logo
news image

সব শুনশান ফাঁকা-কারবালা হয়ে গেছে

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
করোনা সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায়ের মুখোমুখি অনেক দেশ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অন্য কোন সময় কোন সংকটে একসাথে গোটা দুনিয়ার মানুষকে এত বিচলিত হতে দেখা যায়নি। মৃত্যুভয় এতটা জেঁকে বসেছে যে সামান্য বিষয়ে মানুষ খুব অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। চারদিকে শুধু অনিশ্চয়তা। নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ধৈর্য্যরে বাঁধ আর যেন টান সইছে না। তারা জীবনের তাগিদে ঘরের বাইরে যেতে কারো বাধাকে পাত্তা দিচ্ছে না। কখনো একা কখনো দল বেঁধে সাহায্যের জন্য বাইরে ঘোরাঘুরি করে চলেছে।
এলাকা লকডাউনের মধ্যে দেখা গেল (১০ এপ্রিল ২০২০) পাঁচজন ভিখারিনী সকাল সাড়ে ৬টায় বাসার মূল গেটে হাজির। আগের প্রতি শুক্রবারের মত একজন ভিতরে এসে কলিং বেলে চাপ দিয়ে ডাকাডাকি করছে। আজ ভিক্ষা নয়-সাহায্য চাচ্ছে। ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, কেউ তাদেরকে এলাকায় ঢুকতে নিষেধ করেনি। বড় রাস্তায় বা মূল গেইট কোথাও কাউকে দেখতে পায়নি ওরা। এলাকায় সব বাসার মূল দরজায় তালা দেয়া। ফজরের পর আমাদের মূল দরজা খোলা হয়ে থাকে। সেই সুবাদে তারা ঢুকে পড়েছে। তাদের খাবার নেই। দু’দিন আগে সাহায্য দিবে বলে একজন কার্ড নিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কিছুই পাইনি। আরো জোরে জোরে বলতে লাগলো- রাস্তা-ঘাট, বাজার সব শুনশান ফাঁকা, কারবালা হয়ে গেছে। বাবা, কোন কুফার মুখ দেখে যে আজ বের হয়েছি, সবাই দুয়ার বন্ধ করলে আমরা বাঁচুম কেমনে? ইত্যাদি।
নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে কিছু সাহায্য দিয়ে ওদেরকে অনেক বুঝিয়ে চলে যেতে বললাম। পুরো সকালটা মনে মনে ভাবছি আমদের দেশে মোট অভাবী মানুষের সংখ্যা কত? এ ছাড়া এই সংকটময় মুহুর্তে ধনী-দরিদ্র সকলের মধ্যে সবকিছুতেই একটা অনিশ্চয়তার অভাববোধ ভীষণভাবে কাজ করছে। করোনক্রান্ত রুগ্ন পৃথিবীটাকে ধূসর মরুভূমি মনে হচ্ছে। ঘরে বন্দী মানুষগুলো পরিবারের আপনজনদের নিয়ে বিচলিত। দরিদ্র ও পথমানুষগুলোকে নিয়ে ভাবার তেমন অবকাশ আছে কী? তাদের কারো কারো তো নির্দিষ্ট ঘর নেই-করোনকালে ওদেরকে এভাবে ছুটাছুটি  করতে দিতে থাকলে আমরা কে যে কার জন্যে অচিরেই কুফা হতে যাচ্ছি তা কি জানি?
বাসার সবাই তখনো ঘুমুচ্ছে। নানা ভাবনার মধ্যে টিভির বাটনে চাপ দিতেই আমেরিকার সংবাদ ভেসে আসতে লাগলো। হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বিচলিত দেখাচ্ছে। আজও সেখানে এত মৃত্যু, এত লাশ। হাসপাতালের কর্মীটি আজ লাশ না গুনেই জড়ো করে রাখছেন। কি কষ্টকর সংবাদ। এক ভয়ংকর পরিস্থিতি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগে ভারত সফর করে গেলেন। ভারত তাঁকে যে রাজকীয় সমাদর করেছিল তা বিশ^বাসী টিভিতে হয়তো দেখেছেন। সেই আতিথেয়তার আমেজ এখনও হয়তো কাটেনি। এর মধ্যে করোনার একটি ওষুধের ব্যাপারে ভারতের কাছে আবেদন বা দাবী জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সেটা দেয়া না হলে ভারতকে দেখে নেয়ার হুমকি দিতে দেরী করেনেনি তিনি।
এদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাকযুদ্ধ চলছেই। করোনার কারণে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে এ দু’টি দেশ। দোষারোপ একে অপরকে-যেন ‘তুই পানি ঘোলা করেছিস’। তোদের কারণে এটা হয়েছে। সঠিক তথ্য গোপন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একজন আইনজীবি মামলাও ঠুকে দিয়েছেন চীনের বিরুদ্ধে!
করোনা ছড়ানোর গোড়ায় যে কে আর তা স্বীকার করা নিয়ে ‘অস্বীকৃতির’ রোগটা আসলে কার সেটা বিবেকবান মানুষের উপলব্ধিতে নিশ্চয়ই রয়েছে। কারণ, প্রকৃতির প্রতিশোধের বিপরীতে এখনও মানুষের ক্ষমতার পরিধি কতটুকু-বুদ্ধিমান মানুষ সেটা ভালভাবেই জানে।
তবুও অহেতুক অন্যকে দোষারোপ করার রোগটা কিছু মানুষের মজ্জাগত ব্যাপার। এর পিছনে শয়তানের কারসাজি থাকে, সেটাও মানুষ জানে। তারপরেও কিছু মানুষ সেটাকে অস্বীকার করে। যাদেরকে জ্ঞানপাপী বলা হয়ে থাকে।
এই জ্ঞানপাপীরা সবসময় ধরাকে সরা জ্ঞান করে ন্যায়কে অন্যায় বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে। এভাবে সত্য ভুলুন্ঠিত হয়ে লজ্জা পায়। বঞ্চিত অসহায় মানুষের দু:খকষ্টগুলো ঘণীভুত হয়ে নিভৃতে কাঁদে। সেগুলোর জন্য  ন্যায়বিচারের পথ খুঁজে না পেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিচারের ভার ছুঁড়ে দেয়া হতে থাকে। এভাবে বহু মানুষের কান্না ও কষ্টের ভার কি আকাশের বেশীদিন বইবার তেমন ক্ষমতা আছে?
হ্যাঁ হয়তো আকাশের নিজের না থাকলেও আকাশের মালিকের নিশ্চয়ই আছে। মানুষের ক্ষমতা নেই এত বড় মহাকাশ তৈরীর। তাই মানুষ কখনও মহাকাশের মালিকানা দাবী করার সাহস করেনি। সেই মহাকাশের মালিক যিনি তিনি সর্বজ্ঞানী। তিনি সবকিছুই অবগত। তিনিই একমাত্র ন্যায়বিচারক।
দুনিয়ায় যাদের ন্যায়বিচার হয়নি তাদের আবেদন, আকুতি আকাশে-বাতাসে জমা হয়ে থাকে দীর্ঘদিন। সেই জমাকৃত ফাইলের স্তুপগুলো নিশ্চয়ই একদিন মালিকের গোচরে আসে। অনেকে হয়তো পড়ে ভাবতে পারেন এটা নিছক কৌতুক করে লিখছি। তা হবে কেন? এগুলোর লিখিত প্রমাণ তো আশেপাশেই খুঁজলেই পেতে পারেন।
পৃথিবীর পদলোভী মানুষগুলো যখন জালিম হয়ে যায়, প্রবঞ্চক ও শঠতাকে সততা বলে ক্রমাগত চালিয়ে দিতে থাকে, নিজেদের তৈরী ব্যবস্থাকেও সৎভাবে চালাতে কুন্ঠিত হয়ে মানুষের অধিকার হরণ করতে থাকে তখন কান্নার অশ্রু নদী থেকে সাগরে রুপ নেয়। মহাকাল, মহাকাশ, মহাসাগর কেউ এই ভারী কষ্টের বোঝা বইতে চায় না। সে ্জন্যই তো ইতিহাসে দেখা যায় প্রতি এক’শ বছর পরপর প্রলয়ংকারী কঠিন মহামারী। মানুষের কৃতকর্মের কারণে মহামারী বা বিপর্যয় মানুষের ওপর ধেয়ে আসে। অতিমহামারী করোনা তেমনি একটা কিছু যা ঐশী কিতাবে বর্ণিত আছে। জ্ঞানপাপীরা সবসময় এই বাণীকে অস্বীকার করলেও যথার্থ জ্ঞানীগণ ঐশীগ্রন্থের সতর্কবাণীগুলোকে ইতিবাচকভাবেই মূল্যায়ণ করে থাকেন।
এছাড়া পাশাপাশি আরেকটি ধারা প্রবাহমান। যারা নানাভাবে আলোকবঞ্চিত হয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন যাপন করে। এরা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উভয় শ্রেণির হতে পারে। কারণ, অনেকে শিক্ষিত হয়েও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে অস্বীকার করে। শিক্ষিত হয়েও বাড়ি থেকে বাইরে বেরুনোর সময় কালো বিড়াল দেখলে বা এক শালিক দেখলে যাত্রা নাস্তি মনে করে। কৃষক হলে-শনিবারে জমিতে বীজ বুনে না অথবা বীজ রোপণের সময় দক্ষিণ দিকে মুখ করে না, কারণ সেদিকে সাগর আছে। বন্যা আসতে পারে যে! আরো কত কিছু। যুগে যুগে ভৌগোলিক এলাকাকে দোষ দেয়া, পাহাড়, নদী-সাগরকে দোষ দেয়া, জনপদ ও শহর, গ্রাম ও বাড়িকে দোষ দেয়া ইত্যাকার নানা উদাহরণ রয়েছে।
আসল দোষ যে মানুষ করে, ক্ষমতা থাকলে সেই মানুষই সেটাকে বরাবর উল্টোভাবে উপস্থাপন করার পাঁয়তারা করে। এভাবে পান থেকে চুন খসলেই অন্যকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি শুধু সমাজের নিম্ন শ্রেণির মধ্যেই নয়- উচু শ্রেণির ধ্বজাধারী অনেক লোভী লোকের মধ্যে দেখা যায়। এটাই সভ্য জগতের অন্ধকার কালিমা, এটাই জ্ঞানপাপী আধুনিক ক্ষমতাধর ধূর্ত মানুষের কৃতকর্ম। এটাকেই বলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো।
মানুষ নিজে কুৎসিত কাজ করলেও অন্যকে দোষারোপের ফলেই সুশোভিত কুফা শহর একটি কুৎসিত স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কারবালা বলতে আমরা হৃদয়বিদারক ঘটনাকেই আগে স্মৃতিপটে হাজির করি। যদিও কুফা শহর বা কারবালা মরুভূমির নিজের কোন দোষ নেই।
করোনার ভয়ে মানুষ সারা দুনিয়াকে কারবালা প্রান্তর মনে করছে। কোথাও যেন ঠাঁই নেই, নিরাপত্তা নেই, শান্তি নেই। হতাশা ঢুকে গেছে অশান্ত পৃথিবীর বিচলিত মানুষগুলোর মনের মধ্যে। একেকজন এখনও আস্ফালন করছে, একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে ‘কুফা’ ভেবে পরিত্রাণ পাবার বৃথা চেষ্টা করছে। আমরা নিজের কৃতকর্মের কারণে সারা পৃথিবীকে কারবালায় পরিণত করে ফেলেছি। নিজেরা অবিশ^াসী হয়ে অপরকে কুফা বলে প্রচার করছি। আমাদের মাঝে ধেয়ে আসা অতিমহামারী করোনা, জেঁকে বসা অসুস্থতা, দু:খ-কষ্ট, ঘরে বন্দী থাকার যাতনা এসব কিছু আমাদের ভুল, অন্যায়, গুনাহ ও মন্দ কৃতকর্মের কারণে ভোগ করছি তা উপলব্ধিতে আনা জরুরী হয়ে পড়েছে।
এবছরের মত পবিত্র লাইলাতুল বরাত, মহামান্বিত রাত শেষ হয়েছে। এ সুযোগ বার বার আসুক। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের কাছে কায়মনোবাক্যে ইস্তেগফার পড়ে ক্ষমা চাওয়ার দিন সময় বছরের সব দিন সব সময়ই। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-(হে নবী) আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু (সুরা নিসা-আয়াত ১০৬)। মুমিনগণকে মনে করতে হবে, বান্দা যত বড় মুছিবতেই পড়ুক না কেন মহান আল্লাহ তা’য়ালার রহমতের ব্যাপ্তি সমুদয় বিপদ থেকে অনেক বেশী বিস্তৃত।

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top