logo
news image

বই-বিস্ময়কর শক্তি

জালাল উদ্দীন বাবু
বই হলো প্রাণহীন, অকেজো, শান্তিপূর্ণ বস্তু, অবাস্তব কল্পনার-বিলাসের খোরাক। এর সত্যিকারের স্থান শিক্ষায়, নির্জন পরিবেশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিভৃত প্রকোষ্ঠে। এই কঠিন দুনিয়ায় সংগ্রামরত কাজের মানুষের কাছে এর কোন মূল্য নেই। কিছু মানুষের এমনই ভাবনা। অসীর চেয়ে মসী বড়, তাদের কাছে একথাও মূলহীন। তাদের কাছে অসীই বড়, অসীর সকর্ম ও অগ্রণী রূপের কারণে। কিন্তু তারা ভেবে দেখেনা যে মসীই তার সত্যিকার পরিচালক ও ইন্ধন দাতা। ভাব, সংবাদ ও বাণী সঞ্চালনে ক্ষমতা বইয়ের অলৌকিক। ইতিহাস বলে বই খুব সুবোধ, সরল, গোবেচারী বস্তু নয়। বই প্রাণবন্ত ও গতিশীল। প্রায়ই ঘটনাবলীর সম্পূর্র্ণ ধারাকে আমুল পরিবর্তিত করতে সক্ষম, কখনো ভালোর দিকে কখনো মন্দের দিকে।
পৃথিবীর একনায়কেরা সব-সময়ই বইয়ের আশ্চর্য ক্ষমতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। যখনই তারা কোন বিক্ষোভ বা প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করতে চেয়েছে তখনই সবাই বিরুদ্ধ মতবাদের বই-পত্র ধ্বংশে নিয়োজিত হয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতা বিস্তার স্বপক্ষীয় বইপত্রকে আশ্চর্য চাতুরতার সাথে কাজে লাগিয়েছে। হিটলার এর ‘মেইন ক্যাম্প’ কাল মার্কস এর ডাস ক্যাপিটাল-এর অন্যতম উদাহরণ। বইয়ের মধ্যে যে প্রচন্ড বিস্ফোরক ক্ষমতা নিহিত রয়েছে সে কথা অত্যাচারী শাসকের চাইতে ভালো আর কেউ জানেনা। রেনেসাঁ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাস অর্থনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ওপর কিছু কিছু বই ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছে। চিন্তা ও আদর্শ এইভাবে পুরো সমাজে এনেছে বিপ্লব ও দিয়েছে নতুন সমাজের  ইঙ্গিত। এমনকি জনমানব স্বীকৃতি দেয়নি এমনই বইও পেয়েছে কালোত্তীর্ণ অমরত্বের গৌরব।
কিছু কিছু বই নিয়ে প্রশ্ন জাগে যে, সে সব যুগে কি বই সৃষ্টি হয়েছিল, না বইগুলো সৃষ্টি করেছিল সে সব যুগকে। ম্যাকিয়াভেলী তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার্থে লিখেছিলেন, ‘দি প্রিন্স। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক ও শিল্প ক্ষেত্রে প্রভূত্ব বিস্তারে ইংল্যান্ড প্রস্তুতি নেয় এডাস স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশন্স’ বইটিকে কাজে লাগিয়ে। মার্কিন স্বাধীনতা বিপ্লবে সর্বাত্মক নিয়ে যখন চরম মুহুর্ত ঠিক তখনই টমাস পেইনের ‘কমনসেন্স’ সেই বিস্ফোরণ শুধু আগুনটুকু জ্বালিয়ে দিল।
দাসপ্রথা উচ্ছেদে আব্রাহাম লিংকনের নাম সবাই জানলেও জানে না সেই বইটির কথা, যে বইটি এই দাসপ্রথা উচ্ছেদে এক বিরাট অগ্নিজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত আকাশ এক অপ্রতিরোধ্য আবেগের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল সাগর পেরিয়ে টর্নেডোর ঢেউয়ে ইউরোপ থেকে আমেরিকায়। সে বইটি হ্যারিয়েট রীচার স্ট্রো’র ‘আঙ্কল টমস কেবিন’।
বিজ্ঞান জগতে নিকোলাস কপার নিকাসের ‘দি রিভুলেশানিবাস অরবিয়াম সেলেসটিয়াম’ (জ্যোতির্মন্ডলের আবর্তন), উইলিয়াম হার্ভের ‘দি মটু কাডিস, স্যার আইজ্যাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিক্স, চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিস (যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার), সিগমন্ড ফ্রয়েডের দি ইন্টার প্রিটেশন অব ড্রিমস (অচেতনের মনোবিজ্ঞান), আলবার্ট আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি দি স্পেশাল এন্ড জেনারেল থিওরিস (আনবিক যুগের পথিকৃত) বইগুলোর কথা না বললেই নয়।
বইয়ের শক্তি পরিমাপের নির্ভুল পন্থা হচ্ছে বইয়ের সমকালীন যুগের প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিচার করা। যদি কোন বই এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বা তার সমর্থনে যদি কোমর বেঁধে কেউ দাঁড়ায়, তাহলে ভাবা যায় যে বইটি মানুষের চিন্তা ও মনকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে।
সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো বইটিতে যে মতবাদ প্রচারিত হয়েছে তা পৃথিবী কর্তৃক কতটা স্বীকৃত ও গৃহীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সীমানার বন্ধন ভেঙ্গে কতটা ভাষায় অনুদিত হয়েছে? বহু শিষ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বীর  জন্ম দিয়েছে কিনা? ধীরে ধীরে এই মতবাদ মানুষ ও জাতি সমুহের জীবন ও চিন্তাধারার সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে মিশে এক হয়ে গেছে কিনা ?
‘কমনসেন্স’ প্রকাশের ৬ মাসের মাথায় ১৭৭৬ সালে আমেরিকা তার স্বাধীনতা ঘোষনা করে। জে ম্যাকিন্ডারের The geographical pivot of history পড়েই তৎকালীন ইংল্যান্ডের শাসকরা সারা পৃথিবী শাসনের পরিকল্পনা শুরু করে এবং নৌ শক্তি বাড়াতে থাকে।  ‘মেইন ক্যাম্প’ এ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারধর্মী বই হিসেবে অনেকটাই স্বীকৃত। যার প্রতিটি শব্দের জন্য ১২৫ জন মানুষকে প্রতি পৃষ্ঠার জন্য জীবন দিতে হয়েছে ৪৭০০ জনকে। হিটলার তখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেনুফেস্টো ছিল অনেকে মনে করে ‘মেইন ক্যাম্প’ কে। এত স্পষ্ট ভাষায় মানুষ ও ভবিষ্যৎ দুনিয়ার চিত্র অংকন করা হয়েছে যা মানুষকে আজও ভোগাচ্ছে। এটি  বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী বই হিসাবেও পরিচিত।
প্রতিটি বইয়ের সাফল্যের মূল কারণ ধরা হয় সময় উপযোগীতা। চরম অন্ধকার যুগে পথভ্রষ্ট মানুষের আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে এসেছে আল-কোরআন। মানুষ হয়ে মানুষকে মূল্যায়ন, স্রষ্টার আরাধনাসহ কি নেই এতে! যা সত্যিকার অর্থেই স্বীকৃত মানব জীবনের পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পঠিত আসমানী কিতাব। যা আজও পৃথিবীর বেশি বিক্রি হওয়া গ্রন্থ (গ্রন্থের বিচারে)। জগতে যদি কোন গ্রন্থ সত্যিকারের বিপ্লব, পরিবর্তন এনে থাকে সেই গ্রন্থটি আল কোরআন।
‘এখানে অল্প কিছু বইয়ের কথা বললেও স্পস্টই বলা যায়, বই কোন নিস্প্রাণ বস্তু নয়। বস্তুতঃ বই জীবনের ক্ষেত্রে একটি জীবন্ত ও শক্তিশালী হাতিয়ার।

* জালাল উদ্দীন বাবু: প্রভাষক, লালপুর ডিগ্রী কলেজ।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top