logo
news image

করোনাকে গুলি করে মারতে চায় গৃহবন্দী শিশু

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
শুধু স্পর্শ ও নিরাপদ দৈহিক দূরত্ব না মানার কারণে সারাবিশ্বে দাবানলের মত ছড়াচ্ছে ভয়ংকর করোনা ভাইরাস। এ্টা রোগাক্রান্ত বিশ্বের সব মানুষকে খুন করতে চায়। এজন্য মানব সভ্যতা আজ শঙ্কিত ও ব্যতিব্যস্ত। কোভিড-১৯ বিশ্বের মানুষকে মৃত্যুভয় দেখিয়ে ঘরে বন্দী করে ফেলেছে। ছোট-বড় সবাই আজ গৃহকোণে কালাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাচ্চাদের নিয়ে দীর্ঘসময় ঘরে বসে অভিাবকগণ হাফিয়ে উঠছেন। বিকেল হলেই বায়না ধরছে বাইরে বের হবার। গল্পের বই, ক্যারম, লুডু, পাজল, কমিকস্ কতকিছু অনেক শিশুর ঘরে। যান্ত্রিক সভ্যতার কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাহারি খেলনা, কম্পিউটার গেম, রোবট, ইত্যাদিও আধুনিক সচ্ছল পরিবারের শিশুদের জন্য আবশ্যিক অনুষঙ্গ। তদুপরি ঘরে থাকতে একদম মন চায় না অনেক শিশু কিশোরের। করোনার ভয়ে ঘরে বন্দী থাকার অনুশাসন অনেক কোমলমতি শিশুদের করে তুলেছে বেপরোয়া। ঘরে থাকতে থাকতে বিরক্ত এক বাচ্চা তার খেলনা বন্দুক নিয়ে তার বাবাকে তাক করে চিৎকার করে উঠছে- ‘আব্বু করোনাকে কি গুলি করে মেরে শেষ করে দেয়া যায় না?’
প্রশ্নটি আজ অনেক শিশুর মনে। ঘরে বসে আর কত? অনির্দিষ্ট লকডাউনে সময় কাটছে না। টিভিতে দিন-রাত মৃত্যূসংবাদ শোনা এবং সামনাসামনি বসে দেখা অভিভাবকদের সীমাহীন উৎকন্ঠা শিশুদের মনের মধ্যে আতঙ্ক তৈরী করে ফেলেছে। বড়- ছোট সবার মানসিক স্বাস্থ্য চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
আমাদের জীবনধারায় হঠাৎ বড় পরিবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে ফেলেছে। সারা বিশ্বে দীর্ঘ গৃহবাস, দুশ্চিন্তা, মন্দা, বেকারত্ব, পারিবারিক সহিংসতা, একঘেয়েমি যেন এই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনের আতঙ্ককে আরো বেসামাল করে তুলছে। অলসতা ও হতাশা মিলেমিশে এক নতুন জীবন-যন্ত্রণা তৈরী করেছে। যা থেকে সহসাই মানুষের মুক্তি পাবার আশা কঈণ হয়ে পড়েছে। কোমলমতি শিশুদের মনে এই দাগ মুছে ফেলা সুকঠিন।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলে আমরা করোনার কঠিন অভিজ্ঞতা নেয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি। আজ ১৭ এপ্রিল আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের গতি প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে যে আমরা তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করছি। ই্উরোপ, আমেরিকার তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণের দিনগুলোতে ঠিক একমাস আগে যেমন পরিস্থিতি ছিল, আমরা সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে পড়েছি। ওদের দেশে তখনকার সংক্রমণ পরিস্থিতি আমাদের দেশে আজকের মত বিরাজমান সংক্রমণের গতির অনুরূপ ছিল। ওদের তৃতীয় পর্যাায়ে মৃত্যুহার ছিল কম, প্রতিদিন ৪-৫ জনের মত। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ সেসব দেশে মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে সুনামীর ঢেউয়ের মত এসে সবকিছু ওলট পালট করে দিতে শুরু করে দিয়েছে। তারা এখন করোনার চতুর্থ পর্যায়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমরা সেটার ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি।
গুলিতে করোনা মরে না, মারাও যায় না। কারণ, সেটাকে তো খালি চোখে দেখা যায় না। বাচ্চাদের মনে আজ নানা প্রশ্ন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় মানব সভ্যতা বহুদূর অতিক্রম করেছে। বহুকিছুর দাবীও করে সব সময়। এজন্য আকাশ, বাতাস, মহাকাশ, গ্রহ-উপগ্রহ ভেদ করে মানুষ চলাফেরা কর চলেছে। অনেক দেশের কৌতুহলী বিত্তবান কিছু মানুষ মঙ্গল গ্রহে বসবাসের জন্য চুক্তিও করেছে বলে জানা গেছে।
কিন্তু যেটা করা হয়নি তা হলো- করোনা ভয়াবহতার জন্য ভবিষ্যৎ সতর্কবাণী। কেউ কেউ সতর্কতার কথা বলার চেষ্টা করছেন। তাদের মতামতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চরম অবহেলা প্রদর্শণ করা হয়েছে। বড় বড় অনেক দেশ এজন্য তেমন কোন প্রস্তুতি নেয় নি।
এমনকি মানুষ ভাবেনি- পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘরে বন্দী জীবন যাপন করার বাধ্যবাধকতার সম্মুখীন হতে হবে। চতুর মানুষ কৌশলে পৃথিবীর সকল প্রাণিকে বশ করে গলায় দড়ি পরিয়ে হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে খাচাঁয় আবদ্ধ করার প্রভুত্ব করলেও –করোনা ভাইরাসের কাছে আপাতত: নতজানু হয়ে নিজেই ঘরবন্দী জীবন যাপন করছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য এই ঘরবন্দী জীবনের যন্ত্রণা এখন বহুমূখী।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আজ এক বার্তায় নারী ও শিশুদের জন্য ঘরে বন্দী জীবনকে এক অনিরাপদ ও বিভিষীকাময় অবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন।
দুর্যোগের এই কঠিন বাস্তবতায় দেশে দেশে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যগণ করোনা সংক্রমলের ভয়াবহতা ঠেকাতে সরকারী নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে রাস্তা-ঘাট সামলাতে ভিন্ন দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এসময় পেশাদার অপরাধীরা রাস্তা থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালেও সাইবার অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা সেবাদানের নামে উন্নত দেশে নিরিবিলি এলাকায় বয়স্ক, অসহায় মানুষের নিকটে ভিড়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের দেশে অনলাইনে নিত্যপন্য, খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদি বিনা সার্ভিস চার্জে প্রদান করার নামে ভেজাল ও নিম্নমানের জিনিষ সরবরাহ করছে। ভূয়া ঠিকানা ও ফোন নম্বর ব্যবহার করায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কোন সুরাহা করা যাচ্ছে না।
ঘরে ঘরে গাদাগাদি করে বাস করা মানুষের মধ্যে ছোটখাটো খুনসুটি খেকে পারিবারিক কলহের প্রবণতা বেড়ে গেছে। অনেকের ঘরে পর্যাপ্ত খাবার মওজুত নেই। বাজারে যেতে সংক্রমণের ভয়। তাই কে বাজারে যাবে, কে টাকা তুলতে যাবে এমন সাধারণ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে মারামারি ও মামলা পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এজন্য পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যগণ বেশী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
করোনা আতঙ্কে মানুষের গৃহবন্দী এই সময়ের মধ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনের এক হিসেবে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের মধ্যে ২৮টি পুলিশী মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ ৯টি, যৌতুক সংক্রান্ত ৮টি, যৌন নিপীড়ণ ৬টি ও অপহরণ ৫টি। এজন্য মোট ৩৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এই হার অনেক বেশী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অনেক বাসায় করোনা সংক্রমনকে ঠেকাতে বাইরের মানুষ তথা কাজের বুয়াকে বাসায় আসতে নিশেধ করা হয়েছে। অনেক পুরুষ সদস্য এ কঠিন সময়ে রান্না-বান্না, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজগুলোতে বাসার মহিলাদেরকে সহায়তা করছেন না। বরং তারা বেশী বেশী নতুন খবারের অর্ডার করছেন। দেরীতে ঘুমাচ্ছেন, দেরীতে ঘুম থেকে উঠছেন। বাচ্চাদের যত্ন মহিলাদেরকেই করতে হচ্ছে। এভাবে ঘরের মধ্যে সংঘটিত কাজের চাপ ও ছোটখাটো বিষয়ে পারিবারিক সহিংসতা নতুন মোড় নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেলে মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়। এজন্য গৃহীত আইনী পদক্ষেপ পারিবারিক ভাঙ্গন সূচিত করে এবং একসময় চারদিক থেকে প্রচন্ড সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয়।
এছাড়া মহামারীর করণে বিশ্বব্যাপী ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক মন্দা, চাকুরী হারানো, হঠাৎ বেকারত্বকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। ফলে সামাজিক প্রলয় ঠেকানা কঠিন হয়ে উঠে। এজন্য দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ও চিকিৎসার অভাবে বিশ্বব্যাপী আবারো নতুন করে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটার অনেক নজির রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বড় শক্তিগুলোর নিকটই শুধু নয়- ছোট শক্তিগুলোও বিশাল অস্ত্র, গোলা বারুদ ও বোমার ভান্ডার মজুদ করেছে। মজুদ করেনি জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম মাস্ক, পিপিই, ভেন্টিলেটর মেশিন। তাই তারা এই মহাবিপদে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য একে অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। করোন সংক্রমণ শিক্ষা দিচ্ছে- শধু সামরিক সরঞ্জাম নয়, মানুষের জীবন রক্ষার জন্য ওষুধ, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম, পরীক্ষার জন্য জরুরী কিটস্, ও নিত্য নতুন রোগ-বালাইয়ের হুমকি মোকাবেলার জন্য গবেষক, গবেষণা ল্যাব, ও গবেষণার জন্য অর্থ সব সময় প্রস্তুত রাখা জরুরী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসকদেরও করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংবাদ যেন মড়ার ওপরে খাড়ার আঘাত হিসেবে হাজির হয়ে সবার মনকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে।
করোনার এই বিপর্যয়কে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর সবচে’ মারাত্মক বিপর্যয়। একদিকে করোনায় মৃত্যুর ভয় অন্যদিকে করোনা পরবর্তী সময়ে ক্ষুধার জ্বালায় ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে খাদ্যের দাবীতে বুভুক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে মিছিল শুরু করে দিয়েছে। কোন বিপর্যয় ঘটে গেলে সাময়িক শধু দু’বেলা আহারের জন্য সাহায্য নয় বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর মানবিক বিপর্যয় কাটাতে ১৯৪২ সালের লর্ড উইলিয়াম বিভারেজ রিপোর্টের মত দীর্ঘমেয়াদী সাহায্য পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের আজকেই ভাবা উচিত। তা না হলে হঠাৎ অগণিত বিপর্যস্ত ও বুভুক্ষ মানুষকে ঠেকানোর জন্যে গুলি করাটাও অমানবিক হবে এবং দীর্ঘদিন ঘরে বন্দী ত্যক্ত-বিরক্ত বাচ্চা ছেলেটার আব্দার অনুযায়ী তার খেলনা বন্দুক দিয়ে করোনা ভাইরাসকেও গুলি করে মেরে শেষ করা যাবে না।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম:  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top