logo
news image

নিরাপদ ব্যক্তি-দৈহিক দূরত্ব ও ঘরে বন্দী মহাকাল

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ক’দিন ধরে সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্বের কথা সাড়ম্বরে প্রচারিত হচ্ছে। বিষয়টির আভিধানিক অর্থ ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার ব্যবহারিক কার্যকারীতার দিকটি কিছুটা উপেক্ষিত ও সর্বসাধারণের নিকট অবোধগম্য মনে হলেও মনে হচ্ছিল বহুল প্রচারণার ভীড়ে সবাই সেটাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। গত ৩০.০৩.২০২০ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক সংবাদে বলা হয়েছে- করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নয় বরং সবাইকে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে নিরাপদ দৈহিক দূরত্বে অবস্থান করা উচিত। সংস্থার স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ এটাকে ‘সঠিক নির্দেশনা’ বলে গণ্য করেছেন। প্রতি শতবর্ষে হানা দেয়া এরুপ ভয়ঙ্কর মহামারীর কছে বিপর্যস্ত ঘরে বন্দী মানুষ এখন মহাকালের সাক্ষী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে চলেছে।
‘সামাজিক দূরত্বের’ আভিধানিক অর্থ হলো সমাজে মানুষে মানুষে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য। সামাজিক দূরত্বের কথা বললে সামাজিক ভেদাভেদ ও বৈষম্য বুঝায়। কোন সমাজের মাুনষের মধ্যে অর্থবিত্ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ক্ষমতা ও পদমর্যাদা, জেন্ডার, নৃ-গোষ্ঠী ইত্যাদি নানা বিষয়ের পার্থক্য বা বৈষম্যকে বুঝায়। করোনা সংক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হঠাৎ করে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে নির্দিষ্ট নিরাপদ স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলতে গিয়ে বাছবিচার না করে তাই ‘সামাজিক দূরত্বের’ মত সাধারণের অবোধগম্য শব্দ ব্যবহার করার নির্দেশনা প্রচার করা হয়েছে। আর এটি  বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রথমদিকে প্রচারিত হলেও এখন নতুন করে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
 বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক সংবাদে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নয় বরং সবাইকে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে নিরাপদ দৈহিক দূরত্বে অবস্থান করা উচিত বলায় মানুষ সহজে এটাকে বুঝতে অনুশীলন করতে পারবে বলে মনে হয়।
সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলেও সামাজিক দূরত্বের সংজ্ঞা বলতে যা বুঝায় আর বর্তমান বাস্তবতায় জনগণকে যেটা বুঝাতে চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে ব্যাপক গরমিল লক্ষ্যণীয়। বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তবতায় এখানে জনতার সমাগম, ভীড় তৈরী না করাকে বুঝানো হচ্ছে। সংক্রমণ ঠেকাতে জনগণ জনসভা, বিয়েবাড়ী, শপিংমল, ওয়াজ মাহফিল, পিকনিক, পার্ক, সিনেমা ইত্যাদিতে যাতে যোগ দিতে না পারে সে লক্ষে এগুলো বন্ধ ঘোষিত হয়েছে।
সামাজিক দূরত্বের যে ব্যাখ্যা মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে সেটা আসলে জনতার ভীড় এড়িয়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে নিরাপদ দূরত্বে বসা, খাওয়া, ভ্রমণ করা, কাজ করা, টিভি দেখা, ঘুমানো ইত্যাদিকে বুঝালেও মিডিয়ার নাগালের বাইরের মানুষেরা সেটার মর্মার্থ বুঝার সুযোগ পাচ্ছেন না। গ্রামের মানুষ হাট-বাজারের চায়ের দোকানে গিয়ে টিভি দেখেন। কারণ তাদের সিংহভাগের বাড়িতে টিভি-ডিশের ব্যবস্থা নেই। করোনার জন্য এখন হাট-বাজারে একত্রে বসতে মানা।
সংবাদে প্রকাশ, আমাদের দেশে আশিভাগ মানুষের হাত মাত্র বিশভাগ সম্পদ। আর মাত্র বিশভাগ মানুষের হতে আশিভাগ সম্পদ রয়েছে। আমাদের ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিরাট সামাজিক দূরত্বের কারণে জীবন বাজি রেখে কেউ কেউ শুধু একবেলা পেটের ভাত জোটানোর জন্যে চৈত্রের দাবদাহ উপেক্ষা করে সংগী ভ্যানগাড়িটি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। তাই শুধু দু’একদিন বিচ্ছিন্নভাবে সাহায্য না দিয়ে এদের জন্য পরিকল্পিতভাবে ও দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য ও ওষুধের ব্যবস্থা চালু করা জরুরী।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা প্রচার করা হলেও মানুষ বাজার-ঘাট করছে, প্রার্থনা করতে বাইরে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা জীবিকার তাগিদে পথে বের হচ্ছে। বস্তির বাচ্চারা দল বেঁেধ রেল লাইনের ওপর খেলাধূলা করছে।
ব্যস্ত মানুষের জীবন এখন বাড়িতে বন্দী। বড় আকারের পরিবারের সদস্যরা বাসার ভিতরে দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা ঠিকমত মেনে চলার সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেক ছোট বাসায় একটি ছোট কক্ষে অনেকজন গাদাগাদি করে ঘুমান। সেখানে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। ঘরে বন্দী মানুষের এই জীবন আসলেই একদিনে মহাকালের সাক্ষী হয়ে থাকবে!
আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী দিনরাত রাস্তা ও জনবহুল এলাকায় টহল দিয়ে মানুষকে সচেতন করে চলেছেন-যেটা নি:সন্দেহে বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে, বস্তিতে এত বেশী সংখ্যক অসচেতন নিম্ন আয়ের মানুষ রয়েছেন যাদের সবার উপর সচেতনতামূলক নজরদারি করা মোটেই সম্ভব নয়। তাদের অনেকের অবস্থান  এতোটা প্রত্যন্ত এলাকা ও ঘিঞ্জি কক্ষের মধ্যে যে সেখানে টিভি বা মিডিয়ার ব্যবস্থা নেই। কারা কারো সে সুযোগ থাকলেও তাদের শিক্ষা সচেতনতার মান এত নিম্নস্তরের যে নতুন ও দুর্বধ্যে কোন শব্দ সম্বলিত প্রচারণা তাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না।
এদিকে ইউরোপ আমেরিকায় ভয়াবহ সংক্রমণের পর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মানুষ অচিরেই করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ধাপে উপনীত হতে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। এসব দেশে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এই অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত।
বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার এক নথির বরাত দিয়ে ‘দি অস্ট্রেলিয়ান’ জানিয়েছে- উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ‘বাংলাদেশে বিশ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হতে পারে।’
মানুষ সামাজিক জীব। অসামাজিক মানুষকে সমাজের সবাই আড়চোখে তাকায়, ঘৃণা করে। তাই সামাজিক দূরত্ব তৈরী করা ভাল শোনায় না। বরং আমরা চেষ্টা করি নিরাপদ ব্যক্তি দৈহিক (সেফ ফিজিক্যাল ডিস্টান্স) দূরত্ব মেনে চলার মাধ্যমে ”দূরে দূরে কাছে থাকা”-র।
এমুহূর্তে বাসা-বাড়ি, গণপরিবহন, প্রশাসনিক মিটিং, সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনস্থান, হাসপাতাল সব জায়গায় উপযুক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী ও নিরাপদ পোশাক পরিধান করে আক্রান্ত ও সুস্থ উভয় ব্যক্তিতে নিরাপদ দুরে অবস্থান করাটাই শ্রেয়। পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাসে ট্রেনে বসে ভ্রমণ করি, অফিসে জরুরী সভা করি, হাসপাতাল, ব্যবসা চালাই। আসুন সবাই বাসায় নির্দিষ্ট নিরাপদ দূরত্বে বসি, কাজ করি, খাই, পড়ি, ঘুমাই।
তা না হলে আক্রান্ত মানুষের লম্বা সারি যদি কল্পনার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছুর দিকে মোড় নেয় তার দায়ভার নেয়ার মত কেউ কি প্রস্তুত আছি?

* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top