logo
news image

সুখবর অনেকে দিলেও যাদুকরী সমাধান নেই

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
আরো একটি নতুন বাংলা সাল শুরু হয়ে গেল। কিন্তু করোনার ভয়ে বৈশাখী মেলায় যাওয়া হলো না। আমরা সবাই একটা কঠিন সময়ের সাথে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঘরে বসে যুদ্ধ করে চলেছি। কারণ এই ফুলে ভরা এপ্রিল- ঘ্রাণে ভরা এপ্রিলে বিশ^বাড়িটার কোথায় নেই করোনার আগ্রাসন?
আমাজনের গহীন অরণ্যের মধ্যে কোকামা উপজাতির ১৯ বছর বয়সী এক নারীর দেহে এপ্রিলের ২ তারিখে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গুয়াম দ্বীপে নোঙ্গর করা বিশ্ব কাঁপানো মার্কিন রণতরী থিওডোর রুজভেল্টে কর্মরত একজন নাবিক ১৩ এপ্রিল মারা গেছেন, ৫৮৫ জন আক্রান্ত হওয়ায় সেখানকার চার হাজার নাবিককে স্থলে নিরাপদে নামিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে! এ মুহূর্তে আর কোন যুদ্ধ নয়- আগে মানুষ বাঁচুক!
উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে নিউ ইংল্যান্ড। ইউরোপের জার্মানীর বন থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের আমাজন। এশিয়ার দিল্লী থেকে বালি- সব জায়গায় সামাল সামাল রব। মানুষ নিতান্ত অসহায় দর্শক। অন্তত: কোভিড-১৯ এর কার্যকরী প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের দম্ভ, বড়াই করার আর কিছু নেই!
দেশে দেশে কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃার করার জন্য নিরলস প্রচেষ্ট অব্যাহত রয়েছে। মাঝে মাঝে সংবাদ মাধ্যমে কিছু আশার বাণী প্রচারিত হচ্ছে। আশার বাণী শুনতে থাকা আশাবাদী সহজ-সরল মানুষগুলো বেঁচে থাকার নতুন প্রেরণা খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন।
আমরা জানি বার বার চরিত্র বদলে ফেলা কোভিড-১৯ এর বৈচিত্র্যময় গতি-প্রকৃতির জন্য টিকা আবিষ্কার ও সেগুলোর ব্যবহারিক ট্রায়াল দেরী হচ্ছে। জাপানের প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে বেশ অগ্রগণ্য বলে মনে করা হচ্ছে। ফুজিফিল্ম হোল্ডিং কোম্পানী ‘এভিগ্যান’ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধকারী ওষুধ আবিষ্কার করারা পর সেটাকে বাজারে ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
জাপানের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ্যনজেস ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যেগে মাত্র ১৯ দিনের প্রচেষ্টায় করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করা হয়েছে বলে সংবাদে জানা গেছে। একজন বাংলাদেশী পিএ্ইচডি গবেষক সেই ল্যাবে কাজ করছেন। গতমাসে ওই কোম্পানী জানিয়েছে তাদের ভ্যাকসিন তৈরীর কাজ শেষ হয়েছে এবং তা শীগগিরই প্রাণিদেহে পরীক্ষা করা হবে।
উক্ত পিএ্ইচডি গবেষক জনাব নাদিম মাহমুদ বলেছেন- করোনা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করারা জন্য শরীরে ‘এক টুকরো ডিএনএ (প্লাজমিড) প্রবেশ করানো হবে। সেখান থেকে তৈরী হওয়া প্রোটিন পরবর্তীতে ইমোনাইজড হয়ে নভেল করোনা ভাইরাসকে ধ্বংস করে দেবে। তাকারা নামক জাপানের প্রভাবশালী ওষুধ কোম্পানী ভ্যাকসিনটি বাজারজাত করণের দায়িত্ব নিয়েছে বলে জনো গেছে।
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য দু’টি ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছেন অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কিন কোম্পানী ইনোভিও এর যৌথ সহায়তায় এই টিকা তৈরী করা হয়েছে। প্রাণি দেহে এগুলো পরীক্ষা করার অনুমতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাসট্রিয়াল রিসার্চের মুখপাত্র ড. রব গ্রেফনেল বলেছেন- সাধারণত: এই ধরণের গবেষণায় চূড়ান্ত ফলাফল পেতে দু’এক বছর সময় রেগে যায়। তবে আমরা চেষ্টা করছি দু’এক মাসের মধ্যে যাতে টিকা তৈরী করা যায়।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গতমাসে সরাসরি মানুষের দেহে করোনা ভাইরাসের টিকার পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। তার চূড়ান্ত কার্যকারীতা এখনও জানা যায়নি। তবে যুক্তরাষ্টসহ সারা বিশে^ ৩৩৩টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে ২০টি ট্রায়েলই করোনা ভাইরাসের উদ্ভাবিত টিকা সংক্রান্ত বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণপাত্রে ’আসল ও ছদ্ম টিকা’-র ট্রায়াল নিয়ে ঘন ঘন পর্যালোচনা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকগণ  মুখে খাবারের জন্য বড়ি তৈরী করে এর কার্যকারীতা যাঁচাইয়ে সফল হয়েছেন বরে এপ্রিল ৮ এর প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। এই বড়ির নাম ইআইডিডি- ২৮০১। গবেষকগণ দাবী করেছেন এই বড়িটি গিলিয়াডের ওষুধের চেয়ে সফলভাবে করোনা ভাইরাসকে ঠেকাতে পারবে।
ভারত কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পদ্মভুষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত সংক্রমণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ড. জি.পি. নাগেশ^র রেড্ডি বলেন, ভারতে সংক্রমিত করোনার ভাইরাসের মধ্যে দুর্বল চরিত্র লক্ষ্যণীয়। এর স্পাইক প্রোটিনে কিছু জিনগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। করোনা ভাইরাসের মোট আটটি ভিন্ন প্রজাতি সারা পৃথিবীতে জিনগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে কোথাও সবল কোথাও দুর্বলভাবে সক্রিয়। উপমহাদেশে আপাতত: দুর্বলটাই ছড়াচ্ছে। তাই ইউরোপের মত ততটা ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনতে পারছে না।
এদিকে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানম গের্রোয়াসুস ২ এপ্রিল জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন- নতুন করোনা ভাইরাস এখনো নতুন। প্রতিদিনই করোন সংক্রমণের নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত মহামাীর পরিস্থিতি বিবর্তিত হচ্ছে। তাই বিভিন্ন দেশে উদ্ভাবিত মোট চারটি ওষুধকে সমন্বয় করে একটি নতুন পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এজন্য বিশে^র ৭৪টি দেশ ও ২০০ রোগীকে গবেষণা কার্যক্রমের সংগে যুক্ত করে একটি কার্যকরী সমাধান তৈরীর জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কোন ওষুধটি কার্যকর হবে সেটা জানা এখন মুখ্য বিষয়।
এদিকে জানা যাচ্ছে যে, যাদের শরীরে ছোটবেলায় বিসিজি (ব্যসিলাস ক্যালমেট গুইরিন) বা যক্ষার টিকা দেয়া আছে বা দাগ আছে তাদের জন্য সুখবর। তাদের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রবণতা কম। ই্উরোপ আমেরিকায় যেখানে বিসিজি টিকা নেয়া হয়নি সেখানে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ বেশী হয়েছে।
করোনা সমস্যা সমাধান কারো হাতে এই মুহূর্তে কোন যাদুকরী সমাধান নেই। সেটা আমরা সবাই জানি। সারা বিশ^ যেখানে কোন কিছু গোপন করছে না সেখানে আমাদের দেশে তথ্যের গোপনীয়তা কাম্য নয়।
দেশে আমরা সারাদিন চেয়ে আছি টিভির পর্দার দিকে। সারা বিশে^র মৃত্যুর খবরগুলো আমাদেরকে যাপরনাই ব্যথিত করে তুলছে। এই সময়ে যাদের নিকটাত্মীয়রা ইউরোপ আমেরিকায় আছেন এবং কঠিন অবস্থার কথা বারবার তুলে ধরছেন সেটা নিয়ে আমাদের অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
এদিকে দেশের ৮৫জন বিশিষ্ট নাগরিক আজ এক যৌথ বিবৃতিতে দাবী করেছেন- আইইডিসিআর টিভিতে যে তথ্য প্রকাশ করছে তার সাথে মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মিল নেই। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্য মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহ জাগাতে শুরু করেছে। কারণ, ব্রিফিংটিতে তথ্য যাচাই ও ব্যাখ্যা চাওয়ার কোন সুযোগ নেই; যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে ক্ষুন্ন করছে।এছাড়া সংবাদে জানা গেছে- বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ করোনার তথ্য নিয়ে লুকোচুরি ও অবহেলা করে সময় অপচয় করে এখন বিরাট হুমকির মুখ পড়েছে।
ভারত ইতোশধ্যে ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন বর্ধিত করেছে। আসলে আগামী ৩টি সপ্তাহ আমাদের দেশের জন্য বড় ক্রািন্তকাল। সবাইক এই সময়টা ঘরে বসে আত্ম-পর্যবেক্ষণের মধ্যে অতিবাহিত করার জন্য বিশেষ ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে। আমরা জানি, চৈত্রের দাবদাহে ইট-সুরকির অথবা বস্তির ছোট্ট ঘিঞ্জি ঘরে অনেকের বড় পরিবারে বাচ্চা ও বয়জ্যেষ্ঠ: সদস্য সহ একত্রে অবস্থান করতে গিয়ে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। তবুও আগামী কয়েকটি সপ্তাহ মাটি কামড়ে ঘরে বসে থাকুন।
পৃথিবীর সকল মানুষ এভাবে একইসংগে এমন কঠিন মুছিবতের মধ্যে আগে কখনো মুখোমুখি হয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। তবে সৃষ্টির সেরা মানুষ বার বার মহাবিপদে পড়েও বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়েছে। জ্ঞানের এই সামর্থ্য মহান সৃষ্টিকর্তাই মানুষকে দিয়েছেন। তাই দিকে দিকে করোনাকে জয় করার জন্য মানুষের বেঁচে থাকার যে নিরলস প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তা অচিরেই কার্যকরী সমাধানের উপায় খুঁজে সুফল বয়ে আনবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একটা সুখবর দেয়ার জন্য ওরা চেষ্টায় তৎপর, আমরা অধৈর্য্য না হয়ে আরো কিছুটা অপেক্ষা করি।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top