logo
news image

মায়ের কাছে যাব

প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ডেস্ক।  ।  
"১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ছোট্ট রাসেলকে। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে ঘাতকরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল! যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসেখেলে বড় হয়েছে, তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল- কী কষ্টই না ও পেয়েছিল! কেন কেন কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল? আমি কি কোনোদিন এই 'কেন'র উত্তর পাব?"
ছাত্রলীগের বার্ষিক প্রকাশনা 'মাতৃভূমি-২০১১'-এ প্রকাশিত 'রাসেল, রাসেল তুমি কোথায়' নামের লেখায় ছোট ভাই শেখ রাসেলকে এভাবেই স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য এই শেখ রাসেল- যিনি মাত্র দশ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে ঘাতকের গুলিতে জীবন হারান। সে সময় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। সেদিন রাসেলের পাশাপাশি তার বাবা বঙ্গবন্ধুকেও সপরিবারে হত্যা করে ঘাতক চক্র।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের ৫৬তম জন্মদিন শুক্রবার (১৮ অক্টোবর)। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে তার জন্ম।
শেখ রাসেলের জন্মের সময় তৎকালীন পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার ও তৎপরতা চলছিল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। রাসেলের জন্মের দিনটিও বঙ্গবন্ধু ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারকাজে চট্টগ্রামে ছিলেন। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পরে এক লেখায় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মায়ের সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্স এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায়, আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।'
বঙ্গবন্ধু দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখার খুব অনুরাগী ছিলেন। যখনই সময় পেতেন, স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে রাসেলের লেখা থেকে পড়ে শোনাতেন তিনি। এভাবে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও দার্শনিক রাসেলের ভক্ত হয়ে যান। বড় দুই ছেলে কামাল ও জামালের নামের সঙ্গে না মিললেও সবচেয়ে ছোট সন্তানটির নাম রাসেল রাখেন তিনি। পরিবারের পদবিসহ পুরো নাম দাঁড়ায় শেখ রাসেল।
সত্যিকার অর্থেই রাসেল ছিলেন পরিবারের সবার আদরের। তার বয়স যখন দু'বছরেরও কম, তখনই বাবা শেখ মুজিবের দীর্ঘস্থায়ী কারাবাসের সূচনা হয়। তাই বাবার আদর ছোট্ট রাসেল পায়নি বললেই চলে। ১৫ দিন পর পর তাদের দেখা হতো কারাগারে। রাসেলের ধারণা ছিল, জেলখানাই বঙ্গবন্ধুর আসল বাড়ি।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করেছেন, 'রাসেল তো জন্মের পর আব্বাকে বাইরে কমই দেখেছে। ও জেলখানায় গেলে আর ফিরতে চাইত না। বলত এটা আব্বুর বাড়ি। আমি আমাদের বাড়িতে যাব না। আসো আমরা আব্বুর বাড়িতেই থাকি। কতই-বা বয়স ছিল তার। তিন বা চার। ও তো বুঝত না। আমাদের জেল গেট থেকে ফিরে আসতেই হতো। সে রাতে রাসেল আর ঘুমাতে পারত না।'
রাসেল যেমন বাবাকে একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাইতেন না, তেমনি বঙ্গবন্ধুও রাসেলকে যতটুকু সম্ভব কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার জন্য সারাদেশে ছুটতে হয়েছে উল্ক্কার বেগে। তবুও প্রিয় সন্তানদের, বিশেষ করে আদরের রাসেলকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। বিদেশ কিংবা দেশের ভেতর যেখানেই যান না কেন, রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। গণভবনেও কখনও কখনও নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে।
পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ১৫ দিন আগে ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে জার্মানি যান। তখন শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল- দু'জনেরই তার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাসেলের জন্ডিস হওয়ায় মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাকে যেতে দেননি। জন্ডিস না হলে তিনিও বোনদের সঙ্গে যেতেন, রেহাই পেতেন ঘাতকদের হাত থেকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, পনেরোই আগস্টের সেই কালরাতে বঙ্গবন্ধু ভবনের দোতলায় যখন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন শেখ রাসেল ঘাতকদের কাছ থেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভবনের নিচতলায় বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ কাম রিসেপশনিস্ট আ ফ ম মুহিতুল ইসলামের কাছে। সেই অন্ধকার রাতে মুহিতুলকে জড়িয়ে ধরে রাসেল বলেছিলেন, 'ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো?' মুহিতুল তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, 'না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না।' তিনি নিজেও মনে করেছিলেন, নিষ্পাপ শিশুর শরীরে কোনো জঘন্যতম পাপীও আঘাত করতে পারে না। কিন্তু তার বিশ্বাস ভাঙতে সময় লাগেনি।
ওই সময় রাসেল কান্নাকাটি করছিল, 'আমি মার কাছে যাব।' একপর্যায়ে ঘাতক সৈন্যরা মুহিতুল ইসলামকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে রাসেলকে নিয়ে পুলিশ বক্সে আটকায়। তার পরও মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকলে মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেন। ওই হাবিলদার শেখ রাসেলকে হাত ধরে 'চলো, তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই' বলে দোতলায় নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে গুলির আওয়াজ এবং কান্নাকাটি ও চিৎকার শোনা যায়। পরে ওই হাবিলদার নিচে নেমে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলেন, 'স্যার সব শেষ।' শেখ রাসেলের লাশ বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার দুই ভাবি সুলতানা কামাল এবং রোজী জামালের মরদেহের মাঝখানে একটি লুঙ্গিতে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। গুলিতে মাথা উড়ে গিয়েছিল। ১৬ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রাসেলকেও বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের কাছে ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ ও অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে তিনি এক মানবিক জীবন্ত সত্তায় বিচরণমান। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে শিশু রাসেলের মৃত্যু হলেও তিনি বেঁচে আছেন এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে।
জন্মদিনে কর্মসূচি : দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সকাল ৮টায় বনানী কবরস্থানে শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিনব্যাপী কোরআনখানি ছাড়াও বাদ আসর মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হবে।
এ ছাড়া মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও সর্বস্তরের জনগণ এবং দলের সব শাখা ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর প্রতি শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি যথাযোগ্যভাবে পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top