logo
news image

নজরদারী ক্যামেরা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।  ।  
পাহারাদারদের ধরন পাল্টেছে সারা বিশ্বের সব জায়গায়। আজকাল আকাশ, বাতাস, অন্তরীক্ষে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন কৃত্রিম পাহারাদাররা দিবারাত্রি সক্রিয়। এরা প্রকাশ্যে ও গোপনে জানা ও অজানা সব বিষয়েরই নজরদারী করে যাচ্ছে। আকাশে ড্রোন, মহাকাশে স্যাটেলাইট, সমুদ্রতলে সাবমেরিন কেবল ওৎ পেতে আছে নজরদারী করার জন্য -দিবারাত্রির প্রতিটি প্রহর।
নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিশেষত: সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে ধরার জন্য ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন বা সিসিটিভি চালু হয়েছিল। এক সময় শুধু সরকারী অতি গোপন কাজে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ব্যবহৃত হতো দামী এই ক্যামেরা। তখন এর ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখন সারা পৃথিবীতে সস্তা ক্যামেরায় নিরাপত্তা নজরদারী বিস্তৃত হয়েছে। অফিস-আদালত, বাড়ি-ঘর, বাজার-ঘাট, ক্ষেত-খামার, পরীক্ষার হল সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে নজরদারী করার দায়িত্ব পেয়েছে ক্যামেরা। ওৎপাতা এসব ক্যামেরা কখনও জানান দিয়ে কখনও গোপনে বসানো হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য চুরি ঠেকানো, কখনোবা অন্যের গোপনীয়তা চুরি করা। ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন বা সিসিটিভি এখন মানুষের বিশ্বস্ত সহচর ও অতন্দ্র প্রহরী।
কোথাও নিরাপত্তার জন্য দুর্ভেদ্য দেয়াল দেয়া। তাতে কী? ঘরে বসে থেকে আকাশে পাতানো হাজার কি.মি. দূরের স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটিতে মানুষের বসতভিটা ও গোপন আস্তানার খবর আর গোপন থাকছে না। আগেকার দিনে কেউ গোপন কথা জোরে বললে বলা হতো-আস্তে বলো। দেয়ালেরও কান আছে। কেউ শুনে ফেলবে তোমার কথা! এখন ধরে নেয়া হয় কোন কোন শক্তিশালী গোপন ক্যামেরা দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে সবকিছুর ছবি রেকর্ড করে ফেলতে পারে। মানুষের হাড়-মাথা স্ক্যান করে কোথায় কি সমস্যা আছে তা জেনে রোগ নির্ণয় করার প্রযুক্তি বহুদিন আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। নিজেকে আড়াল করার জন্য মানুষ মুখোশ পরে চলাফেরা করা শুরু করলেও সেটাও এখন নিরাপদ নয়। এখন কেউ মুখোশ পরে থাকলেও আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ক্যামেরার কাছে তার চেহারা গোপন রাখার উপায় নেই। যদিও র‌্যালী-মিছিলে মুখোশ পরা নিষেধ থাকে।
সিসিটিভি ক্যামেরা চব্বিশ ঘন্টা চালু থেকে জীবন, জান-মাল সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্যবহারকারীর বিশ্বস্ততা লাভ করায় এর ব্যবসা বেড়েছে ও বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে সারা বিশ্বে।
মুখমন্ডল চিহ্নিত করতে পারে ও নির্ভুল তথ্য দিয়ে সবকিছু নিমিষেই শনাক্ত করে দিতে পারে এই অতন্দ্র মেশিন! সম্প্রতি উত্তর-পশ্চিম চীনের শিনজিয়াং শহরের রাস্তায় উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষের চলাফেরার ওপর নজরদারী শুরু করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে। রাস্তায় সন্দেহভাজন লোকদের মুখমন্ডল চিহ্নিত করে ঘরে বসে তাদেরকে পাকড়াও করার প্রবণতা শুরু হয়েছে। বিশেষত: সরকারবিরোধী ও সংখ্যালঘুরা এই কারণে বিপদে পড়ে গেছে। কোন কোন জায়গায় নিরপরাধ সাধারণ মানুষেরা সিসিটিভি ক্যামেরার অবৈধ নজরদারিতে পড়ে অসহায়ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।
ভয়ংকর দিক হলো অতি দ্রুত পৃথিবীর ৭.৭ বিলিয়ন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে মাত্র সাত কোটি মানুষ! কারণ পৃথিবীর মোট সম্পদের মালিকানা চলে গেছে স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে। এরা সম্পদের মালিকানা লাভ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার অথিকারী হয়েছেন। সেই সাথে সিসিটিভি ক্যামেরার বহুল ব্যবহারকারী ও নিয়ন্ত্রক হয়েছেন।
কথা হলো- সিসিটিভি ক্যামেরা এতটা ক্ষমতাধর হয়েছে, এতকিছু নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য লাভ করেছে কিন্তু মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি কমছে না কেন?
সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত, মানসিক ইত্যাদি সকল সমস্যাই যেন হু হু করে বেড়ে চলেছে! যেমন, মাদকদ্রব্য সভ্যতার জন্য অভিশাপ। এর উৎপাদন, সরবরাহ, বিপনন, ব্যবহার ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে সিসিটিভি ক্যামেরা। আমাদের সীমান্ত পথে, এয়ারপোর্ট দিয়ে, নদী ও সমুদ্রপথে মাদকদ্রব্য চোরাচালান হয়ে আসে। জীবন্ত পাহারাদারগণ রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুিময়ে পড়তে পারেন। কিন্তু ক্যামেরা তো ঘুমায় না। তবে দেশে দেশে সীমান্ত পথ তথা মাদক ঢোকার রুটগুলোতে প্রকাশ্যে বা গোপন ক্যামেরা বসানো নেই কেন? আর যেগুলো বসানো রয়েছে সেগুলো সচল নয় কেন? অথবা অচল করে রাখা হয় কেন?
সিসিটিভি ক্যামেরার বহুল ব্যবহার শুরু হলেও এর সীমাবদ্ধতাও অনেক। যন্ত্র সবকিছু একাই করতে পারে না। এছাড়া যন্ত্রের অপব্যবহার অনেক। অনেক দুষ্ট মানুষের হাতে এসব উপকারী যন্ত্রগুলো বড্ড অসহায়। সেজন্য সিসিটিভি ক্যামেরার বহুল অপব্যবহার লক্ষ্যণীয়। তাইতো সুইসাইডের ঘটনায় অদ্যাবধি কোন সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সুইসাইডকারীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। সুইসাইডকারীরা সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটায়।
স্পাই সিসিটিভি ক্যামেরা ভিডিও করে কোন গাড়িকে শনাক্ত করতে পারলেও গাড়ির নম্বরপ্লেট আসল না ভুয়া তা বলতে পারে না। ক্যামেরা তো আর মানুষের মত চাতুরী বুঝে না। চতুর মানুষ গোপনে ক্যামেরা পেতে রেখে মানুষকে প্রতারিত করে থাকে। তাইতো স্পাই সিসিটিভি ক্যামেরা নিরপরাধী মানুষের গোপন ছবি তুলে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন হোটেল, টর্চার সেল, ট্যুরিষ্ট স্পট, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদিতে স্পাই সিসিটিভি নজরদারী ক্যামেরা যৌনতার ছবি তুলে ও প্রচার করে ‘নগ্নবাদ’ সৃষ্টি ও প্রচারে প্রভূত ভুমিকা রেখে চলেছে। এগুলো নিরীহ জনগণের মাঝে ‘চিলিং ইফেক্ট’ সৃষ্টি করে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরী করে থাকে। অবাধ ‘নগ্নবাদ’ যুক্ত বিশে^র দামী দামী শহরগুলোতে যদি চীনের রাস্তার মত সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয় তাহলে সারা বিশে^র মানুষের নিকট কোন লাজ-লজ্জা বলে কিছু থাকবে না। এখনও এসব ক্যামেরা অবাধে পাতার তেমন কোন  বিধি-নিষেধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কারণ, যৌনতার ক্ষেত্রে সেসব দেশের মানুষ এখনও বেশ স্বাধীন। এখনও মানুষের অবাধ চলা ফেরার অধিকার হরণ করার বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকরী আইন তৈরী হয়নি। কিন্তু সেই সকল কৃষ্টি যদি গণতন্ত্রের অবাধ চর্চ্চার নামে ইন্টারনেটের বদৌলতে হঠাৎ উপমহাদেশে চলে আসে তাহলে অনাচার ঘটে অতি দ্রুত সামাজিক ভাঙ্গন সৃষ্টি হতে পারে।
সিসিটিভি ক্যামেরার বহুল ব্যবহার শুরু হবার পর এর উৎপাদন বেড়ে গিয়ে দাম কমে গেছে। কিন্তু এর স্থাপন খরচ ও মেইন্ট্যানেন্স খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্দুৎ সরবরাহ না থাকলে ও আইপিএস-এর ব্যাটারী সচল না থাকলে এর সেবা বিঘ্নিত হতে বাধ্য। আমাদের দেশের মত অবস্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা থেকেও ভাল সেবা পাওয়া দুষ্কর।
এছাড়া আমাদের দেশে অফিস-আদালতে সিসিটিভি ক্যামেরার জন্য বাজেটে রাখার প্রচলন এখনও তেমন হয়নি। আমাদের গোটা সীমান্তে মাদকের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে সিসিটিভি ক্যামেরার প্রয়োজনীয় বাজেট এখনও পাওয়া যায়নি। অথচ বৃটেনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বাজেটের ২০% সিসিটিভি ক্যামেরায় খরচ করা হয়ে থাকে।
তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ও ভয়ংকর রিস্ক হলো- অপরাধীরাও তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকার বা পুলিশের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এজন্য অপরাধীদের বাজেট বেশী, মেধা প্রখর, প্রযুক্তিও অত্যাধুনিক। তাই তারা বেশী বেপরোয়া। এদের বেপরোয়া গতিকে রোখার ওপর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সন্ত্রাস দমন নির্ভর করছে।
কথা হলো- রক্ষক যখন তখন ভক্ষক হয় কেন? বেড়া যখন ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলে অথবা রক্ষক যখন গণতন্ত্র চর্চার কথা ভুলে যায় তখন সাধারণ মানুষের জন্য তার কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। সেজন্য তার কাজের জবাবদিহিতারও বালাই থাকে না। এভাবে রক্ষক ভক্ষক হয় ও মানুষকে নির্যাতন করে ও স্বভাবতই: নির্যাতিত হবার ভয় পায়। ফলে নিজ নিজ কৃৎকর্মের পরিণাম হিসেব করে জানা-অজানা আতঙ্ক থেকে শুরু হয় মানুষের ওপর খবরদারী। এজন্য ভক্ষকের সবসময় অস্থিরতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে গিয়ে নজরদারী ব্যবস্থাকে জোরদার না কারে উপায় থাকে না। এভাবে মানুষের ওপর আস্থা ও বিশ^াস হারানো থেকে ক্যামেরার ওপর নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে এক শ্রেণির শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে।
এভাবে নজরদারী ক্যামেরায় বিশ^শাসন ও গোপনীয়তা হরণ করার প্রচেষ্টায় শামিল হচ্ছে ভালো মানুষগুলোও। গোপনীয়তা হরণ করার প্রচেষ্টায় শামিল হওয়া মানুষগুলোর লজ্জা, ঘৃণা, ভয় কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। এরা আদিম উন্মত্ততায় মত্ত হয়ে সব ধরণের অপরাধের সংগে জড়িয়ে পড়ছে এবং মানবতার চরম সংকট তৈরী করে বিশ্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রন্তে ঠেলে দিতে মোটেও কুন্ঠিত হচ্ছে না।
বিশ্ব মানবতাকে এই সংকট থেকে মুক্ত করার জন্য মানুষের মধ্যে বিবেকের তাড়না জাগানিয়া কর্মসূচি নিয়ে সময় থাকতে বেশী বেশী করে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের ভাল মানুষগুলোকে।
তা না হলে চীনের শিনজিয়াং শহরের রাস্তার মত বিশে^র সব জায়গায় মানুষের গোপনীয়তা হরণের মহোৎসব শুরু হয়ে যাবে অচিরেই। তখন মুখমন্ডল ঢাকার জন্য মুখোশ ব্যবহার করে রাস্তায় চলতে গেলেও লাভ হবে না।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top