logo
news image

বিলমাড়ীয়া বাজার গণহত্যা

হাফিজ আহমেদ।।
ভূমিকা: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করার পরও পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহনা শুরু করে এবং গোপনে য্দ্ধু প্রস্তুতি ও গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে।এর পদক্ষেপ হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি সেনাদেরকে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি গণমানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। ১৬-২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর আলোচনার অন্তরালে সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সংখ্যক সৈন্য আনে। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে ইয়াহিয়া গোপনে করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ইয়াহিয়ার নির্দেশিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযানে উন্মত্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে পাখির মতো গুলিবর্ষণে হত্যা করে।
ইতিহাসে নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা কবলিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালি দুর্জয় আক্রোশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ময়না প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় ও ২৫ নম্বর রেজিমেন্ট ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নাটোর জেলার লালপুর উপজেলায় গণহত্যায় লিপ্ত হয়।
লালপুর উপজেলায় সংঘটিতগণহত্যার মধ্যে রয়েছে দুয়ারিয়া গণহত্যা, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যা, গোপালপুর বাজার গণহত্যা, ধুপইল পঁয়তারপাড়া গণহত্যা, বিলমাড়ীয়া গণহত্যা এবং মহেষপুর গণহত্যা।হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র অষ্টম খণ্ডেনর্থ বেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যা স্থান পেলেও বিলমাড়ীয়া ও অন্যান্য গণহত্যার ইতিহাস আজও কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি। কোনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি বিলমাড়ীয়া গণহত্যার ইতিহাস। এ কারণে বিলমাড়ীয়া গণহত্যার তথ্যসংগ্রহে কিছুটা জটিলতা রয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যরা আর আগের অবস্থানে নেই। বাথানবাড়ীয়া গ্রামটি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের লোকজন ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র উপজেলায়।কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগী পেলেও ভয়ে তারা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চাননি।
সরেরহাট কলেজের শিক্ষকআলমাছ হোসেনের সহযোগে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধ সংসদ লালপুর উপজেলা কমান্ডার আলী আকবরের বাড়ি গেলে তিনি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। তাঁর কাছেই পেয়ে যাই বিলমাড়ীয়া গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও শহীদদের অনেকের নাম ও ঠিকানা।
সাক্ষাৎ পাই নুরুল ইসলাম মাস্টারের, যিনি বিলমাড়ীয়া গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, তিনি বর্ণনা করেন সেদিনের ঘটনা। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. হাসমত উল্লাহ মোল্লা বর্ণনা করেন সেদিন কিভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সজ্জিত হয়ে বিলমাড়ীয়াতে আসে। ভুক্তভোগী আমেনা বেগম বর্ণনা করেন কিভাবে তার ভাই সেদিন নিহত হয়েছিল। এভাবেই ওঠে এসেছে বিলমাড়ীয়া গণহত্যার ইতিহাস। পুস্তিকায় প্রকাশিত কিছু ছবি তুলেছেন মেহেদি হাসান জনি। উল্লিখিত সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
২৮ এপ্রিল-২০ মে ২০১৭ খুলনায় স্থাপিত ১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর এর উদ্যোগে ‘গণহত্যা নির্য়াতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক’ প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান এর প্রতি।তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা না পেলে এই প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারতাম না এবং বিলমাড়ীয়া বাজার গণহত্যার উপর গ্রন্থ রচনা করাও আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, নাটোরের ইতিহাস, নাটোর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস নাটোর জেলা বইগুলো আমাকে স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভে সহায়তা করেছে। সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক এবং ১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর-এর সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসির মামুনকে।তিনি অনুমোদন না করলে গ্রন্থটি প্রকাশিত হত না। বিলমাড়ীয়া বাজার গণহত্যা সম্পর্কে পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে ‘১৯৭১: গণহত্যা নির্যাতন নির্ঘন্ট গ্রন্থমালার সহযোগী সম্পাদক মামুন সিদ্দিকীর শরনাপন্ন হয়েছি। তিনি আন্তরিকভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
আগামী প্রজন্মের নিকট বিলমাড়ীয়া বাজার গণহত্যার বিবরণ, নির্যাতন ও লুটপাটের বর্ণনা তুলে ধরার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই আমার এই প্রচেষ্টা।
এলাকাবাসীর বহুদিনের দাবি বিলমাড়ীয়াতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের। এই সৌধের গায়ে লিপিবদ্ধ হোক বিলমাড়ীয়া গণহত্যার ইতিহাস। যার মাধ্যমে সবাই জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য শহীদের আত্মদানের ইতিহাস। ইতিহাসের শিক্ষা থেকে দেশগড়ার ব্রত নিয়ে এগিয়ে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
এই গ্রন্থ রচনায় মাঠ পর্যায়ে গবেষণার জন্য ১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের অন্তর্গত গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র আর্থিক অনুদান দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাই ধন্যবাদ।
ভৌগোলিক অবস্থান: নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, বাঘা (রাজশাহী) উপজেলা থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বিলমাড়ীয়া।১৮৬৯ সালে লালপুর থানা গঠিত হয়। প্রশাসনের বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালে লালপুর থানা উপজেলায় উন্নীত হয়। এর উত্তরে বাগাতিপাড়া ও বড়াইগ্রাম উপজেলা, দক্ষিণে ঈশ্বরদী (পাবনা) ভেড়ামারা ও দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) উপজেলা, পূর্বে ঈশ্বরদী ও বড়াইগ্রাম উপজেলা এবং পশ্চিমে বাঘা (রাজশাহী) উপজেলা।
এ অঞ্চলের নদ-নদীর মধ্যে রয়েছেপদ্মা, মরা বড়াল, নীচনকুজা, খালিশাডিঙ্গি। বুধপাড়ার কাঁসা শিল্প ও কালী মান্দির(দেশের বৃহত্তম ৩৩ ফুটউচ্চতার শ্যাম্যা পূজার স্থান) এবং উষ্ণতম স্থানের জন্য লালপুর উপজেলাবিশিষ্ট স্থান দখলকরে আছে।
লালপুর থানার গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোর মধ্যে বিলমাড়ীয়া অন্যতম।বাজারটি বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এবং পদ্মা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় এটি ব্যাবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। বাজারের অভ্যন্তরে আনুমানিক দুইশোর অধিক দোকান ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্থানটি শীতের সকালে আখের গুড় এবং বিকালে খেজুরের গুড়ের বড় পাইকারি বাজারে পরিণত হয়।
পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বিলমাড়ীয়া একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার একমাত্র কেন্দ্র এই বাজার। প্রতিদিন সকাল-বিকাল বাজার বসে এবং সপ্তাহে শুক্রবার ও মঙ্গলবারে হাট বসে। হাটের দিনে মানুষের সমাগম ঘটে অনেক বেশি এবং দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করেতাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সওদা করে।
স্থানটির তৎকালীন অবস্থা
লালপুর উপজেলা পরিষদ হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত বিলমাড়ীয়া। বৃটিশ আমলে এটি থানা হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় এই এলাকাটির গুরুত্ব ছিল অধিক। লালপুর উপজেলার ৫ নম্বর বিলমাড়ীয়া ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার বিলমাড়ীয়া। বাজারটির পূর্ব দিকের প্রবেশমুখে রয়েছে বিলমাড়ীয়া জামে মসজিদ এবং তার সামান্য দূরেই প্রাথমিক (১৯২৯) ও মাধ্যমিক (১৯৬৫) বিদ্যালয় অবস্থিত। দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা নদী। বাথানবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯২৯) বিলমাড়ীয়া বাজারের সন্নিকটে অবস্থিত। এই অঞ্চলের শিক্ষার আলো বিস্তারে বাথানবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।একাত্তর সালে বাজারটির আশেপাশে প্রায় ১৫০টি পরিবারের বসবাস ছিল এবং মোট জনসংখ্য ছিল প্রায় ১০০০ জন। গ্রামের লোকদের প্রধান পেশা ছিলো কৃষি। তবে এর পাশপাশি এই এলাকায় নানা পেশার লোক ছিলেন। বিশেষ করে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও উকিল ছিলেন। গ্রামে হিন্দু-মুসলিমের অবস্থান ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ।
পারিপার্শি¦ক পরিবেশ: বিলমাড়ীয়া বাজার পূর্বে পশ্চিমে বিস্তৃত। বর্তমানে স্থলপথের সাথে বাঘা (রাজশাহী) লালপুর, ও বাগাতিপাড়ার যোগাযোগরয়েছে এবং অতীতে নৌপথে পাকশি, ভেড়ামারা এবং দৌলতপুরের (কুষ্টিয়া) সাথে যোগাযোগ ছিলো। বৃটিশ আমল থেকেই স্থানটি বিলমাড়ীয়া নামে পরিচিত ছিলো। এর পূর্বে বড়বাদকয়া, উত্তরে মহোরকয়া গ্রাম, পশ্চিমে মহারাজপুর এবং  দক্ষিণে বাথানবাড়ীয়া (বর্তমানে পদ্মা নদীতে বিলীন) গ্রাম অবস্থিত। স্থানীয় এই বাজারটিতে মোহরকয়া, নাগশোষা, মাহারাজপুর, বাথানবাড়িয়া, মোমিনপুর, বাকনাই, সুলতানপুর, রহিমপুর, বড়বাদকয়া প্রভৃতি গ্রামের মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়-বিক্রয় করে।
বৃটিশ আমলে নীল চাষাবাদ তদারকির জন্য বিলমাড়ীয়ায় নীলকুঠি স্থাপিত হয় এবং রাজস্ব আদায়ের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৩০ সালের পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমেশ্বর চৌধুরী ও পানসি পাড়া গ্রামের বিপ্লবী নৈমুদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে বিলমাড়ীয়ায় নীলকর বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং নীলকর প্রশাসকদের সাথে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দুই জন ব্যক্তি প্রাণ হারায়। বিদ্রোহের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে নৈমুদ্দিন সরকার গ্রেফতার হন এবং কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
গণহত্যার পটভূমি: ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন কালাকানুনের বিরুদ্ধে ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লালপুরের মানুষ সোচ্চার ছিল। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও শোষণ বিরোধী জনমত গঠন ও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করে। লালপুর ছিলো নাটোর মহকুমার রাজনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিলো। একারণে ১৯৬৫ সালে শহীদ এ.এইচ.এম.কামারুজ্জামানের হাতে লালপুর মুক্তি সংঘ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠত হয় এবং ক্লাবটি মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। স্বাধিকার আন্দোলনের সক্রিয় অনুভূতি লালপুরের গণমানুষের হৃদয়কেও গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিলমাড়ীয়ার বীরেন সরকারের নেতৃত্বে অনেকে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় নাটোর ছিলো রাজশাহী জেলার একটি মহকুমা। নাটোর মহকুমার ভাগে জাতীয় পরিষদের দুটি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে চারটি আসন বরাদ্দ ছিলো। নির্বাচনে এই ছয়টি আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীগণ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। জাতীয় পরিষদে নাটোর মহকুমা থেকে নির্বাচিত হন মো. নাজমুল হক সরকার (চারঘাট-লালপুর-বাগাতিপাড়া-বড়াইগ্রাম) ও ডা. শেখ মোবারক হোসেন (নাটোর-সিংড়া-গুরুদাসপুর থানা)। প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন শঙ্করগোবিন্দ চৌধুরী (নাটোর সদর থানার অংশ ও বাগাতিপাড়া), আশরাফুল ইসলাম মিয়া (সিংড়া ও নাটোর সদর থানার অংশ), আব্দুস সালাম (বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর থানা) এবং মো.জিল্লুর রহমান (লালপুর ও চারঘাট থানার অংশ)। জিল্লুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক কর্মসূচি অনেকটা তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে দেশবাসীর মনে শঙ্কা বেড়ে যায়। এই সংকটের মুহূর্তে ২৮ মার্চ  লালপুর, বিলমাড়ীয়া, গোপালপুরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ একত্র হয়ে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে প্রাক্তন সৈনিক ও আনসারদের সমন্বয়ে একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল ও সরদহ পিটিসি থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং কয়েকটা দেশি বন্দুক দিয়ে সজ্জিত করা হয় এই বাহিনীকে।
প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের প্রথম দিনেই নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের শ্রমিক নেতা সুশীল কুমার পাল বুলডোজার চালক এ.কে.এম. শামসুদ্দিনকে সাথে নিয়ে কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ঈশ্বরদী বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং রানওয়েটি নষ্ট করে বুলডোজারটি রানওয়ের উপর রেখে আসেন। এতে বিমানবন্দরটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এভাবেই লালপুরবাসী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।
২৫ মার্চ কালরাতে দেশব্যাপী গণহত্যার নীলনকশার অংশ হিসেবে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজশাহী শহরে গণহত্যায় মেতে ওঠে। রাজশাহীতে অবস্থানরত লালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট বীরেন সরকার, শিল্প ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান এবং জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্য মো. নাজমুল হক সরকারসহ (চারঘাট-লালপুর-বাগাতিপাড়া-বড়াইগ্রাম) অনেকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন।একই সময়ে নাটোরের পার্শ্ববর্তী জেলা পাবনায়ও খানসেনারা গণহত্যা শুরু করে। তাদের এই গণহত্যা মুক্তিকামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। ২৭ মার্চ পাবনায় মুক্তিবাহিনী ও জনতার প্রতিরোধে ৮০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ১৮ জন আহত হয়। ২৮ মার্চ সকালে রাজশাহী থেকে মেজর রাজা আসলামকে দায়িত্ব দিয়ে পাবনায় পাঠানো হয়। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পাবনায় আক্রান্ত অবশিষ্ট সৈন্যদের উদ্ধার করে রাজশাহীতে নিয়ে আসার জন্য। বেগতিক দেখে মেজর রাজা আসলাম ২৯ মার্চ ৩০-৪০ জন সেনা নিয়ে রাজশাহীর দিকে রওনা দেন। কিন্তু নাটোরে ছাত্র-জনতার রাস্তা প্রতিরোধের সংবাদ পেয়ে তারা ঈশ্বরদী অভিমুখে যাত্রা করেন এবং এক পর্যায়ে গোয়াল বাথান হয়ে মুলাডুলি গোডাউনের পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে পুনরায় রাজশাহী মহসড়কে ওঠে। এখানেও তারা জনতার বাধার সম্মুখীন হন।
এবার নিরুপায় হয়ে খানসেনারা পাকা সড়কের পশ্চিমে পুনরায় কাঁচা রাস্তায় প্রবেশ করে এবং লালপুরের মাঝগ্রাম রেলগেট (ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ) পার হয়ে টিটিয়া, সুন্দরবাড়ীয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে চাঁদপুর (কদমছিলান ইউনিয়ন) পৌছায়। সেখান থেকে আনুমানিক ভোর ৫ টা ৩০ মিনিটের সময় লালপুরগামী মনির উদ্দিন আকন্দ রোড হয়ে গোপালপুরের দিকে রওনা করে। হানাদারদের গোপালপুর পৌছার পূর্বেই জনতা তাদের আগমনের বার্তা পেয়ে রেল লাইনে ওয়াগন দ্বারা ব্যারিকেড দেয় এবং বহু সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে গোপালপুর রেল গেটের সামনে। গড়ে উঠলো প্রতিরোধ বাহিনী। এই প্রতিরোধের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন– আব্দুল গফ্ফার খান, আখতার মিয়া, আমজাদ হোসেন নান্নু, মসলেম উদ্দিন (আনসার কমাণ্ডার) প্রমুখ। সুগার মিলের ১৭ জন আনসার এই প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগ দেয়। প্রতিরোধের সময় যুধিষ্ঠির নামে এক ব্যক্তি পাকিস্তানি সেনাদেরকে লক্ষ্য করে তীর ধনুক নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তীর নিক্ষেপেরআগেই পাকিস্তানিএক সেনাদেখে ফেলে এবং যুধিষ্ঠির আটক করে। আটকের পর তাকে বেয়নেট আঘাত করে তার বক্ষ বিদীর্ণ করে হত্যা করে। শুধু নাটোর মহকুমায় নয়, সাবেক রাজশাহী জেলার যুধিষ্ঠিরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আঘাতে প্রথম শহীদ যোদ্ধা।
পাকিস্তানি হানাদারদের কনভয়ে ছিল দুটি পিকআপ, চারটি জিপ ও দুটি ট্রাক। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পুনরায় আকন্দ সড়ক অনুসরন করে। এসময় আকন্দ সড়কের দুই পার্শ্বে শত-শত বিক্ষুব্ধ জনতা জড়ো হয়। সেনারা এ দৃশ্য দেখে উপায়ন্তর না পেয়ে বিক্ষিপ্তভাবে গুলি ছোড়ে এবং গুলির আঘাতে তৎক্ষণাৎ কয়েকজন শহীদ হন। সেই আঘাত নিয়ে এখনো জীবিত আছেন নান্দরায়পুর গ্রামের অনিল চন্দ্র সরকার এবং দুয়ারিয়া গ্রামের ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাস। তারপরও কনভয়টি সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা পথিমধ্যে বিজয়পুর ও বামনগ্রাম সীমান্তে অবস্থিত ইছামতি খালের উপর অবস্থিত ব্রিজের পশ্চিম পার্শ্বের রাস্তা আড়া-আড়ি ভাবে কেটে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমতাবস্থায় সেনারা রাস্তায় খালকাটারত ৪/৫ ব্যক্তিকে হাতে-নাতে ধরে আটক করে নিয়ে যায় শুকিয়ে যাওয়া খালিশাডাঙ্গা নদীর দিকে। কিন্তু নদীতে নামার পর আর কোন উপায় না পেয়ে নদীর উত্তর পাড়ে ময়না গ্রামে সৈয়দ আলী মোল্লা ও নওয়াব আলী মোল্লার বাগান ঘেরা বাড়ি দখল করে সকাল ১০ ঘটিকায়। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়ির চারকোণায় চারটি মেশিনগান স্থাপন করে আমগাছের নিচে গাড়ি পার্কিং করে। তাদের আগমনে অনেকে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মসলেম মোল্লার বাড়ির পেছনে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়কৃতদের মধ্যে মসলেম মোল্লা, কাশেম, কেরামত ও ছাত্তারকে হানাদার সেনারা ধরে আনে ও আমগাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে এবং কয়েকজনকে আটকে রাখে। বীর বাঙালিও পিছু হটবার মানুষ নয়। তারাও ধৃত ব্যক্তিদেরকে উদ্ধারের জন্য গ্রামের চর্তুদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে।
ইতোমধ্যে সমগ্র লালপুর, বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, রাজশাহীতে খানসেনাদের আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজার-হাজার বীর বাঙালি ময়না প্রান্তরে একত্র হয়।
চতুর্দিক থেকে প্রতিরোধে জনতার ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। তাতেও প্রতিরোধকারী জনতাকে গতিপথ থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়। তারপর তারা জনতাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। জনতাও উল্টে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেন। এই প্রতিরোধে বাঙালি পুলিশ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ছুটি ভোগ করতে আসা কিছু সেনাসদস্য অংশগ্রহণ করেন। তারা গাদা বন্দুক আর নাটোর জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি মোকাবেলা করে। প্রতিবেশী গ্রামের মানুষ জল আর খাদ্য সরবরাহ করে।বাড়ি বাড়ি মহিলারা রুটি ভাত খিচুরি রান্না করে প্রতিরোধী জনতার কাছে পৌঁছে দেন।
ময়না প্রান্তরের প্রতিরোধ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্ধার করার জন্য ৩০ মার্চ দুপুর আনুমানিক তিনটার দিকে দুইটি হেলিকাপ্টার আসে এবং হেলিকাপ্টার থেকে ব্যাপকভাবে গুলি ও বোমাবর্ষণ করে। প্রতিরোধীরা হেলিকাপ্টারকে লক্ষ্য করে রাইফেল দিয়ে গুলিবর্ষণ করলে হেলিকাপ্টার দুটি পালিয়ে যায়। প্রতিরোধী জনতার শক্ত অবস্থান দেখে অবরুদ্ধ হানাদার বাহিনীর কেউ কেউ ভোরবেলায় আত্মগোপন করে আখক্ষেতে। আবার কেউ কেউ আখক্ষেতে দিয়ে পালিয়ে কারো বাড়িতে গিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে মহিলাদের শাড়ি পরে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।
প্লাটুনের প্রধান মেজর রাজা আসলামকে মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল হক ময়নার অনতিদূরে সিঅ্যান্ডবি রোডের একটি গর্তের চারদিকে জঙ্গল ঘেরা স্থানে প্রথমে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে ফেলেন। ধৃত পাকিস্তানি হানাদারদের গোপালপুর মিলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়।
মিলের জেনারেল ম্যানেজার লে. আনোয়ারুল আজিম ধৃত বন্দি তিন সেনা সদস্যকে মহকুমা কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে লালপুর থানার দিকে রওনা দেন। লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট হাই স্কুলের কাছে ট্রাক যেতেই জনতা পুনরায় ট্্রাক ঘিরে ফেলে। তারা বন্দিদের তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য প্রবল চাপ প্রয়োগ করে। লে. আজিম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মেজর আসলাম সেই ক্ষিপ্ত জনতাকে দেখেও চিৎকার করে বলেন, ‘হামকো ছোড়দে, নেহিতো ইহা বোম গিরেগা’। বিক্ষুব্ধ জনতা রাজা আসলামের কথা শুনেই ট্রাকের ওপর চড়াও হয় এবং জোরপূর্বক ট্রাক থেকে ছিনিয়ে নেয়। ১ এপ্রিল মেজর রাজা আসলামকে লালপুর হাইস্কুল মাঠে হামিদুল হক (পোড়াবাবু) গুলি করে হত্যা করেন। ধৃত অপর দুইজন গণপিটুনিতে নিহত হন।
ওই দিন বিকেলে বাগাতিপাড়া থানার জামনগর ইউনিয়নের গয়লার ঘোপ গ্রামে পরাজিত সৈন্যদের দুইজন জনতার হাতে ধরা পরে। তাদেরকেও বিক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। অন্যরা আখ ক্ষেত ও বনজঙ্গলে পালিয়ে রাজশাহী কোনোমতে পৌঁছে আত্মরক্ষা করে।
ময়না প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদের সঠিক সংখ্যা আজও উদঘাটিত হয়নি। তবে ধারণা হয় যে, প্রতিরোধযুদ্ধে প্রায় ৪০ জন যোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতা শহীদএবং ৩২ জন আহত হন।
ময়না প্রান্তরে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ এবং তাদেরকে পরাজিত করে নাটোরবাসী প্রথম প্রমাণ করে বাঙালির ঐক্য ও সংহতির শক্তি। ময়নার প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং ২৫ নম্বর রেজিমেন্ট ধ্বংস পাকিস্তানি বাহিনী সহজভাবে মেনে নেয়নি। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানিরা নাটোর মহকুমায় লালপুর থানার ৮ টি স্থানে গণহত্যা চালায়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিলমাড়ীয়ার অধিবাসীরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে ওঠে এবং কর্মপন্থা নির্ধারন করতে একত্র হয়। এলাকার নিরাপত্তা সুসংহত করার লক্ষে ২৯ মার্চ তারা বিলমাড়ীয়া প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার দেলবার হোসেনের নেতৃত্বে এই প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালিত হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ হলেন: দেলবার হোসেন, আজবার আলী (বিলমাড়ীয়া), আবুল কাশেম মাস্টার (বিলমাড়ীয়া), আব্দুল আজিজ (মোহরকয়া), আলী আকবর (বাথানবড়ীয়া), শামসুল হক (মোহরকয়া), আকবর হোসেন (মোহরকয়া), মো. শামসের আলী মোল্লা (বিলমাড়ীয়া), আবু হোসেন (মোহরকয়া), মজিবর রহমান (মোহরকয়া), আবুহেনা মোস্তফা কামাল দুলাল (মোহরকয়া), কদম রসুল (মোহরকয়া), ইয়াকুব ভান্ডারী (মোহরকয়া), হিসরান আলী (মোহরকয়া), আবুল কালাম আজাদ (মোহরকয়া) এবং আবুল হোসেন (মোহরকয়া) অন্যতম।
১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের এক বিরাট কনভয় ৫৮টি বাস ট্রাকসহ লালপুরে এসে হাজির হয়। তারা লালপুর থানায় প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি প্রদান করে রাত ১২টার দিকে ঈশ্বরদীর দিকে রওনা করে। জুলাই মাসে লেফটেন্যান্ট সাওলাত আববাসের অধীনে লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি স্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। লালপুর থানায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের জন্য ১০টি ইউনিয়নে রাজাকার ক্যাম্প বসানো হয়।
মৌলভী জামাল উদ্দীন রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিলমাড়ীয়ায় ডেকে আনে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে বলে, বিলমাড়ীয়া একটি সীমান্ত এলাকার গ্রাম। এই গ্রামে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে নিয়মিত আশ্রয় নেন এবং একসঙ্গে মিলিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানের পরিকল্পনা করে। গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করে। এই কথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
গণহত্যা-নির্যাতনের বিবরণ: ২৭ জুলাই ছিল বিলমাড়ীয়া হাটের দিন। নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়-বিক্রয় করতে হাটে আশেপাশের গ্রামের মানুষ ছাড়াও পদ্মার ওপাড় ভেড়ামাড়া ও দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) থেকে অনেক মানুষহাটে আসে।এ দিন মৌলভী জামাল উদ্দীনের পথপ্রদর্শনে দুই গাড়ি পাকিস্তানি সেনাবিলমাড়ীয়াহাটে আগমন করে। শুধু গাড়িতে নয়,পায়ে হেঁটেও কিছু সংখ্যকহানাদার সৈন্য সাধারণ পোশাকে হাটে আসে। এ প্রসঙ্গে হাসমত উল্লাহ মোল্লা বলেন ‘আমরা কয়েকজন রাস্তার পাশে বসে গল্প করছিলাম, হঠাৎ দেখি ৭/৮ জন মিলিটারি সিভিল পোশাকে বিলমাড়ীয়ার দিকে যাচ্ছে। তাদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলো কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিলো।’ পাকিস্তানি সেনারাএসে সমস্ত হাট ঘিরে ফেলে। হাটে আগত সাধারণ নিরপরাধ মানুষগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের খবরে ভীত সন্তস্ত্র হয়েপ্রাণ বাঁচাতে দিগবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এমতাবস্থায় সেনা সদস্যরা এলোপাথাড়ি গোলাগুলি করতে থাকে এবং গুলিবিদ্ধ হয়েতৎক্ষণাৎ অনেকে শহীদ হন।পদ্মার পাড়ে, দোকানের পেছনে, ক্ষেতের আইলে প্রভৃতি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে এসব শহীদের মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়।
পাকিস্তানি সৈন্য দেখে সেদিন নিজের জীবনকে রক্ষা করার জন্য বাথানবাড়ীয়া গ্রামের ইসমাইল ও মোহরকয়া গ্রামের খবির সর্দার দৌড় দেয় এবং কিছুদূর গিয়ে রাস্তার পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেয়। পাকিস্তানি সেনারাও তাদের পিছু নেয় এবং একপর্যায়ে পর্যায়ে পুকুরের নিকট এসে উপস্থিত হয়ে গুলিবর্ষণ করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় সমগ্র পুকুরের পানি। এ প্রসঙ্গে জামির উদ্দীন হালসানা বলেন, ‘বিলমাড়ীয়া হাটে পাকিস্তানি সেনাদের দেখে আমাদের গ্রামের ইসমাইল মন্ডল দৌড় দেন এবং কিছুদূর গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তার পেছনে পেছনে ছুটতে থাকে এবং পুকুরের পাড়ে এসে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।’ হাসমত উল্লাহ মোল্লা অরো বলেন,‘ মোহরকয়া গ্রামের খবির সর্দার হানাদার বাহিনীকে দেখে দৌড়ে পানিতে লাফ দেন কিন্তু তাতেও তার শেষ রক্ষা হয়নি।’
অনেকে জীবন বাঁচাতে দ্ইু দোকানের মাঝখানে সরু গলিতে, গাছের আড়ালে, দোকানের চাতালে, ঝোপ-ঝাড়ে প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়। আশ্রিত এসব মানুষকে ধরতে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা তল্লাশি চালাতে থাকে। তারা বিভিন্ন দোকানের ভেতর থেকে আশ্রিত ব্যক্তিদেরকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে। তাদেরকে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যরা সহায়তা করে।
শহীদ পরিবারের সদস্য হাফিজুর রহমান উল্লেখ করেন যে,‘১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই মঙ্গলবার আমার আব্বা হাটেযাওয়ার সময়পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়ি হঠাৎপেছন থেকে তাড়া করলে তিনিবিলমাড়ীয়া বাজারে আজের প্রামাণিকের দোকানে আশ্রয় নেন কিন্তু আজের প্রামাণিক বিশ্বাসঘাতকতা করে আব্বাকে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ধরিয়ে দেন।’
শহীদ পরিবারের আরেকসদস্য আবুল কাশেম মাস্টার বলেন ‘বিলমাড়ীয়া হাটেপাকিস্তানি সেনাবহিনীর অভিযানের খবর আজের প্রামাণিক আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু তিনি খবরটি কাউকে না জানিয়ে  গোপন করেন এবং হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেন।’
বিকাল ৫ টা পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বহুসংখ্যক নিরপরাধ মানুষকেআটক করতে সক্ষম হয়। আটককৃত সকলকে হাত পেছনে বেঁধে একটি স্থানে একত্র করে।এরপর তারা হাট লুট করে। বাহার, জমসেদ, আজের প্রামাণিক প্রমুখ লুটপাটে সহায়তা করে। পাকিস্তানি বাহিনী হাট লুটের পর দোকানপাটএবং কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারপর ধৃতদেরকে বটগাছের সাথে বেঁধে রেখে অত্যাচার করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য উদঘাটনের জন্য শারিরীক নির্যাতন করে। কিন্তু কোন প্রকার তথ্য না পেয়ে রাগান্বিত হয়ে পাকিস্তানি সেনারাব্রাস ফায়ার করে সকলকে হত্যা করে। ধৃত ব্যক্তিরা না মরা পর্যন্ত গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে এবং গুলিবিদ্ধদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।সন্ধ্যারঘনিয়ে এলে পাকিস্তানি সেনারা লাশগুলো ফেলে রেখে চলে যায়। পড়ে থাকা মৃতদেহের সুরাহা সেদিন হয়নি।শহীদের আত্মীয়স্বজন যারাবিলমাড়ীয়া ও আশেপাশের এলাকার ছিলেন শুধুমাত্র তারা এসে মৃতদেহসংগ্রহ করে দাফন-কাফনের ব্যাবস্থাকরেন। অবশিষ্ট শহীদের নিথর দেহ খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাদের সৎকার।
এ প্রসঙ্গে মো.নুরুল ইসলাম বলেন ‘হাটের দিনে পাকিস্তানি সেনারা যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই হত্যা করেছে এবং যাদেরকে নদীর কিনারায় হত্যা করেছে তাদের মৃতদেহ নদীর স্রোতে ভেসে যায়। সেদিন যারা পদ্মার ওপার থেকে ( ভেরামারা, দৌলতপুর) থেকে অনেকে হাটে এসে শহীদ হন তাদের মৃতদেহ কেউ নিতে আসেনি এবং এসব মৃতদেহ গলে পচে কঙ্কালে রূপান্তরিত হয়।’
পাকিস্তানি সেনারা সেদিন শুধু হাটে আগত মানুষকেই হত্যা করেনি। আসার সময় তারা রাস্তা থেকে নিরপরাধ মানুষকেও জোরপূর্বক তাদের গাড়িতে তোলে এবং বিলমাড়ীয়া হাটে নিয়ে এসে তাদেরকেও অন্যদের সাথে গুলি করে হত্যা করে। এ প্রসঙ্গে আমেনা বেগম বলেন ‘আমার গ্রামের ছাদের ও খলিল মিলিটারির গাড়ি দেখতে গিয়েছিল। আমরা সকলেই তাদেরকে যেতে নিষেধ করি কিন্ত তারা নিষেধ অমান্য করে এগিয়ে যায়। আমার সামনে দুইজন পাকিস্তানি আর্মি ছাদের ও খলিলকে জোর করে গাড়িতে উঠায়। বিলমাড়ীয়া হাটে ফাঁকা জায়গায় তাদেরকে আটক অন্য মানুষের সাথে দাঁড় করে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে।’
এমন পরিস্থিতিতে ২৮ জুলাই বুধবার দুপুর ১২ টার সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীপুনরায় বিলমাড়ীয়াহাজির হয়। তাদের এই উপস্থিতি বিলমাড়ীয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকার অধিবাসীদের জন্যঅনিশ্চিত ও ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে।হানাদার সেনারা আসার সময় বিভিন্ন স্থান থেকে ৭/৮ জন নিরীহ মানুষকে আটক করেবিলমাড়ীয়ায় নিয়ে আসে। এসময় বিলমাড়ীয়া বাজার ছিল সম্পুর্ণ জনশূন্য। আগেরদিনঘটে যাওয়া নির্মম গণহত্যার কারণে কোনো দোকানদার সেদিন বাজারে আসার দুঃসাহস দেখায়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাথানবাড়ীয়া গ্রামের জমসেদ আলীজরুরী কাজে বাজারে আসেন এবং হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তানি সেনারা আটককৃত ৯ জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে শিমুলগাছের সাথে বেঁধেঅত্যাচার করে মুক্তিসেনাদের তথ্য আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু নিরীহ মানুষগুলোর কেউই মুক্তিসেনাদের কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তথ্য আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে সবাইকে হত্যা করে। যাবার সময় তারা রাস্তার পাশের ঘর-বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
পর-পর দুই দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও গণহত্যাসমগ্র এলাকার মানুষের মনে চরম ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।এই বুঝি হানাদার সেনারা এলো! এই শঙ্কা এলাকাবাসীর মনে চরমভাবে দানাবাঁধে। এমন পরিস্থিতিতে শহীদদের মৃতদেহ নেয়ার জন্য কেউ সাহস করেবিলমাড়ীয়াআসেনি। ফলে খোলা আকাশের নিচে শহীদদের মৃতদেহগুলো পড়ে থাকে দিনের পর দিন। পড়ে থাকাশহীদদের মৃতদেহে পচন ধরে এবং এগুলো শকুন, শেয়াল এবং কুকুরের খাবারে পরিণত হয়। শহীদদের রক্ত ও লাশের দুর্গন্ধ আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তোলে এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পরিবেশ।
বিলমাড়ীয়ার গণহত্যার ফলে মোহরকয়া, মোমিনপুর, বাথানবাড়ীয়া, নাগশেষা, বিলমাড়ীয়াসহ আশেপাশের এলাকার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। এলাকা থেকে প্রায় ৫০০০ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের জলঙ্গী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় এবং জনশূন্য বাড়িঘরে স্থানীয় রাজাকার লুটপাট চালায়। গণহত্যা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্র এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষে বিলমাড়ীয়া স্কুলে কিছু দিনের জন্য ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে।
১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় হলে এলাকার মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করে এবংবিলমাড়ীয়া বাজারে প্রাণের সঞ্চার হয়। ততদিনে গণহত্যার শিকার শহীদদের মৃতদেহগুলো কঙ্কালে রূপান্তরিত হয়।এমতাবস্থায়কঙ্কালগুলো সুরাহার জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ইমরান আলী, নায়েব উদ্দিন, একাব্বর প্রামাণিক, দেলবার হোসেন, আজবার আলী, কদম রসুল প্রমুখউদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহীদদের শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় ও মাথারখুলিএকত্র করে বটগাছের পাশে গণকবর দেয়। যে বটগাছের সাথে বেঁধে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করা হয়েছিল সেটির অস্তিত্ব আজ আর নেই। সেখানে স্থাপিত হয়েছে বিলমাড়ীয়া জামে মসজিদ।
শহীদ সনাক্তকরণ: বিলমাড়ীয়া গণহত্যায় শহীদের সংখ্যা নিয়ে মতভদ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলামের তথ্যানুসারে এই গণহত্যায় শতাধিক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অজবার আলীর মতে সেদিন ৭০-৮০ জন লোক মহীদ হন। এই গণহত্যার নির্যাতিত ও ভুক্তভোগীদের কেউ এখন জীবিত নেই। ফলে এই গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা নিরূপন করা অত্যন্ত কঠিন।
ক্রম     শহীদের নাম    পিতা    বয়স    পেশা    ঠিকানা
১    ফজু থান্ডার    বকুল থান্ডার    ৩০ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
২    জামির পাগলা    হারান মালিথা    ২০ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৩    ছইর উদ্দিন    হাজু সরকার    ৩৫ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৪    খলিল    ইউসুফ    ৪০ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৫    জমির আলী    আহম্মদ প্রামাণিক    ৩৫ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৬    নিতু    ময়লাল সরকার    ২৫ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৭    ইসমাইল    ইয়াদ আলী    ২১ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৮    ছাদের আলী    সুবরাজ মোল্লা    ৫০ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
৯    ছাত্তার মন্ডল    চান্দা মোল্লা    ২৫ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
১০    জামের আলী    গবরা    ২৮ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
১১    আকছেদ    বাহার আলী    ২০ বছর    কৃষক    বাথানবাড়ীয়া
১২    ছাদেক        ৩২ বছর    কৃষক    চকবাদকয়া
১৩    সাবেদ সোনারু    কাবিল সোনারু    ৩০ বছর    স্বর্ণকার    চকবাদকয়া
১৪    মজিবর রহমান    ইদ্রিস সরকার    ৩৮ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
১৫    ইসহাক আলী    সেকেন খলিফা    ২৮ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
১৬    আবীর আলী        ৩৫ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
১৭    মোসলেম মাস্টার    মকছেদ প্রামাণিক    ৪৫ বছর    শিক্ষক    মোহরকয়া
১৮    আব্দুল আজিজ     তাহের উদ্দিন মন্ডল    ২৮ বছর    সাইকেল মেকার    মোহরকয়া
১৯    মোয়াজ্জেম হোসেন    হারান সরকার    ৩৯ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
২০    সিরাজ খলিফা    ছইমুদ্দিন    ৪৮ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
২১    নুরুন্নবী    পচু মিয়া    ৪০ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
২২    জব্বার খাঁ        ৩০ বছর    কৃষক    মোহরকয়া
২৩    সোহরাব হোসেন    আমেজ থান্ডার    ৩৫  বছর    প্রকৌশলী    মোহরকয়া
২৪    হরিনারায়ণ মিস্ত্রী        ৩৭ বছর    কাঠমিস্ত্রি    মোহরকয়া
২৫    ইসমাইল হোসেন শেখ    ইয়াদ আলী    ২৭ বছর    ব্যাবসায়ী    বিলমাড়ীয়া
২৬    তাজ আলী                বিলমাড়ীয়া
২৭    ফেলু শাহ    মোশারফ শাহ    ৩০ বছর    কৃষক    ফতেপুর
২৮    টেলু মিয়া    লালা প্রামাণিক    ৩৬ বছর    কৃষক    ফতেপুর
২৯    বাহার উদ্দিন সরকার    নইব সরকার    ৩৮ বছর    কৃষক    মহারাজপুর
৩০    মকছেদ আলী    ফুলবাস    ৪২ বছর    কৃষক    নাগশোষা
৩১    উকিল শাহ্    ইদু শাহ্    ৪৬ বছর    কৃষক    নাগশোষা
৩২    নজের আলী    আলিমুদ্দি    ৩৯ বছর    কৃষক    নাগশোষা
৩৩    গরিবুল্লা    চদ্রিখা    ৩৩ বছর    কৃষক    নাগশোষা
৩৪    মজিবর রহমান                নাগশোষা
৩৫    গোবরা মিয়া    যদ্দি শা    ৩০ বছর    কৃষক    নাগশোষা
৩৬    আমীর হোসেন                নাগশোষা
৩৭    আজাহার আলী    দেলা প্রামাণিক    ৩০  বছর    কৃষক    ভাদাপাড়া
৩৮    জামশেদ আলী    রমজান মাস্টার    ৩৫  বছর    কৃষক    ভাদাপাড়া
৩৯    ইসমাইল হোসেন    ইন্তাজ মিয়া    ৪০ বছর    কৃষক    মহারাজপুর
৪০    বাহার উদ্দিন        ২৮ বছর    কৃষক    নাগশোষা
গণহত্যা-নির্যাতনকারীর তালিকা: বিলমাড়ীয়া গণহত্যা  পরিকল্পনাকারীর মূল নায়ক ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। গণহত্যার দিন যেসব বিহারী ও পাকিস্তানি সেনা গণহত্যায় অংশ নেয় তাদের সঠিক নাম ও ঠিকানা জানা যায়নি। গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছিল স্থানীয় কিছু দালাল ও শান্তি কমিটির সদস্য। প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ পরিবারের সাক্ষ্যমতে নিম্নোক্ত নির্য়াতনকারীর সন্ধান পাওয়া যায়। বাকিদের তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।
ক্রম    নাম    পরিচয়    ঠিকানা
১    ক্যাপ্টেন রাজা হোসেন    পাকিস্তানি আর্মি অফিসার    পাঞ্জাব
২    লফটেন্যান্ট সাওলাত আব্বাস    পাকিস্তানি আর্মি অফিসার    পাঞ্জাব
৩    মৌলভী জামাল উদ্দিন    শান্তি কমিটির প্রধান    বিলমাড়ীয়া
৪    তসিকুল মেম্বার    শান্তি কমিটির সদস্য    মোহরকয়া
৫    বাহার আলী    শান্তি কমিটির সদস্য    বিলমাড়ীয়া
৬    আজের প্রামাণিক    শান্তি কমিটির সদস্য    মোহরকয়া
৭     সোনা মিয়া    রাজাকার    মোহরকয়া
মৌলভী জামাল উদ্দিন (৬০)
লালপুর থানার মুসলিম লীগের আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে মৌলভী জামাল উদ্দিন ছিলেন অন্যতম। স্থানীয় প্রভাবশালী মানুষটি তৎকালীন সময়ে ঘোড়ার গাড়িতে চলাফেরা করতেন এবং এলাকার অনেকেই তাকে সমীহ করতো।১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা করেন।নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পরাজিত হলেঅশাহত হয়ে তিনিদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ কারণে তাকেমুক্তিযুদ্ধকালীন লালপুর থানা শান্তি কমিটির প্রধাননিযুক্ত করা হয়। হানাদার বহিনীর সাথে তার যোগাযোগ ছিল নিয়মিত এবং এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য তিনি হানাদার বাহিনীকে সরবরাহ করতেন। তার তথ্যের উপর ভিত্তি করে ২৭ জুলাই বিলমাড়ীয়া গণহত্যা সংঘঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী বিলমাড়ীয়া গণহত্যায় সম্পৃক্ততার কারণে রাজাকার প্রধান মৌলভী জামাল উদ্দিন ও তার সহযোগীদের উপর প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজতে থাকে। অবশেষে ১০ ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী মৌলভী জামাল উদ্দিনকে আটক করে এবং সংক্ষিপ্ত বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।জামাল উদ্দিনের হত্যার খবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং হত্যার প্রতিশোধ নিতে ১৩ ডিসেম্বর মহেশপুর গ্রামে ৩৬ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
তসিকুল মেম্বার (৫৫)
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরদোসর ও শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন মোহরকয়া গ্রামের তসিকুল মেম্বার। হানাদার বাহিনীর সাথেতার যোগাযোগছিলো নিয়মিত।হানাদারদের চাহিদা পূরণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।বিলমাড়ীয়া গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি মুক্তিবাহিনীরতালিকাভিুক্ত শত্রুতে পরিণত হন। মুক্তিবাহিনী তসিকুল মেম্বারকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজতে থাকে। অবশেষে১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীতসিকুলকে আটকের উদ্দেশ্যে তার বাড়ি ঘেরাও করে।বুঝতে পেরে সেবাড়ি থেকে পলায়ন করে এবংগ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি বয়ান সরকারের ঘরের চাতালে আত্মগোপন করে।আত্মগোপনের কথা তারই জামাতা ইনু মোল্লা মুক্তিবাহিনীর এক সদস্যকে জানিয়ে দেন এবং তিনি ধরা পড়েন।তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
আজের প্রামাণিক (৬০)
মহোরকয়া গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে আজের প্রামাণিক শান্তি কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান প্রীতির কারণে তিনিও মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতে পারেননি। ২৭ জুলাই বিলমাড়ীয়া গণহত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। একারণে ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি মুক্তিবহিনী কর্তৃক আটক হন। এরপর তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সোনা মিয়া (২৫)
মোহরকয়া গ্রামের সোনা মিয়া রাজাকারদের অন্যতম সক্রিয়সদস্য ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
এ প্রসাঙ্গেমো.নুরুল ইসলাম বলেন ‘১৯৭১ সালের নভেম্বরে আমি, মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মোহরকয়া গ্রামের নুরুন্নবি ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি। পথমধ্যে রাতে দুড়দুড়িয়া গ্রামে রাতে যাত্রাবিরতি করি। সকালে পুনরায় তিনজন তিন পথ অনুসরন করে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।বিলমাড়ীয়া বাজারের কিছু দূরে আসতেই নুরুন্নবি রাজাকার সদস্য কর্তৃক আটক হন। যেসব রাজাকার  সদস্য নুরুন্নবিকে আটক করে তাদের মধ্যে সোনা মিয়াও ছিলো । নুরুন্নবি ও সেনা মিয়া সম্পর্কে তারা চাচা-ভাতিজা ছিলেন। কিন্তু সেনা মিয়া এ সম্পর্ক ভুলে গিয়ে নুরুন্নবিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন।পরবর্তীতে নুরুন্নবির কোনো খোঁজ মেলেনি। স্বাধীনতার পরে সোনা মিয়া মহোকয়া গ্রাম ত্যাগ করে গোপালপুরে আশ্রয় নেন।’
প্রত্যক্ষদর্শীর মৌখিক ভাষ্য: বিলমাড়ীয়া গণহত্যার স্থানটি বাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে হলেও গণহত্যার দিনে সকলেই অত্মরক্ষা করার জন্য প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। এ কারণে প্রত্যক্ষদর্শীর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
মো.নুরুল ইসলাম (৭১),
অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বিলমাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়, পিতা: হাসেন উদ্দিন প্রামানিক, মাতা: আছেনা খাতুন, গ্রাম ও ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
আমার ¯পষ্ট মনে পড়ে সারাদেশে গণহত্যা শুরু হলেও বিলমাড়ীয়ার অধিবাসীদের মনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোনো ভীতি সঞ্চার করেনি। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই রোজ মঙ্গলবার,হাটের দিন।এ দিন বিলমাড়ীয়াসহ আশেপাশের গ্রাম,মহোরকয়া, বাথানবাড়ীয়া,নাগশোষা,রহিমপুর, মোমিনপুরসহ আশেপাশের গ্রামের মানুষ পাটসহ অন্যান্য ফসল বিক্রি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সওদা করার জন্য হাটে উপস্থিত হয়।
বেলা তিনটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ অতর্কিতভাবে হাট ঘেরাও করে। আমাদের বাড়িটি বিলমাড়ীয়া বাজার থেকে কিছু দূরে ছিল কিন্তু বাড়ি থেকে বাজারের অনেক কিছুই দেখা যেত। সেদিন অনেকেই হানাদার বাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।আমরা ঘরের চাতালে উঠে গণহত্যার অনেক দৃশ্য দেখতে পেয়েছি।
হাটের দিন পাকিস্তানি সেনারা যাকে যেখানে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। কাউকে নদীর পাড়ে, কাউকে দোকানের ভেতর, কাউকে পুকুরের পানিতে গুলি করে হত্যা করে। তারপর হাটের বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তানি সেনারা ৪০/৫০ জনকে আটক করে এবং শিমুল ও বটগাছের সাথে বেঁধে অত্যাচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ব্রাসফায়ার করেআটককৃত সকলকে হত্যা করে। গণহত্যার পর আর্মিরা পাটের দোকানগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।পাকিস্তানি সেনা,স্থানীয় রাজকার, ঈশ্বরদী থেকে আগত বিহারীদেরনেতৃত্বে লুটপাটসংঘঠিতহয়।
সন্ধ্যার সময় পাকিস্তানিরা চলে গেলে আমি গণহত্যার স্থানে যাই। সে কী বিভৎস দৃশ্য! রক্তে সমস্ত মাঠ রঞ্জিত হয়ে গেছে, কারো কারো চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে, দেখে চেনার কোনো উপায় নাই। তখনও দুই একজন জীবিত ছিল এবং নড়াচড়া করছিল। আমার সামনে একজন ব্যক্তি জোরে মা বলে চীৎকার করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আরেকজন শরীর তুলে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা করেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন।
২৮ জুলাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পুনরায় বিলমাড়ীয়ায়আসে। এদিন তারা ৯জন ব্যক্তিকে শিমুল গাছের সাথে বেঁধে গুলি কওে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পর কেউ তাদের স্বজনদের লাশ সংগ্রহ করতে আসেনি। পদ্মার ওপাড় ভেড়ামাড়া ও দৌলতপুর থেকে যারা হাটে এসে শহীদ হন তাদের লাশগুলো এখানেই পড়ে থাকে এবং শেয়াল কুকুরে টানাটানি করে।
গণহত্যার কিছু দিনের মধ্যেই বিলমাড়ীয়া, বাথানবাড়ীয়া, মোহকয়াসহ আশেপাশের গ্রামের মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের জলঙ্গী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকারেরা বেশকিছু বাড়িতে লুটপাট করে। বিলমাড়ীয়ার ইনছার আলী ও মছলেম স্থানীয় হিন্দুদের অত্যাচার করেছিল এবং তাদের ঘর-বাড়ি লুট করেছিলো।
জমির উদ্দীন হালসানা (৭০)
পিতা : এরশাদ হালসানা, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা-কৃষক।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি নিজ গ্রামেই অবস্থান করি। গ্রামে রাস্তাঘাট না থাকার কারণে গ্রামটিকে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে নিরাপদ মনে করতাম। কিন্তু ২৭ জুলাই আমারই সামনে থেকে আমার গ্রামের দুই জন ব্যক্তি ছাদের ও খলিলকে পাকিস্তানি আর্মিরা রাস্তা থেকে জোরপূর্বক তাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। তা দেখে আমি প্রাণভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই। বিলমাড়ীয়া মসজিদের পার্শ্বে ছাদের, খলিলকে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে একসাথে পাকিস্তানি সেনারা গুলিকরে হত্যা করে।
এছাড়াও আমাদের গ্রামের ইসমাইল মন্ডল বিলমাড়ীয়া হাটে পাকিস্তানি সেনা দেখে জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। হানাদার সেনারা ধরতে তার পিছু নেয়। কিছুদূর গিয়ে ইসমাইল পুকুরে ঝাঁপ দেয়।পাকিস্তানি সেনারা পুকুরের পাড় থেকে তাকে লক্ষ করে ততক্ষণ পর্যন্ত গুলি ছুড়তে থাকে যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ ছিল। পুকুরের পানি ইসমাইলের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়।
আর্মিরা বিলমাড়ীয়া হাটে গণহত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা বিভিন্ন দোকানে অগ্নিসংযোগ করে এবং লুটপাট করে। এর কিছু দিন পরে হানাদার বাহিনী বিলমাড়ীয়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। স্থানীয় রাজাকার তাদেরকে সহযোগিতা করতো। তাদের অত্যাচারে আমরা দেশত্যাগ করে ভারতের জলঙ্গী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিই। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা নিজ গ্রামে ফিরে আসি।
মো.হাসমত উল্লাহ মোল্লা (৭৮)
পিতা: নছির উদ্দিন মোল্লা, মাতা: হাছিমন বেওয়া,গ্রাম:মোমিনপুর, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। পেশা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্মী (অব.)।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২৮ জুন ২০১৭
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে বিলমাড়ীয়ায় গণহত্যা ঘটায়। দিনটি ছিল মঙ্গলবার, হাটের দিন। আমরা কয়েকজন রাস্তার পাশে বসে গল্প করছিলাম, হঠাৎ দেখি ৭/৮ জন মিলিটারি সিভিল পোশাকে বিলমাড়ীয়ার দিকে যাচ্ছে। হাটে যেয়ে তারা এলোপাথাড়ি গুলি করে। লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে এবং কিছু লোককে তারা পাকড়াও করে। তাদের মধ্যে আব্দুল জলিল নামে আমার এক ভাগ্নে ছিল। সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা ছিল। দর্জির কাজে নিযুক্ত থাকার কারণে তার হাটে যাওয়া। দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে সে উর্দু ও আরবী ভাষায় পারদর্শি ছিল।উর্দু ভাষার দক্ষতার কারণে তারা তাকে ছেড়ে দেয়।এরপর আটককৃত অন্যান্য ব্যক্তিকে তারা ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে। নিহতদেরমধ্যে মোহরকয়া গ্রামের সিরাজ খলিফা, খবির সর্দার ও মোয়জ্জেম ছিল। খবির সর্দার হানাদার বাহিনীকে দেখে দৌড়ে পানিতে লাফ দেন কিন্তু তাতেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। হানাদার বাহিনী তার পিছু নিয়ে পানির উপরেই গুলিবর্ষণ করে হত্যা করে। ১৯৭২ সালে গণহত্যায় শহীদ ব্যক্তিদের পরিবারকে বঙ্গবন্ধু সরকার ২০০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।
আমেনা বেগম (৬০)
স্বামী: যাদু মন্ডল, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। পেশা: গৃহিণী, সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন২০১৭
১৯৭১ সালের মার্চে গণহত্যা শুরু হলেও জুন পর্যন্ত আমরা আমাদের এলাকায় কোনোপাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করিনি। এই কারণে আমরা স¦াভাবিকভাবে জীবন যাপন করেছি। শ্রাবণ মাসে বিলমাড়ীয়ার হাটের দিন হঠাৎ পাকিস্তানি মিলিটারির দুইটি গাড়ি আমাদের গ্রামের রাস্তা অতিক্রম করে বিলমাড়ীয়ার দিকে যায়।
সেদিন আমার চাচাতো ভাই ইসমাইলও হাটে যায়। সে আর বাড়ি ফিরে আসেনি।বিলমাড়ীয়া হাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের দেখে সে দৌড়ে পালায় এবং একটি পুকুরে লাফ দেয়। হানাদার সদস্যরাও তার পিছু নেয় এবং পানির উপরে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করে। এসব গণহত্যা দেখে গ্রামের মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা গ্রামে অবস্থান করাকে নিরাপদ মনে করেনি। বাথানবাড়ীয়া গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের জলঙ্গি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী শিবিরে অসুস্থ হলে আমি জলঙ্গির স্থানীয়দের সাথে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাই। ভারতীয় ডাক্তার সেদিন আমাকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার গ্রামে ফিরে আসি।
দেলবার হোসেন (৬৯)
পিতা:আয়েজ উদ্দীন, গ্রাম: বিলমাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর,পেশা: অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে এলাকার যুবসমাজ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমি বিলমাড়ীয়া ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলাম। এছাড়াও আজবার আলী, মজিবর রহমান, আলী আকবর, কদম রসুলসহ অনেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।বিলমাড়ীয়া গণহত্যা আমার দেখা সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে সময়টি ছিল হাটের দিন, মঙ্গলবার। আছরের নামাজের কিছু আগে হঠাৎ হানাদার বাহিনী হাটে প্রবেশ করে। এসময় ১০/১৫ জন বাঙালি বাহার, ছাদেক (মোমিনপুর), রফিক, লায়েব (বিলমাড়ীয়া), জামসেদ (বাথানবাড়ীয়া) প্রমুখ তাদেরকে সহযোগিতা করে। হানাদাররা হাটে আগত মানুষদের মধ্যে থেকে ৩০/৩৫ জনকে আটক করে। এরপর তারা বটগাছের সাথে বেঁধে ব্রাসফায়ার করে সকলের মৃত্যু নিশ্চিত করে। আটককৃতদের মধ্যে কেউ জীবিত ছিল না। অনেকের লাশ দেখে পরিচয় নির্ণয় করাও সম্ভব হয়নি। মেজর রাজা হোসেনসহ বিহারীরা সেদিন গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিল।
গণহত্যার পর হানাদাররা হাট লুট করেছিল। স্থানীয় কিছু বাঙালিও লুটপাটে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে আহাদ, সাদেক (মোমিনপুর) অন্যতম। বাকীদের নাম মনে নেই। গণহত্যায় শহীদদের অনেককে স্বাধীনের পরে গণকবর দেয়া হয়। এই গণহত্যার ঘটনা এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ফলে বিলমাড়ীয়াসহ আশেপাশের গ্রামের ৭০০০/৮০০০ মানুষ সীমান্ত পার হয়ে জলঙ্গি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর মানুষ দেশে ফিরে আসে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বিলমাড়ীয়া গণহত্যায় শহীদ পরিবারদের মাঝে ২০০০ টাকা করে আর্থিক অনুদান দিয়েছিলেন।
মো.আজবার আলী (৬৭)
পিতা: পচাই মন্ডল, মাতা: রনজনা বেওয়া, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২ জুন ২০১৭
পাকিস্তানি সেনাবাহনীর গণহত্যার নীলনকশার ধারাবাহিকতায় বিলমাড়ীয়া গণহত্যা করে। মঙ্গলবার হাটের দিনে স্থানীয় বাহার, জমসেদ, আজের উদ্দিন, তসিকল (শান্তি কমিটির প্রধান), জামাল মৌলবীর নেতৃত্বে সেদিন মিলিটারিরা চোখ বেঁধে, শিমুল ও বটগাছের সাথে পাট দিয়ে পেঁচিয়ে ৩০/৩৫ জন নিরীহ মানুষকে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে। পাকিস্তানি আর্মিদের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর রাজা হোসেন। গণহত্যার ফলে বিলমাড়ীয়া জনশূন্য হয়ে যায়। বিলমাড়ীয়াসহ আশেপাশের গ্রামের ৫০০০/৬০০০ লোক শেখপাড়া ও জলঙ্গি শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। বিলমাড়ীয়া গণহত্যার পরে কিছু হিন্দু বাড়িতে ইছার উদ্দিন, মসলেম প্রমুখ লুটপাট করে।মাধবপুর গ্রামের কুদরতের বাড়িতে ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বিলমাড়ীয়া গণহত্যা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় হত্যাকান্ড।
শহীদ পরিবারের মৌখিক ভাষ্য
মো.হাফিজুর রহমান (৪৯)
পিতা: শহীদ মোসলেম মাস্টার, মাতা: মোছা. আকলিমা খাতুন, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১৮ জুন ২০১৯
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা বাথানবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং সে সময় আমার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। বাথানবাড়ীয়া স্কুল ছিল এই অঞ্চলের সেরা বিদ্যাপীঠগুলোর অন্যতম। সেই স্কুলের শিক্ষক হবার কারণে সমাজে তার পরিচিতি, মান-মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা অন্য দশজন মানুষ অপেক্ষা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু কোনো কিছুই তার হত্যাকাণ্ডকে আটকাতে পারেনি। আর আব্বাকে জানার, বোঝার আগেই হারিয়েছি চিরতরে। বুদ্ধি হয়ে বাবা ডাক দেয়া হয়নি আর কখনো। বাবার আদর কেমন হয় তাও জানিনা।
বড় হয়ে আমি আমার দাদা মকছেদ প্রামাণিক ও দাদী কলিজান বেওয়ার কাছ থেকেআব্বার মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারি।তাদের দেয়া তথ্য মতে, ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই মঙ্গলবার হাটের দিনে আমার বাবা সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার উদ্দেশ্যে বিলমাড়ীয়া যান। বাজার থেকে যখন সামান্য দূরেতখন পেছন থেকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়ি তাড়া করে। প্রাণ বাঁচাতে তিনি দৌড়ে আজের প্রামাণিকের দোকানে আত্মগোপন করেন।এদিকে পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে বাবাকে খোঁজাখুজি শুরু করে। তাকে না পেয়ে বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। এসময় শান্তি কমিটির সদস্য আজের প্রামাণিক ইশারায় পাকিস্তানি সেনাদের আমার বাবাকে দেখিয়ে দেন এবং তিনি ধরা পড়েন। তাকে ধরে নিয়ে বর্তমান মসজিদের সামনে লাইনে সারিবদ্ধ করে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে। লোকমুখে আমার দাদা মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লাশ নিতে ছুটে যায়। সাহস করে কেউ সেদিন লাশের কাছে এগিয়ে আসেনি। আমার দাদা সকল ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে লাশের স্তুপের কাছে এগিয়ে যায়।কিন্তু লাশ চেনার কোনো উপায় ছিল না। বাবার মাথায় গুলি লাগার কারণে দেহ থেকে অর্ধেক মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দাদা বহু কষ্টে লাশ সনাক্ত করে বাড়ি নিয়ে আসে এবং পরের দিন দাফন করা হয়।
বাবার মৃত্যুর পরে আমাদের জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ-দুর্দশা। মা কখনো আমাদেরকে নিয়ে দাদা বাড়ি, আবার কখনো দাদা বাড়ি থেকে নানা নিয়ে যেত। এভাবেই দিন যেতে থাকে। তবে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকলেও কেনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা কখনো মেলেনি। বাবার নামটি আজও সংযুক্ত হয়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। তাই দেশের কাছে কোনো চাওয়া নেই, তবে দেশ বিরোধী মানুষের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি হোক। এটাই প্রত্যশা।
মো. আবুল কাশেম মাস্টার (৬৭)
পিতা: তাহের উদ্দিন মন্ডল, মাতা: জহুরা বেগম, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: প্রধান শিক্ষক (অব.)। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১৯ জুন ২০১৯
২৭ জুলাই ১৯৭১ সাল। ইতিহাসের এই দিনে বিলমাড়ীয়া হাটে কী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল তা স্মৃতিপটে ভেসে উঠলে আজও বুক ধরফর করে। সেদিন এদেশীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায়পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিলমাড়ীয়া বাজারকে পরিণত করেছিল একটি মহাশ্মশানে। আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ যখন নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা-বেচায় মহাব্যস্ত ঠিক তখন (বেলা ৩ টা) পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী অতর্কিতভাবে হাটে আক্রমণ চালায়। বিভিন্ন স্থান থেকে ৪০-৫০ জন কে ধরে আনে কারো চোখ বেঁধে,কারো হাত বেঁধে এবং বট গাছে নিচে একত্র করে। তাদের উপর অত্যচার করে মুক্তিসেনাদের তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। কিন্তু সেদিন কেউই মুখ খোলেনি। তথ্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েএকসাথে গুলি করে সবাইকে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
সেদিন হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন আমার বড় ভাই আব্দুল আজিজ। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। পেশায় ছিলেন সাইকেল মেকার। অন্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে হাটের দিনে আয়-রোজগার একটু বেশি হতো। তাই সেদিন তিনি একটু আগেই হাটে উপস্থিত হন। সেদিন কাজ করতে করতে মনকে এতো গভীরে নিয়ে যান যে, হাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ ও মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি তিনি টেরই পাননি। যখন তিনি বুঝতে পারেন তখন প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে কিছু দূরে আখের জমিতে আশ্রয় নেন। তাতেও তার রক্ষা হয়নি। কেননা যে জমিতে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন সেই জমিটিকেপাকিস্তানি সেনারা চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে এবং তাকে টেনে-হিঁচড়ে আখের জমি থেকে বের করে আনা হয়।তারপর অন্য সবার সাথে তাকেও গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
গণহত্যার  সময়ে বাজার থেকে আমি কিছু দূরে অবস্থান করছিলাম। কিন্তু মেশিনগানের গুলির প্রচণ্ড শব্দে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। সন্ধ্যার পরে আমি বড় ভাই আব্দুল আজিজের মৃত্যু সংবাদ পাই। লাশ আনতে সেদিন তেমন কেউই এগিয়ে আসেনি। আমি কাঁধে করে আমার ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসি এবং পরের দিনে দাফন করি। লাশ দেখে বড় ভাইয়ের দুই সন্তান পলি (৮) ও রতন (৪)এবং স্ত্রী বার বার মূর্ছা যাচ্ছিল। সেদিন কোনো সান্ত্বনা তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। পিতৃহারা সন্তান দুটি জীবন সংগ্রামেও জয়লাভ করতে পারেনি। স্বাধীন দেশে শহীদ পরিবারদের জন্য অনেক কিছু করা হলেও শহীদ আব্দুল অজিজের পরিবারের প্রাপ্তির খাতাটা আজও শূন্যই রয়ে গেছে। সান্ত্বনা শুধু একটাই তারা শহীদ পরিবারের সন্তান। তবে রাষ্ট্রীয় খাতায় সেই শহীদের নামটা আজও লিপিবদ্ধ হয়নি।
মো. সাজদার রহমান (৫৫)
পিতা: শহীদ সিরাজ খলিফা,মাতা: পরিজান বেওয়া, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: কৃষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ:নিজ বাসবভন, ১৯ জুন ২০১৯
সেদিন হাটেরদিন ছিলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীস্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় অতর্কিতভাবে বিলমাড়ীয়া হাটে আক্রমণ করে এবং হাট ঘিরে ফেলে। প্রায় একশত মানুষকে তারা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছিল দোকানপাট।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ২৭ জুলাই, ১৯৭১ সাল। বাড়িতে রান্না করার মতো প্রয়োজনীয় কোন জিনিসপত্র ছিল না। আব্বা রাতের রান্নার জন্য রান্নার তেল, কেরোসিন, সবজি ও মাছ কেনার উদ্দেশ্যে বিলমাড়ীয়া হাটে যান। বেলা ৩/৪ টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি মিলিটারিরগাড়ি হাটে উপস্থিত হয়। তা দেখে আব্বা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাতে থাকে এবং মহারাজপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। এদিকে তার পেছন পেছন পাকিস্তানি সেনারাও দৌড়াতে থাকে এবং মহারাজপুরে গিয়ে তাকে আটক করে চোখ বেঁধে বিলমাড়ীয়াহাটে নিয়ে আসে। সেদিন শুধু আমার আব্বা নয় অনেককে একসঙ্গে আটক করে খোলা মাঠে বটগাছের নিচে একত্র করে এবং নির্বিচারে এই নিরীহ মানুষগুলোর উপর গুলি চালাতে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তাদের দেহে প্রাণ ছিল।গুলির প্রচণ্ড শব্দে সেদিন এলাকার পশুপাখি চিৎকার-চেঁচামেচিকরে পালাতে থাকে।
সন্ধ্যার পরে আব্বার মৃত্যুর খবর জানতে পারি। লাশ বহন করার জন্য ভগ্নিপতি মহসিন মহিষের গাড়ি নিয়ে বিলমাড়ীয়া যায়, আর তার সঙ্গে যায় আহসান, আলিমুদ্দিন মালিথা ও দেরাজ উদ্দিন প্রামাণিক। রাত ৮টার পরে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আব্বার বুকটা গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলোসেদিন লাশ দাফন করার জন্য আশেপাশে কোনো কাফনের কাপড় পাওয়া যায়নি। আমার মেঝ চাচা অমৃত পাড়ার খায়েজ খলিফার নিকট থেকে কাফনের কাপড় নিয়ে আসে এবং সেই রাতেই তাকে কবর দেয়া হয়। সেই দৃশ্য মনে হলে আজও বুক কেঁপে ওঠে।
আব্বার মৃত্যুর পরে আমরা ৮ ভাই-বোন বহু কষ্টে জীবন যাপন করেছি। অর্থাভাবে কেউই পড়া-শুনা করতে পারিনি এবং পাঁচ ভাই প্রত্যেকে আমরা কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদ পরিবারের জন্য অনুদান প্রদাণ করলেও তা থেকে আমরা বঞ্চিত হই। আজ পর্যন্ত আমরা কোনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাইনি। তবে শহীদের তালিকায় আব্বার নামটি লিপিবব্ধ হলে আমরা শান্তি পাবো।
মো. এনামুল হক (৫০)
পিতা: শহীদ আকছেদ, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা-কৃষক।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২১ জুন ২০১৭
১৯৭১ সালে আমার আব্বার বয়স ছিলো ২০ বছর। গ্রামের টগবগে যুবক। কৃষি কাজেপারদর্শী বাথানবাড়ীয়া গ্রামেরযুবকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রাবণ মাসে বিলমাড়ীয়া হাটে যাওয়ার পর তিনিআর ফিরে আসেননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি মাত্র দুই বছরের অবুঝ শিশু। বড় হয়ে হয়ে প্রতিবেশীদের নিকট থেকে আব্বার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারি। বাথানবাড়ীয়া গ্রামটি ছিলো কৃষি ভিত্তিক। গ্রামের শতভাগ মানুষ ছিলো কৃষক। হাট ছাড়া তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করা অনেকটা দুঃসাধ্য ছিলো। কেননা হাটেফসল বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যেত, তাই দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয়পণ্যদ্রব্য কেনা হতো। সেদিন ছিলো ১২ শ্রাবণ মঙ্গলবার, বাড়িতে ছিলোনা কোনো কেরোসিন ও রান্নার সবজি। আব্বা কেরোসিন ও সবজিকিনতে হাটে যায়। দুপুর তিনটার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা হাট আক্রান্ত হয়। গ্রাম থেকে আগত সহজ সরল অনেক মানুষকে তারা আটক করে ্এবং গুলি করে হত্যা করে। শহীদ সেইসব মানুষের মধ্যে আমার আব্বাও ছিলেন। পাকিস্তানিদের এই গণহত্যা সমগ্র এলাকায় ভীতির সঞ্চার করে। মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে শুরু করে। একারণে আমার আব্বার লাশটি সাহস করে বিলমাড়ীয়া হাট থেকে নিয়েআর দাফন করা হয়নি। অনেকের সাথে তাকেও সেদিন বিলমাড়ীয়ায় গণকবরে তাকে সমাহিত করা হয়। দেশ স্বাধীনের পরে অনেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও আজ অবধি আমরা বঞ্চিত। তবে ভালোলাগা এইটুকুই যে, আমার বাবার রক্তে দেশের মাটি রঞ্জিত হয়েছে এবং অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।
শওকত ইসলাম (৫৩)
পিতা: শহীদফজু থান্ডার, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা-কৃষক।সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২১ জুন ২০১৭
বুদ্ধি হবার পর জানতে পারি আব্বা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আব্বা দেখতে কেমন ছিলেন, তার আদর-ভালবাসা কেমন হয়,আব্বা ডাকের মধুরতা  কেমন, এসব বুঝতে পারিনি কখনো। অন্যদের দেখেছি তার বাবারা কিভাবেসন্তানকে আদর করে এবং ভালবাসে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। এসব দেখে দেখে বড় হয়েছি আর অগোচরে চোখের জল ফেলেছি।দেশের স্বাধীনতার পেছনে আমার মতো লক্ষ সন্তান অগোচরে চোখের জলে বুক ভাসায়, আর তার মাঝেই নিজের সান্ত্বনা খুঁজে পাই।
বড় হয়ে মা, প্রতিবেশী ও মুরব্বীদের কাছে আব্বা সম্পর্কে জানতে পারি। বাথানবাড়ীয়া গ্রামটির যোগযোগ ব্যবস্থা ছিলোখুবই অনুন্নত । রাস্তা-ঘাট উন্নত না হবার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার মানুষ নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো এই প্রত্যন্ত গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিদের গাড়ি কখনোই আসবে না। কিন্তু গ্রামে কোনো হাট-বাজার ছিলো না। কোনো কিছু কিনতে হলে গ্রামের মানুষকে লালপুর অথবা বিলমাড়ীয়াতে যেতে হতো।
সেদিন ছিলো মঙ্গলবার, বিলমাড়ীয়ার হাটের দিন। আব্বা চৈতালি ফসল বিক্রি করার জন্য আকছেদ চাচার সাথে বিলমাড়ীয়া হাটে যায়।দুপুর তিনটার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা হাটে উপস্থিত হয়। মিলিটারিদের দেখে সহজ-সরল মানুষগুলো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকে প্রাণ ভয়ে দৌড় দেয়, পুকুরে লাফ দেয় এবং আখের জমিতে আত্মগোপন করে। কিন্তু কেউ এসব করে তাদের জীবনকে রক্ষা করতে পারেনি। আমার আব্বাও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। ধৃত সকলকে তারা এক সাথে চোখ-মুখ বেঁধে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে। রাত দশটার দিকে আমরা মৃত্যুর সংবাদ পাই এবং জানতে পারি যে, বাথানবাড়ীয়া গ্রামের আকছেদ, ইসমাইল, ফজু থান্ডার ও ছাত্তার মন্ডলসহ অনেকেই পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। পুরো গ্রাম শোকে বিহ্বল এবং ভীত সন্ত্রস্ত। বাড়ি থেকে বিলমাড়ীয়া হাট পাঁচ কিলেমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় কেউ লাশ আনার সাহস করেনি। আকছেদ চাচার মতো আমার আব্বাকেও বিলমাড়ীয়া গণকবরে সমাহিত করা হয়।
আব্বার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কেটে গেছে। টাকার অভাবে স্কুলে যাওয়া হয়নি। তাই নিজেও আজ বাবার মতো কৃষি কাজ করি।
দেশ স্বাধীন হবার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকার ২০০০ টাকার অনুদান ও একটি সনদ দিয়েছিলেন। নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ির সাথে বঙ্গবন্ধুর দেয়া সনদটিও হারিয়ে গেছে।
শহীদ পরিবারের জীবন সংগ্রাম: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি রক্তস্নাত ইতহাস। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা।স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও শহীদ পরিবারগুলো আজও যথাযথ মূল্যায়িত হয়নি। বিলমাড়ীয়া গণহত্যার শহীদ পরিবারগুলোর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা যেন এক বেদনাদায়ক উদাহরণ।মুক্তিযুদ্ধের পর অর্থকষ্ট, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, অভিভাবকহীন শহীদ পরিবারেরজীবন ছিল শরনার্থীর চেয়েও কঠিন।
বিলমাড়ীয়া গণহত্যার দিন থেকেই শহীদ পরিবারগুলোর দুর্দশার যাত্রা শুরু হয়। সেদিন অনেকে তাদের স্বজনেরমৃতদেহ দাফনের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই মৃতদেহকে  দাফন করার মতোপ্রয়োজনীয় সংখ্যক মানুষকেখুঁজে পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে হাসমত উল্লাহ মোল্লা বলেন ‘এই গণহত্যার ফলে এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। লাশ দাফনকার্য করার মতো কোনো লোককে সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি সিরাজ খলিফার দাফনের জন্য তিন মাইল বুকপানি পথ অতিক্রম করে বিসম্ভরপুর থেকে কাফনের কাপড় নিয়ে আসি এবং দাফনের কাজ সম্পন্ন করি।’
গণহত্যারফলে বেশিরভাগ পরিবার অভিভাবক শূণ্য হয়ে পড়ে।অভিভাবক না থাকা এসব পরিবারের সদস্যদের জীবন যাযাবরে পরিণত হয়। শহীদ পরিবারের সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন ‘আব্বার মৃত্যুর পর মা আমাদেরকে নিয়ে চরম বিপদে পড়ে যান। তিনি আমাদেরকে নিয়ে একমাস নানার বাড়ি থাকেন আবার একমাস পর দাদার বাড়ি ফিরে আসেন। এভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনগুলো পার করে বড় হয়েছি।’
গণহত্যায় নিহতদের বেশিরভাগ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।তাদের অনুপস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা চরম দুর্দশার মাঝে পড়ে যায়। দুবেলা দুমোঠো খাবার যোগাড় করতে গিয়ে অধিকাংশ শহীদ পরিবারের সদস্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হন। শহীদ পরিবারের সদস্য সাজদার হোসেন বলেন ‘আব্বার মৃত্যুর পর ৮ ভাই-বোনের ভবিস্যৎ চরম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের তিনবেলার খাবার যোগাড় করতে গিয়ে আমরা কেউইপড়াশুনা করতে পারিনি। আমরা পাঁচ ভাই প্রত্যেকে হয়েছি কৃষক।’
শহীদ পরিবারের আরেক সমদ্য শওকত ইসলাম বলেন, ‘আব্বার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কেটে গেছে। টাকার অভাবে স্কুলে যেতে পারিনি। নিরক্ষরতার অভিশপ্ত জীবন আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদ পরিবারের অনেক সদস্যকে ২০০০ টাকা ও একটি সনদ প্রদান করেন। শহীদ পরিবারের সদস্য শওকত ইসলামের তথ্য মতে‘দেশ স্বাধীন হবার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকার ২০০০ টাকার অনুদান ও একটি সনদ দিয়েছিলেন। নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ির সাথে বঙ্গবন্ধুর দেয়া সনদটিও হারিয়ে গেছে।তবে জীবন চলার জন্য দুই হাজার টাকা পর্যাপ্ত নয়, সাময়িক সহায়তা মাত্র।’
স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়াস: সারা দেশের অধিকাংশ বধ্যভূমি, গণহত্যা-নির্যাতন কেন্দ্রের মতো বিলমাড়ীয়া গণহত্যার স্থানটি নিদারুণ উপেক্ষার শিকার হয়। ১৯৭২ সালে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আলী আকবর, দেলবার হোসেন, কদম রসুল, আজবার আলী প্রমুখের উদ্যোগে এখানে নির্মিত হয় একটি শহীদ মিনার, যা অদ্যাবধি বর্তমান। শহীদদের নামের তালিকা শহীদ মিনারে স্থান পায়নি এবং যে বটগাছটিতে বেঁধে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করা হয়েছিল সেই বটগাছটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগওগ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তীকালে বটগাছটি কেটে সেখানে নির্মিত হয়েছে বিলমাড়ীয়া বাজার জামে মসজিদ। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় উদ্যোগে ২৭ জুলাই গণহত্যা দিবস স্মরণ করা হয়।
সরকার সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের সব বধ্যভূমি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাই লালপুর উপজেলার বিলমাড়ীয়া এলাকাটিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। এখানে নির্মাণ করা উচিত একটি স্মৃতিসৌধ। এই সৌধের গায়ে লিপিবদ্ধ থাকবে বিলমাড়ীয়া গণহত্যার ইতিহাস। মানুষ জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য মানুষের আত্মদানের কথা।
মূল্যায়ন: বিলমাড়ীয়া গণহত্যা নাটোর জেলার মুক্তিযুদ্ধের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। এখানে লুন্ঠিত হয়েছে মানবতা, লুন্ঠিত হয়েছে মনুষ্যত্ব। গণহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা পরিকল্পিত গণহত্যা। ৩০ মার্চ ময়নার প্রান্তরে ২৫ নম্বর রেজিমেন্টের পরাজয় ও ধ্বংসের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লালপুর উপজেলার গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করে। বিলমাড়ীয়া একটি সীমান্তবর্তী স্থান। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র এনে এখানকার স্থানীয়দের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্থানীয় রাজাকার ও থানার অবাঙালি পুলিশ বিলমাড়ীয়া গণহত্যার ইন্ধন দেয়। এই গণহত্যার বাঙালি সাহায্যদাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মৌলভি জামাল উদ্দিন। গণহত্যাটির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছেÑ
প্রথমত, বিলমাড়ীয়া গণহত্যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা অংশগ্রহণ করে এবং তাদেরকে অঞ্চলিক শান্তি কমিটি ওরাজাকার আলবদর সাহায্য-সহযোগিতা করে।
দ্বিতীয়ত, গণহত্যা সংঘটিত দিনটি হাটের দিন হওয়ায় বিভিন্ন গ্রামের বহু সংখ্যক মানুষ হাটে আসে এবং হানাদার বাহিনী খুব সহজেই তাদেরকে আটক করে।
তৃতীয়ত, বিক্রয়ের জন্য আনা পাট দিয়ে আটককৃত ব্যক্তিদেরকে বট গাছের সাথে বেঁধে ব্রাসফায়ার করে মৃত্যু নিশ্চিত করা।
চতুর্থত, গণহত্যার পর হাটের সমস্ত পাটের গোডাউনে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া।
পঞ্চমত, এই গণহত্যায় যারা শহীদ হন তারা বিভিন্ন অঞ্চলের লোক।
ষষ্ঠত, গণহত্যায় শহীদদের অনেকের লাশ উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো এবং এগুলো শকুন, শেয়াল ও কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়।
সপ্তমত, গণহত্যার ফলে গ্রামের জীবিত অবশিষ্ট লোকজন ও পার্শ্ববর্তী মোহরকয়া, বাথানবড়ীয়া গ্রামের ৫-৭ হজার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের জলঙ্গি ও শেখপাড়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে যোগ দিয়ে দেশে ফিরে এসে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় নিশ্চিত হবার পর বিলমাড়ীয়া গ্রামবাসী বাড়ি ফিরে আসে। নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ায় শহীদ পরিবারগুলো।

তথ্যপঞ্জি
গ্রন্থ
কালীনাথ চৌধুরী, রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঢাকা: গতিধারা, ২০১৪
সিরাজুল ইসলাম (সম্পা.), বাংলাপিডিয়া, খণ্ড ১২, ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৩  
শামসুজ্জামান খান (সম্পা.), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা নাটোর, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১৪
সমর পাল, নাটোরের ইতিহাস, ঢাকা: গতিধারা, ২০১৩
সুজিত সরকার, নাটোর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রাজশাহী: ধ্রুব, ২০১০
হামিদুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস নাটোর জেলা, ঢাকা: তাম্রলিপি, ২০১৭
পত্র-পত্রিকা
মোজাম্মেল হক, ‘আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা যোগায় লালপুরের শহীদ মিনার’, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩
মাজহারুল ইসলাম তিব্বত,‘ধ্বংস হয়েছিল পাঞ্জাব রেজিমেন্ট’, দৈনিক আমাদের সময়, ৩০ মার্চ ২০১৬
নিজস্ব সংবাদদাতা, ‘নাটোরের ময়নাযুদ্ধ প্রথম প্রতিরোধ, বাসস, ১৪ মে ২০১৭
সাক্ষাৎকার
মো.নুরুল ইসলাম (৭১), অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বিলমাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়, পিতা: হাসেন উদ্দিন প্রামানিক, মাতা: আছেনা খাতুন, গ্রাম ও ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
জমির উদ্দীন হালসানা (৭০), পিতা: এরশাদ হালসানা, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা-কৃষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
মো. হাসমত উল্লাহ মোল্লা (৭৮), পিতা: নছির উদ্দিন মোল্লা, মাতা: হাছিমন বেওয়া, গ্রাম: মোমিনপুর, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। পেশা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্মী (অব.)। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২৮ জুন ২০১৭
আমেনা বেগম (৬০), স্বামী: যাদু মন্ডল, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। পেশা: গৃহিণী, সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
দেলবার হোসেন (৬৯), পিতা:আয়েজ উদ্দীন, গ্রাম: বিলমাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
মো.আজবার আলী (৬৭), পিতা: পচাই মন্ডল, মাতা: রনজনা বেওয়া, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২ জুন ২০১৭
মো.হাফিজুর রহমান (৪৯), পিতা: শহীদ মোসলেম মাস্টার, মাতা: মোছা. আকলিমা খাতুন, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১৮ জুন ২০১৯
মো. আবুল কাশেম মাস্টার (৬৭), পিতা: তাহের উদ্দিন মন্ডল, মাতা: জহুরা বেগম, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: প্রধান শিক্ষক (অব.)। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১৯ জুন ২০১৯
মো. সাজদার রহমান (৫৫),পিতা: শহীদ সিরাজ খলিফা, মাতা: পরিজান বেওয়া, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: কৃষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১৯ জুন ২০১৯
মো. এনামুল হক(৫০), পিতা: শহীদ আকছেদ, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: কৃষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২১ জুন ২০১৭
শওকত ইসলাম (৫৩), পিতা: শহীদ ফজু থান্ডার, গ্রাম: বাথানবাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: কৃষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ২১ জুন ২০১৭
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
শহীদ এবং গণহত্যা-নির্যাতনকারীর তালিকা প্রস্তুতে সহায়তা করেছেন-
মো.আজবার আলী (৬৭), পিতা: পচাই মন্ডল, মাতা: রনজনা বেওয়া, গ্রাম: মোহরকয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ০২ জুন ২০১৭
মো.নুরুল ইসলাম (৭১), অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বিলমাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়, পিতা: হাসেন উদ্দিন প্রামানিক, মাতা: আছেনা খাতুন, গ্রাম ও ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
দেলবার হোসেন (৬৯), পিতা:আয়েজ উদ্দীন, গ্রাম: বিলমাড়ীয়া, ইউনিয়ন: বিলমাড়ীয়া, উপজেলা: লালপুর, জেলা: নাটোর, পেশা: অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ১ জুন ২০১৭
মো. আলী আকবর (৬৫), কমান্ডার,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, লালপুর উপজেলা সংসদ, মোমিনপুর, লালপুর, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসভন, ৩০ মে ২০১৭
মো.আকিয়াব হোসেন (৭০),পিতা: দেলোয়ার হোসেন,লালপুর বাজার সংলগ্ন, জেলা: নাটোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্থান ও তারিখ: নিজ বাসবভন, ৩ জুন ২০১৭

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top