নিষিদ্ধের আইন থাকলেও ওপরওয়ালারা তো প্রতিদিনই মাছের ডিমের ক্যাভিয়্যার খেতে অভ্যস্ত। নিজে খেলে তো আর অন্যেদের খাবার বন্ধ করার কথা নৈতিকতার জোর দিয়ে বলা যায় না।
গালভরা বুলি দিয়ে অবৈধ অর্থ ব্যবহার করে আশে পাশের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রেখে ভোটযুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নেয়া জনপ্রতিনিধিগণের ত্রাণ চুরি ঠেকানোর প্রচেষ্টা সফল করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, তাদের গডফাদারগণ দুর্নীতিবাজদের এরকম বিপদের সময় ‘বেশী চিন্তা করোনা’ ‘তোমার কিছু হবে না’- বলে আশ^াস দিয়ে দেন। জনগণ এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কথা বললে রাজনৈিিতক কালার দিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়। যেটা দেশের জন্য বড়ই দু:খজনক। রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়- আপনারা দু:খী মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে কে ত্রাণ চুরি করলো এসব ছোটখাটে বিষয় নিয়ে নিয়ে হৈ চৈ করছেন। কিন্তু এগুলো আদতে কোন ছোটখাটো ব্যাপার নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকে এ ধরনের কথা বলা হলে সেটাতে বরং চোর-ডাকাতদেরকে প্রত্যক্ষভাবে আরো আস্কারা দেয়া হয়। এটাই এই সময়ের জন্য চরম খারাপ বাস্তবতা।
মোদ্দাকথা হলো-ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি ঠেকানোর জন্য শুধু আইনী ভয় দেখালেই কাজ হয় না। আইন শুধু ছোটদের জন্য প্রযোজ্য হবে, বড়দের জন্য হবে না তা কেন হবে? এজন্য চাই নৈতিকতায় মোড়ানো ভাল মানুষের। আমাদের দেশে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষের বড় অভাব।
আর ভাল মানুষ পেতে হলে ভাল জনপ্রতিনিধির প্রশ্ন আসে। একজন সৎ, দক্ষ, নির্লোভ, মানবদরদী জনপ্রতিনিধি পেতে গেলে একটি নির্ভেজাল নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন। নির্বাচনী খরচের একটি নির্দিষ্ট সিলিং থাকার পরও নির্বাচন প্রক্রিয়া বহুলাংশে বিত্তবানদের টাকার খেলা হওয়ায় ও পেশীশক্তির মাধ্যমে অন্ধকারের বিষয়ে পরিণত হওয়ায় সৎ মানবদরদী মানুষেরা ঘৃণাভরে সেই প্রক্রিয়ার ঘুপচি পথে পা মাড়ানোর সাহস করেন না। ফলে লোভী ব্যবসায়ী, ত্রাণচোররা ক্ষমতার দায়িত্ব নিজের করে নেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের ঘৃণা কম, লোভ অসীম। এসব নির্লজ্জ ত্রাণচোরদের বিরুদ্ধে এই করোনা সংকটকালে সামাজিক ঘৃণা জেগে উঠুক-এই প্রত্যাশায়।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top