বারোমাসী নেগী পেঁয়াজ আবাদে সমাধান
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম। ।
লাগামছাড়া পেঁয়াজের দর এখন দেশের সর্বত্র। বার বার পেঁয়াজের দর বৃদ্ধিতে ভোক্তারা ভীষণ উদ্বিগ্ন ও ত্যাক্ত-বিরক্ত। প্রতিবছর মৌসুম পেরুলেই বিশেষ একটা সময়ে রান্নার প্রয়োজনীয় এই উপাদানটির অভাব ঘটে কেন সেটাই আজকের প্রশ্ন। কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশে এখন প্রতিটি ফসলের বাম্পার উৎপাদন লক্ষ্যনীয়। তবে পেঁয়াজের সংকট দেখে মনে হয় আমরা বুঝি কৃষিতে খুব দুর্বল। আসলে কি তাই? মোটেও নয়। আমাদের কৃষি উৎপাদন সারা বিশ্বে ইর্ষনীয়। মৌসুমে আলু, ফল, পিঁয়াজ পচে যায় সংরক্ষণের অভাবে। ধান, ডিম, দুধের দাম পায়না বলে কৃষকরা রাস্তায় ছুঁড়ে আন্দোলন করে। সমস্যাটা সেখানেও নয়। সমস্যা আমাদের চতুর সোনার মানুুষগুলোকে নিয়ে যারা এগুলো নিয়ে কারবার করে ও যারা এই অতিলোভী, অতি মুনাফাখোর, স্বর্থান্বেষী কারবারীদের নিয়ে রাজনীতি করে ও অপরাজনীতি করার ক্ষেত্র তৈরী করে দেয়।
সংবাদে জানা গেল- আজ ঢাকায় পেঁয়াজের কেজিপ্রতি মূল্য ১২০ টাকা ও পীরগাছা উপজেলার বাজারে ১৪০ টাকা উঠেছে। কোথাও আবার ১৬০ টাকা বা তারও বেশী দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। শীগ্গীর পেঁয়াজের দর বৃদ্ধি হয়ে ডাবল সেঞ্চুরী হয়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। ভারতে বন্যা হওয়ায় সেখানে পেঁয়াজের দমে বেড়ে গেছে। সেই অজুহাতে আমাদের দেশে সংকট না সত্ত্বেও চল্লিশ টাকার পণ্য তিন দিনের মাথায় ১৬০ টাকা উঠে গেল! এটা নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে হৈ চৈ তো হবেই। সম্প্রতি ভারতে ইলিশ মাছ পাঠানো হয়েছে। কেউ বলছেন রপ্তানী করা হয়েছে। সেখানেকার মানুষ ৫২০ টাকা কেজিতে সেই ইলিশ কিনতে পারলেও বাংলাদেশে এত অল্পদামে ঐমানের ইলিশ কেনা অকল্পনীয় ব্যাপার। সেজন্য বিষয়টিকে- ‘সহজ-সরল একজন গ্রামীণ প্রান্তিক গৃহস্থের ডিমপাড়া মুরগীটি অতিথিকে জবাই করে দাওয়াৎ খাওয়ানোর গল্পের মত’ মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক সহকর্মী লিখেছেন- ভারতকে দিলাম ইলিশ, বন্ধ হলো পিঁয়াজ। আরেকজন সহকর্মী তার উত্তরে কৌতুক করে একটা জনপ্রিয় গানের কলি লিখেছেন- দুশমনি করো না প্রিয়তম... ইত্যাদি। পরে জানলাম প্রতিবছর ভাদ্র-আশি^নের এই সময়টাতে বাজারে ইলিশের দাম কমলে বাসা-বাড়িতে ফেরিওয়ালারা ইলিশ নিয়ে আসতো। সবাই সস্তায় ইলিশ মাছ কিনতেন এবং কিছু সংরক্ষণ করে বেশ কিছুদিন ধরে খেতেন। কিন্তু এবারে সেটা না হওয়ায় বাড়িতে ফেরিওয়ালারাও ইলিশ বেচতে আসেনি, কেনাও হয়নি তাই খাওয়াও হবে না। এই আক্ষেপ ওনাদের।
এদিকে ইলিশ রপ্তানীর কথা প্রচারের সাথে সাথেই দেশের বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে গেছে হু হু করে। সংগে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইলিশের দো-পেঁয়াজা নাকি নাকি সীমাšেতর ওপাড়ে জামাই ষষ্ঠীর জন্য রান্না করাা হচ্ছে! এদিকে অসময়ে ফারাক্কার সব গেট খুলে দেয়ায় পদ্মাপাড়ের মানুষ অকাল বন্যায় উঠতি ফসল ও বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় হায় হায় শুরু করে দিয়েছে। এটাই কি তবে নতজানু নীতির পুরস্কার?
আমাদের দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন কত? চাহিদার পরিমানই বা কত? আপদকালীন মজুদ কত পরিমান করা হয়? ঘাটতিই বা কত? জানা গেছে- আমাদের বার্ষিক পেঁয়াজের উৎপাদন ১৭ লক্ষ মেট্রিক টন। চাহিদার পরিমান ২২ থেকে ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন। স্বভাবতই: বার্ষিক ঘাটতির পরিমান ৫-৬ লাখ মেট্রিক টন মাত্র। এই সামান্য ঘাটতি তো সহজেই পুষিয়ে নেবার কথা আমদানির মাধ্যমে। তা না করে সরকার প্রতিবছর কেন এত বোকামী করছেন?
সেজন্য উৎপাদিত পিঁয়াজ-রসুন তথা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সংগে প্রয়োজনীয় আমাদের উৎপাদিত সকল কৃষিপণ্যের যথার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ফসল ঘরে তোলার মৌসুম পেরুলেও যেন বাজারে এসব দরকারী পণ্য ন্যায্যমূল্যে সবার জন্য সহজলভ্য হয় সেব্যবস্থা করা উচিত।
বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা আমাদের সবচে’ পুরনো ও বড় সমস্যা। দেশের বাজারে দেশী-বিদেশী যে কোন দ্রব্যের মেলে। কিন্তু দাম-দরের নিয়ন্ত্রণহীনতা আমাদের সবচে’ ভোগায়। দেশের সিংহভাগ মানুষের আয় কম। তাই তাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই। যেমন- পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৫০০ টাকা উঠে গেলেও তা কিনে খাবার ক্ষমতা কিছু কালো টাকার মানুষদের রয়েছে। মরণ শুধু সীমিত আয়ের সৎ মানুষদের জন্য। যাদের মাসিক ভোগ্যপণ্য কিনতে তালিকা বানিয়ে হিসেব করতে হয়। এটি নিয়ন্ত্রণে শুণ্য সহ্যসীমা কর্মসূচির আওতায় সবার আগে বাজার দর নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ববানদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত কঠোর নজরদারী দরকার। আমাদের বাজার দর নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ববানরা দু’একটি পোস্টার ছেপে ও টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে যেন দায়মুক্তি না ঘটান সেটা কে দেখভাল করবেন? তবে এক্ষেত্রে বেড়ায় দুর্নীতি করার প্রবণতাকেও কঠোর নজরদারীর আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ‘সকলি গরল ভেল’- হতে পারে।
কৃষিতে বাম্পার ফলন হলে পিঁয়াজ-রসুন-আদা ইত্যাদির জন্য কি উচ্চতর গবেষণা হয় না? তাহলে এগুলোর উৎপাদনে এখনও ঘাটতি কেন? চীন, জাপানের মত ‘নাগানেগী’ বা বারোমাসী লম্বা পিঁয়াজ- রসুনের চাষ করা হচ্ছে না কেন? আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় সহজেই এর চাষাবাদ করা যেতে পারে।
এসব বারোমাসী লম্বা পিঁয়াজ- রসুনের আবাদ বাড়ির আঙিনায়, আশেপাশের ফাঁকা জায়গা এমনকি টবের মধ্যেও করা যায়। চীন, কোরীয়া, জাপানের মানুষেরা বাগান থেকে ‘নাগানেগী’ তুলে পাতা ও গাছশুদ্ধ রান্নায় ব্যবহার করে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর উৎপাদন ও ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। তবে এখন কেন আমরা প্রতিবছর পিঁয়াজ-রসুন-আদার দাম বাড়িয়ে দিই? কেনই বা এসব কৃষিপণ্যের বেশী দাম শুনে হা পিত্যেশ করি? আমাদের কৃষি বিশববিধ্যালয়গুলো এদিকে নজর দিয়ে গবেষণা করতে পারেন, যেন আমাদের আবহাওয়া অনুকুল এসব মশলা জাতীয় কৃষিপণ্যের উপাদন ও বিপনণ সহজে করা যায়।
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে শুধু প্রধান খাদ্যের উৎপাদন করা নয়। সব ধরনের প্রয়োজনীয় খাদ্যের উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বন্টন, ভোগ ও ব্যক্তিগত ও পাবলিক এমিনিটি তথা স্বাচ্ছ্যন্দ্য লাভ করে সুস্থ্য থাকাকে বুঝায়। তাই যতেœর সাথে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সব মানুষের কল্যানে জরুরীভাবে পেঁয়াজ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় মশলাসহ “খাদ্য নিরাপত্তা নীতি” সংশোধন করতে হবে এবং আমাদের আবহাওয়া সহিষনু বারোমাসী লম্বা ‘নেগী’ বা পেঁয়াজ আবাদের দিরে জোর দিতে হবে- এটাই এই সময়ের জরুরী প্রত্যাশা।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
সাম্প্রতিক মন্তব্য