logo
news image

বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ আর নেই

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।।
বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক, একুশে পদকে ভূষিত ভাষা সৈনিক ড. সুফিয়া আহমেদ বৃহস্পতিবার (০৯ এপ্রিল ২০২০) ঢাকাস্থ ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
খ্যাতিমান নারী ব্যক্তিত্ব সুফিয়া আহমেদ ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রয়াত মুহম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী এবং মা ছিলেন প্রয়াত লুৎফুন্নেসা ইব্রাহিম। তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন ছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী এবং সান্ধ্য আইনের বিরুদ্ধে মিছিলকারী নারীদের একজন ছিলেন তিনি।
এমএ পরীক্ষার অল্প কিছুদিন পরেই ১৯৫৫ সালে PhD করতে তিনি স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ ও ছোট ভাই খালেদ ইব্রাহীমের সঙ্গে লণ্ডনে চলে যান। ফলে Law কোর্স শেষ করেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসতে পারেননি । তাঁর PhD-র বিষয় ছিল- 'আধুনিক ভারতের ইতিহাস' লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের School of Oriental and African Studies-এ ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে তিনি- 'Some Aspects of the History of The Muslim Community in Bengal (1884- 1912)' শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে PhD লাভ করেন।
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। পরে ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক হন।
তিনি প্রখ্যাত বাংলাদেশী আইনজ্ঞ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের তৃতীয় এটর্নি জেনারেল এবং বিরল ব্যক্তিদের একজন যারা দুটি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন সেই প্রয়াত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ সাহেবের সহধর্মিণী।
তাঁদের দুই সন্তান। পুত্র সৈয়দ রিফাত আহমেদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং কন্যা রাইনা আহমেদ একজন চিকিৎসক।
সম্ভবত তিনিই প্রথম মহিলা যিনি দুই বার জাতিসংঘে কোন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমবার ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের এবং দ্বিতীয়বার ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের হয়ে। ICDDRB-এর ‘এথিক্যাল রিভিউ কমিটি’র মেম্বার হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গার্ল গাইড আন্দোলনের নির্বাচিত আন্তর্জাতিক কমিশনার ছিলেন। আর এই সূত্রে তিনি গার্ল গাইডের চারটা বিশ্ব সম্মেলনসহ ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন।
নিভৃতচারী, আত্মপ্রচার বিমুখ ভাষাসংগ্রামী ড. সুফিয়া আহমেদের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক অর্ধ শতাব্দীরও অধিক।
শান্ত, সৌম্য মুখের মানুষটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় সমানভাবে সোচ্চার। দীর্ঘ সময়ের পথচলার অভিজ্ঞতা তাঁর ভাণ্ডারে। ভাষা আন্দোলনে, স্বাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন সুফিয়া আহমেদ। বিস্তৃত ছিলো তাঁর কাজের পরিধি। আর প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই সফলতা তুলে এনেছেন স্বযত্নে।
এই মহান মানুষটি সম্মাননা, স্বীকৃতির জন্য বসে থাকেননি। নিজের সাধনায় তিনি ধ্যানমগ্ন। বয়সের ভারে হাঁটতে কষ্ট হলেও সুফিয়া আহমেদ নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলন, তাদের উন্নয়ন এবং সামাজিক ও জনহিতকর কার্যে ছিলেন সোচ্চার এক কন্ঠ। তাঁর আন্তরিক অনুরক্তির স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বিভিন্ন সম্মননায় সম্মানিত করা হয়েছে।
১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর ‘স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভলপমেন্ট’ বেগম রোকেয়া দিবসে বাংলাদেশের নারী স্বাধীনতা ও নারী অগ্রগতিতে অবদান রাখার জন্য দেশের ১৬ জন বিশিষ্ট নারীকে ক্রেস্ট দিয়ে সম্মান জানায়। সুফিয়া আহমেদ তাঁদেরই একজন।
তার গবেষণা অভিসন্দর্ভ ১৯৭৪ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রথমবারের মতো এবং ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি ‘বাংলায় মুসলিম সম্প্রদায়’ শিরোনামে গ্রন্থটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করে। বইটি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পাঠ্য।
তাকে একুশে পদক, ‘স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট’, পাক্ষিক অনন্যা, তমদ্দুন মজলিশ থেকে অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদকে সম্মাননা জানানো হয়।
১৯৯৫ সালে ড. সুফিয়া আহমেদকে জানানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান। এখন পর্যন্ত তিনি দেশের একমাত্র নারী যাকেজাতি এই বিরল সম্মানে সম্মানিত করেছে।
১৯৯৬ সালে দেশের বিশিষ্ট দশজন মহিলার মধ্যে একজন হিসেবে ১৯৯৭ সালের ৩ জানুয়ারি পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকার পক্ষ থেকে অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদকে ক্রেস্ট ও স্মারকপত্র দিয়ে সম্মান জানানো হয়। দেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে তিনি এ সম্মাননা পান।
উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ঘোর বিরোধী ভাষাসৈনিক প্রাত স্মরণীয় ড. সুফিয়া আহমেদের অম্লান স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি- দাদী আপনার অনুপস্থিতি অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করলো।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top