logo
news image

পরিবার কল্যাণ সমিতি

সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু।  ।  
একটি জনকল্যাণ সমিতির বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে দর্শক সারিতে বসে আছি, অনুষ্ঠান উপভোগ করছি। রাজধানীর একটি ইন্সটিটিউটের হলে আয়োজন। পরিপাটি হলরুম, এসি চলছে, আসনগুলোও আরামদায়ক। বসে থেকে মনে হচ্ছে, সবখানে অসম্ভব শান্তি। উন্নয়নের মোড়কে মানুষ এখন চরম অশান্তিতে আছে- হলরুমে বসে অন্তত সেটি বুঝার জো নেই। অতিথিরা বক্তব্য রাখছেন। দর্শকরা নি:শব্দে তা শুনছি।
বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানের বক্তব্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থিদের উদ্দেশ্যে প্রেরণামূলক-উৎসাহমূলক। তা হচ্ছে না, বেশিরভাগই রাজনৈতিক। অতিথিদের মধ্যে দু’জন আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য- একজন সাবেক, অন্যজন বর্তমান। তারা আরও দুই লাইন এগিয়ে। প্রাসঙ্গিক বক্তব্য না দিয়ে রাজনৈতিক ভগবানের এবাদত করতেই বেশি ব্যস্ত। বক্তব্য শুনে মনে হলো, রাজনৈতিক দলের পোষা কুকুর না হলে বোধ হয় উপাচার্য হওয়া যায় না। দলের প্রধানরা এসব বক্তব্য শুনলে, আমি নিশ্চিত, এবাদতে সন্তুষ্ট হয়ে উপাচার্যদের মন্ত্রি-মিনিস্টার জাতীয় কিছু বানিয়ে দিবেন। বক্তব্যগুলো বিরক্তিকর, কিন্তু একটুও বিরক্ত লাগছে না। অন্য সময় সময় হলে বক্তব্য ফেলে উঠে যেতে মন চাইত। হলের আরামদায়ক পরিবেশের কারণেই, হয়তো, আগ্রহ নিয়ে বক্তব্য শুনে যাচ্ছি।
এর মাঝে বৃত্তি দেয়া শুরু হয়েছে। গরিব এবং মেধাবি প্রত্যেক শিক্ষার্থিকে পাঁচ হাজার টাকা ভর্তি খাম দেয়া হচ্ছে, সাথে উপহার সামগ্রি। উপহার সামগ্রি বলতে সমিতির সভাপতির লেখা ভ্রমণ কাহিনি, মগ ও স্মরণিকা। সভাপতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলা, লেখক হিসাবে উচ্চ পর্যায়ের নন। তাকে খুশি করার জন্যই বোধ হয়, হতে পারে কোন সুবিধা নেয়ার জন্যও, নামি এক প্রকাশক বইটি নিজ খরচে ছেপে দিয়েছেন। কিন্তু পাঠক নেই, বাসায় ঘরের কোণেই এতদিন পড়ে ছিল বইগুলো, উপরে ধূলো-বালি জমছিল। আজ সেগুলো বিতরণের সুযোগ পাওয়া গেল। বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে বাধ্য কিছু পাঠক পাওয়া গেছে, উপহার হিসাবে তাদের গছিয়ে দিলেই হলো। বইটি পড়ে তারা নিশ্চয়ই খারাপ মন্তব্য করার সাহস হবে না! কৃতজ্ঞতা বলে একটা বিষয় আছে! যাদের বৃত্তি দেয়া হচ্ছে, তারা কৃতজ্ঞ না হয়ে যাবে কোথায়!
বৃত্তি যারা নিচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থিই আমার পরিচিত। তারা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, নিশ্চিতভাবেই মেধাবি। মেধাবিদের মধ্যে যারা গরিব তাদের জন্য বৃত্তির টাকাটা বিপদের বন্ধু হয়ে কাজ করবে। সমিতি মেধাবিদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে, সেটা যে কোন মানদণ্ডেই ইতিবাচক। ভাবতেই মনটা আরেক দফা ভাল হয়ে গেল। কিন্তু কয়েকজন শিক্ষার্থিকে মঞ্চে বৃত্তি নিতে দেখে আমি খুব অবাক হলাম। আমি তাদের ভাল করেই জানি। তারা গরিব কিংবা মেধাবি কোনটাই নয়। তারা সমিতির হর্তা-কর্তা উকিল সাহেবের ভাতিজা, ভাগ্নি ও আত্মীয়-স্বজন। পরিচয় অনেকটা গোপন করে তাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইউনিয়নের শিক্ষার্থিকে পৌরসভায়, স্কুলের শিক্ষার্থিকে কলেজের নামে দেখিয়েছেন। উকিলরা আদালতে যতটা কৌশলি, সমিতির বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে আরও কয়েক আঙ্গুল বেশি কৌশলির পরিচয় দিলেন।
উকিল সাহেবরা আদালতে দাড়িয়ে একজন চরম অপরাধিকেও টাকার বিনিময়ে নির্দোষ প্রমাণ করার দায়িত্ব নেন। দুর্ধর্ষ খুনিকেও নিষ্পাপ বলে ঘোষণা করেন। এখানেও সেরকম করলেন। মেধাহীনকে মেধাবি, আর্থিকভাবে স্বচ্ছলকে- এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এধরণের শিক্ষার্থিকেও গরিব বলে চালিয়ে দিলেন। রিক্সাচালকের ছেলে মেধার জোরে ভাল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে শুনে যেমন বিস্ময়ে হা হয়ে যাচ্ছি, আমলা-শিক্ষাবিদদের চোখের সামনে উকিল সাহেবের চালাকি দেখে দ্বিগুণ হা হয়ে যাচ্ছি। বিষয়টা একটু খুলে বলি।
উকিল সাহেবের এক ভাতিজা সরকারি কলেজে পড়ে। অনার্সে সুযোগ পায়নি, পাস কোর্সের মেধাবি শিক্ষার্থি! বাবা প্রবাসি, ফ্যাশনেবল ছেলেকে কষ্টের টাকায় যুতসই মোটর বাইক কিনে দিয়েছেন। দিনভর তাতে ভর করে, উড়াধুরা গতি নিয়ে, শহরের বিভিন্ন গলি প্রদক্ষিণ করে। সন্ধ্যার পর গলির মোড়ে আবছা অন্ধকারে বন্ধুদের সাথে জম্পেস আড্ডায় যোগ দেয়। একেক দিন একেক গলির মোড়ে জমে সে আড্ডা। মেয়েরা যদি কোন কারণে সে মোড় পাড়ি দিতে হয়, ভয়ে ভয়েই দেয়। ভদ্র লোকেরা তখন সে মোড় এড়িয়ে ঘুর পথে গন্তব্যে যান। হৈ-হুল্লোড়, বিড়ির পর বিড়ি ধ্বংস হয় সে আড্ডায়। আড্ডাও চলে ক্লান্তিহীন। দু’চোখে যখন ঘুম ভর করে, তখন ঘরের কথা মনে পড়ে। আড্ডা শেষ করে, সমস্ত শক্তি খরচ করে ভাতিজা সাধারণত মাঝ রাতে বাসায় ফেরে। মায়ের অপেক্ষাও তখন শেষ হয়। পরিবারের একমাত্র ছেলে বলেই সংসারে আদরও পায় সবচেয়ে বেশি। হাত-মুখ ধুয়ে সুবোধ বালকের মত ছেলে খেতে বসে। মা বসেন পাশে। এটা-ওটা পাতে তুলে দেন। ছেলের খাবারে আবার অনেক বাছাবাছি। মা নিজেই ছেলের পছন্দের আইটেমগুলো মুখে তুলে দেন। শান্ত ছেলে তা গলাধ করণ করতে থাকে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই ছেলে দাপটের সাথে দিনভর অলি-গলি চষে বেড়ায়, বন্ধুদের আড্ডায় হয় মধ্যমণি, এই ছেলেকে মেয়েরা, ভদ্রলোকেরা ভয় পায়। খেয়ে দেয়ে শান্ত ছেলে ঘুমুতে যায়। যে ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করতে হয় পরদিন দুপুর পর্যন্ত। কোন কারণে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে রাত জেগে মা ছেলের গায়ে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করেন। এত ব্যস্ত যে ছেলে তার বই হাতে নেয়ার সময় কই! উকিল চাচা সমিতির নির্বাহী কমিটির লোক হওয়াতে অনার্সে চান্স না পাওয়া ভাতিজাও হয়ে উঠে মেধাবি! বৃত্তি পায় নিয়মিত। কী করবে বৃত্তির টাকা দিয়ে? মোটর বাইকের তেল নাকি আড্ডার রশদ বিড়ি-সিগারেট কিনবে? যেভাবেই খরচ করুক। বৃত্তির টাকায় বেশ কয়েকদিনের হাত খরচ হয়ে যাবে ভাতিজার। জয়তু উকিল চাচা!
উকিল সাহেবের ভাগ্নিও বৃত্তি পেয়েছে। দু’বছর আগে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। স্বামী সংসার নিয়ে এখন চরম ব্যস্ত। কলেজে যাওয়ার সময় হয়না। তার উপর সন্তান সম্ভবা। যখন তখন অবস্থা। গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ডাক্তারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে আছে। যে কোন সময় ডেলিভারি। সেজন্য অনুষ্ঠানে আসা সম্ভব হয়নি। তার পক্ষে বৃত্তির টাকা গ্রহণ করলেন উকিল সাহেবের ভাগিনা। ভাগিনা বৃত্তির টাকা বোনকে পৌঁছে দিবেন।
ভাগ্নির বিয়ে হয়েছে বছর দু’য়েক। জামাই বেশ অবস্থা সম্পন্ন। শহরে নিজেদের বাড়ি। পারিবারিক ব্যবসা আছে। নিজে ভাল বেতনে চাকরি করেন। নিজেদের গাড়ি করেই প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়া করেন। টাকা পয়সার তমতমি। বিয়ের পরই জামাই ঘোষণা দিয়েছেন, স্ত্রীকে আর পড়ালেখা করাবেন না। সেজন্য উকিল সাহেবের ভাগ্নির কলেজের ক্লাশ-পরীক্ষার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। কিংবা ইচ্ছে থাকলেও কলেজে যাওয়া সম্ভব হয় না। সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়াও বড় এক প্রতিবন্ধকতা। উকিল মামার বদৌলতে এই ভাগ্নিও মেধাবিদের তালিকায় স্থান পেয়ে গেল। বৃত্তি বাবদ পেয়ে গেল নগদ পাঁচ হাজার টাকা। ভাগ্নি এ টাকা দিয়ে কী করবে? হাসপাতালের বিল পরিশোধ করবে? নাকি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এক বেলা ভরপেট চাইনিজ খাবে? পড়ালেখা যেহেতু আর করা হচ্ছে না, অন্য যে কোন কাজেই লাগতে পারে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এমন কয়েকজনকেও দেখলাম বৃত্তির টাকা নিতে। আমি জানতাম, গরিব এবং মেধাবি হওয়াই বৃত্তি পাবার শর্ত। অধ্যয়নরত থাকতে হবে, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থি কোন যোগ্যতায় বৃত্তি পায়? উকিল সাহেবের সাথে আত্মীয়তাই কী মূল যোগ্যতা? প্রাইভেটে যারা পড়ে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তারা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবি। টাকার জোরেই তারা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখে। বলতে গেলে বাবার টাকায় সার্টিফিকেট কিনে নেয়। টাকার তমতমি থাকায় ক্লাশের আগে পরে চাইনিজ খাওয়া, বান্ধবি নিয়ে মাস্তি করারও সুযোগ পায়। বৃত্তির পাঁচ হাজার টাকা তাদের কাছে কিছুই না। না হবে সেমিস্টার ফি, না লাগবে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে। পুরো টাকাটাই হাত খরচ হিসাবে নষ্ট হবে, বিড়ি খেয়ে, গ্রুপ আড্ডার রশদ যুগিয়ে কিংবা বান্ধবির গিফ্ট কিনতে!
সমিতি গঠন করার মূল উদ্দেশ্যই ছিল, এলাকার গরিব ও মেধাবি শিক্ষার্থিদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা। এলাকার বড় মাপের মানুষদের শিক্ষার্থিদের সংস্পর্শে এনে তাদের উৎসাহিত করা। সদস্যদের দেয়া অনুদানেই সমিতির ফান্ড তৈরী হয়। এবারের বার্ষিক প্রতিবেদনে অনেকের অনুদানের কথা উল্লেখই করা হয়নি। সেজন্য অনেকেরই চোখই কপালে। টাকাগুলো তাহলে যাচ্ছে কোথায়? বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটা স্মরণিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। উকিল সাহেব এখানেও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন। তার নামে বিশাল রচনা স্থান পেয়েছে স্মরণিকায়। যার পুরোটাই অন্য একটা বই থেকে কপি করা! অনেক যত্নে গড়া সমিতি এমনভাবে বেহাত হয়ে যাবে, হায়েনার খপ্পরে পড়বে, কেউ ভাবেনি।
অনেকের আপ্রাণ চেষ্টায় গড়ে ওঠা জনকল্যাণ সমিতি এখন উকিল সাহেবের পরিবার কল্যাণ সমিতি।
* সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু: প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, সিলেট। ০১৮১৮ ৮২২ ৭৫৫, sa_jisue@yahoo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top