logo
news image

ইতালির শিক্ষা আমাদের কাজে লাগাতে হবে

অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল।।
আমি যখন লেখাটি লিখছি তখন বাংলাদেশ সময় ২৫ মার্চ দুপুর ১টা। করোনা ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত সংখ্যা হলো চার লাখ ২৩ হাজার ৭২৪ জন। মারা গিয়েছেন ১৮ হাজার ৯২২ জন। আর সুস্থ হয়েছেন এক লাখ নয় হাজার ১৭২ জন। লেখাটি যখন ছাপা হবে তখন হয়তোবা মৃত সংখ্যা ১৯ হাজারে পৌঁছাবে।
চীনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলেও এর জন্য করুণ পরিণতির শিকার হতে হয়েছে ইতালির মানুষজনকে। সেখানে ইতোমধ্যে ছয় হাজার ৮২০ জন মারা গেছেন। আরও আট হাজারের অবস্থা সংকটাপন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে এটাকে সারাবিশ্বের জন্য মারাত্মক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। যা দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।
ইতালিতে ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন মারা যান। সংবাদপত্রে লেখা হয়: ‘ইতালির পদুয়া শহরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এই প্রথম একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর পরপরই দেশটির ১০টি শহর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয় জনসমাগমস্থলে যাওয়া। দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৭-তে পৌঁছেছে।’ আর আজ ২৪ মার্চ অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে  মৃত সংখা ছয় হাজার অতিক্রম করেছে। সেটা কতোতে গিয়ে ঠেকবে কে জানে? ইতালির অসহায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ’আমরা প্রাণপণ চেষ্ঠা করেছি। এখন আমাদের আকাশের দিকে থাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী করার আছে?
কী ঘটেছিল ইতালিতে? তারা শুরুতে বললো, এটাতে কেবল বিদেশফেরত বিশেষত: চীন ফেরতরা আক্রান্ত হবেন। যুক্তি হলো ৩১ জানুয়ারিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত দুজনই চীনা পর্যটক। পরের সপ্তাহে অবশ্য একজন ইতালিয়ান আক্রান্ত হন। তিনিও চীনের উহান শহর থেকে ফিরেছেন।
তবে ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাদের এ ভুল ভাঙলো। আর তাতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। ওই সময় লোম্বার্ডিতে ১৬ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়। যাদের বেশির ভাগই ইতালিয়ান। শুরুতে ইতালি সরকার কিছুটা ধীর চলা নীতি অনুসরণ করে। প্রথমে শহর, পরে প্রদেশ, পরে সারা দেশ লকডাউন করে। এছাড়া লোকজনের কথা-বার্তাও ছিল মিশ্র ধরনের।
তাদের শিল্পকারখানাও শুরুতে বন্ধ ঘোষণা করেনি। যা করোনা ভাইরাসকে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ইতালির লোম্বার্ডি প্রদেশের গভর্নর আত্তিলো ফন্টানা ২৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে মন্তব্য করেন ‘এটা সাধারণ জ্বর থেকে সামান্য একটু বেশি’। আর এ মন্তব্যের পরদিনই শহরে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। এখন এই প্রদেশেই করোনা পরিস্তিতি সবচেয়ে ভয়াবহ।
অপরদিকে, যখন একের পর এক শহর ও প্রদেশ লকডাউন হওয়া শুরু হয়, তখন মিলানের গভর্নর ‘মিলান বন্ধ হবে না’ স্লোগান নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। যার ফলে নাগরিকরা হয়ে পড়েন বিভ্রান্ত। এর খেসারত মিলান আজ সহস্র জীবন দিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া শুরুতে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করতেও তাদের প্রচুর সময় লাগে।
আশা করি পাঠকরা বুঝে উঠতে পেরেছেন ইতালি থেকে আমাদের দূরত্ব কতদূর। আমরা শেষপর্যন্ত অফিস আদালত বন্ধ করলাম। কিন্তু বেশ দেরি হয়ে গেলো। আবার আমাদের সবচেয়ে বড় সেক্টর গার্মেন্টস কিন্তু বন্ধ করা হলো না। সেটা প্রধানমন্ত্রী গার্মেন্টস মালিকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মানুষের চরিত্র আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানার কথা না। যেখানে গার্মেন্টস সেক্টরের নূন্যতম বেতন আপনাকে ধার্য্য করে দিতে হয়, সেখানে কীভাবে আপনি আশ্বস্থ হবেন, তারা বিবেকের দ্বারা তাদের উৎপাদন বন্ধ করবেন।
এখন আসা যাক, আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে। করোনা করোনা কিন্তু আমরা তিন মাস ধরে শুনে আসছি। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা বার বার বলেছেন, আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু এখন কী দেখলাম? যারা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামনের কাতারের যোদ্ধা, আমাদের সেই চিকিৎসক ও সেই খাতের কর্মীরাই নিরাপদ না। তাদের গ্লাভস নেই, মাস্ক নেই, পিপিই নেই। সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল তো বলেই দিয়েছে, তারা এসব সরবরাহ করতে পারবে না। এছাড়া নেই কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালও। করোনা আক্রান্ত সন্দেহ রয়েছে এমন রোগীরা কোথায় যাবেন? এরকম দিকনির্দেশনা কী জনগণ এখন পর্যন্ত পেয়েছেন? কিছুক্ষণ পূর্বে দেখলাম ঢাকার কয়েকটি হাসপাতাল প্রস্তুতের খবর।
সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কীভাবে বলেন আমরা চীনের মতো একটি হাসপাতাল বানিয়ে ফেলব। দেশের একজন মন্ত্রী কোন দায়িত্বে বলেন কেউ কেউ দেশে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, আসলে করোনা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ না।
যাহোক, আমরা অসহায়। আমাদের সরকারি আপডেট বিশ্বাস করতে হয়। সরকার আমাদের যে আপডেট দিচ্ছে, তাতে সারাদেশে ৩৯ জন আক্রান্ত। চার জন মারা গেছেন। প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার সুস্থও হচ্ছেন। এগুলো কী করোনার গ্রামারের সঙ্গে যায়? আমাদের এটা বিশ্বাস করেই থাকতে হবে।
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, করোনা আতঙ্কের মধ্যে অনেক সাধারণ রোগী যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারা যাবেন। আবার অনেক করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে না গিয়ে নিজ বাসায় আরও অনেককে সংক্রমিত করে মারা যেতে পারেন। এগুলো একটু বিবেচনায় এনে আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।
এবার আসা যাক, আমরা আমজনতা কী করছি, তাতে। আমরা দল বেঁধে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, প্রচারপত্র ইত্যাদি বিলি করছি। করোনা সচেতনতায় সভা করছি। অথচ এর সবকটিই করোনা সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমি তো মাইকে প্রচারেও পক্ষপাতী না। মাইক প্রস্তুত করা, মাইকিংয়ের যানবাহন প্রস্তুত করা, লোকজনকে মাইকিংয়ে পাঠানো, এগুলোও কী ঝুঁকির মধ্যে পড়ে না? অথচ আমরা পাড়ার মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জিন বা ইমামের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে পারি।
আমাদের আরও অনেক দ্বায়িত্বহীনতা রয়েছে। ঘোষণাটি হওয়া উচিত ছিল, কেউ স্টেশন লিভ বা কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবে না। স্কুল-অফিস বন্ধ হলো, আর আমরা সবাই গ্রামে ছুটলাম। কমলাপুর স্টেশন ও দূরপাল্লার বাসটার্মিনাল দেখে মনে হচ্ছে এটা ঈদের ছুটি। সবাই গ্রামে গিয়ে আড্ডায় মিলিত হচ্ছে। আমার অনেক ছাত্র আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, স্যার গ্রামের মানুষ এগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে। সবাই দোকানে, বাজারে বসে আড্ডা দেয়। খেলাধুলা করে। একজন আরেক জনের বাসায় বেড়াতে যায়। দাওয়াত খায়। একজন আরেক জনের বাসায় আড্ডা দিতে আসে। অবশ্য আড্ডার বিষয় করোনা ভাইরাস।
আমার তাদের জন্য করুণা হচ্ছে। দেখা যাক, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আমাদের পরিস্থিতির উন্নতি হয় কি-না।
* ড. জহিরুল হক শাকিল: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top