logo
news image

চামড়ার আচার ও চামড়ার কবর

-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
অর্ধশতাব্দী ধরে দেখে আসছি কোরবানীর পশুর চামড়ার কদর। এর আগে প্রতিবছর দেখেছি ঈদের দিন কোরবানী শুরু হবার পূর্বেই ফড়িয়া ক্রেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুড়ে চামড়ার দরদাম ঠিকঠাক করে কেনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হ’তো। গরীব মিসকিনদেরকে বেশী দান করতে পারবেন এই আশায় যিনি বেশী দাম দিতেন তার কাছেই চামড়া বিক্রি  করে দিতেন। শুধু এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এবারে চামড়া কিনতে কেউ আসেনি। শেষে এক এতিমখানার ক’জন শিক্ষার্থী এলে তাদেরকে চামড়াগুলো দান করে দিয়েছি। তারা কোথাও সেগুলো বিক্রি করতে পেরেছে কি না জানি না!
আজকে পত্রিকার পাতা উল্টাতেই কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে কারসাজি ও দুরাবস্থার সংবাদগুলো খুব ব্যথিত করলো। সুনামগঞ্জের সৈয়দপুর গ্রামে এক মাদ্রাসরে শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত চামড়াগুলো দু’দিন পেরিয়ে যাবার পরও বিক্রি না হলে সংরক্ষণের অভাবে ও পরিবেশ দূষণের ভয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। মাদ্রাসায় গরীব, এতিম শিক্ষার্থীরা প্রতিবছরের মত এবারও নিজেরা ভ্যান-রিক্সা ভাড়া করে ৮০০টি ছাগল ও ১০০টি গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছিল। দাম পাবার আশায় নিজেরা কিছু লবন কিনে সংরক্ষণের চেষ্টা করেছিল। এজন্য তাদের ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু চামড়ার দাম না থাকায় কোথাও বিক্রি করতে না পেরে প্রতিবাদ জানিয়ে সেগুলো কবরস্থ করেছে। এ সংবাদ শুনে সেখানকার এক টি.এন.ও-র মন্তব্য হলো- ‘মাদ্রাসার লোকেরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য’ চামড়াগুলোর কবর দিয়েছে! এমন একটি অর্থনৈতিক ক্রান্তির বিষয়কে নিয়ে সরকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন দায়সারা কথা বলতে পারেন তা জাতির জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়। বিসিএস পাশ করা একজন কর্মকর্তা যখন এমন অর্বাচীন কথা বলে পার পেতে চান তখন বলার কিছুই থাকে না। চামড়াগুলো যদি এখন পর্যন্ত খোলা জায়গায় থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতো তাহলে তিনি নিজে কী করতেন?
আজকাল সবকিছুকে তাচ্ছিল্য করে দেখা, মন্তব্য করা আমাদের মজ্জাগত বিষয় হয়ে দাড়িছে। এক মন্ত্রী সেদিন ডেঙ্গু নিয়ে ভললেন- দেশের উন্নতি হচ্ছে তাই ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। কোন দেশের উন্নতি হলে ডেঙ্গু ছড়ায় এটাও অবিবেচকের মত বচন বৈ কি? সুষম উন্নতি হলে জনদুর্ভোগ কমে। আর অপরিকল্পিত, অসম উন্নয়ন হলে জনদুর্ভোগ তৈরী হয়। যেমন, ঈদুল আযহার পূর্বে হঠাৎ করে ভঙ্গুর রেল লাইনের মধ্যে কয়েকটি নতুন ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালানোর ঘোষণা দেয়া হলো। অর্থাৎ একটি চালু নির্ধারিত ট্রেনের সময়সূচিকে বাধাগ্রস্থ করে আরেকটি উপযাজক ট্রেন উড়ে এসে জুড়ে বসলো। ফলে সব ট্রেনের সময়সূচিতে হট্টোগোল বেধে গিয়ে এক মহা বিপর্যয়ের ও বিড়ম্বনার ঈদ যাত্রা দেশবাসী উৎকন্ঠার সাথে প্রত্যক্ষ করলো। এখানেও সুদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনার অভাব। এভাবে হঠাৎ ব্যতিক্রমী উন্নয়ন ভাবনা আমাদের স্বাভাবিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করে জনদুর্ভোগ তৈরী করছে, যা নি:সন্দেহে তাদের জনপ্রিয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছে।
কিছুদিন আগে কিছু আনাড়ি কর্মকর্তাদের দেখা গেছে ধান ক্ষেতের পাশে পাজেরো থামিয়ে দলবল নিয়ে উপযাচক হয়ে কৃষকদের ধান কেটে দিতে। কেউ কেউ হাটে গিয়ে দু’একদিন ধান কিনে পত্রিকার শিরোনামও হয়েছেন। তাতে কি ধানের দাম একপয়সা বেড়েছে? প্রান্তিক কৃষকরা কি কোন প্রকারে লাভবান হয়েছে? ধান ক্ষেতে আগুন দেয়াকে কেউ কেউ গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। শেয়ার বাজারের ধ্বসকে অদৃশ্য হাতের কারসাজি বলেছেন। ডেঙ্গুর মৃত্যুসংখ্যা নিয়ে এখনও সরকারী ও বেসরকারী সংখ্যার মধ্যে বিরাট অমিল। আগামী সেপ্টেম্বর মাস নাকি ডেঙ্গুজ¦রের পিক সিজন! ২০১৮ সালে আগষ্ট মাসে ১৭৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। অথচ এবারের আগষ্ট মাসের ১৪ দিন না পেরুতেই ২৬ হাজারের বেশী রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কীটপতঙ্গের জীবাণু নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন সহযোগী অধ্যাপক জানালেন- ডেঙ্গু জীবাণুর ক্যাটগরী ও চরিত্র বদল হয়েছে। সি এবং ডি ক্যাটাগরীতে সাধারণ ওষুধের বিপরীতে ওদের ক্ষমতা বেড়ে গিয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। তাই ডেঙ্গুরোগ প্রতিকারে আমাদের নিত্যনতুন গবেষণা চালানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে শুধু বাক্যবাগিশ না হয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নতুন করে ব্যবহারিক গবেষণায় মনেযোগী হতে বলেছেন তিনি। এজন্য বিশেষ তহবিল গঠনও জরুরী। এই মানবিক বিপর্যয়কে এড়াতে হলে সবাইকে জরুরী ভিত্তিতে কাজে নেমে পড়তে হবে।
ডেঙ্গুরোগ যেমন আমাদের চেতনাকে মানবিক পর্যায়ে নাড়া দিয়েছে ঠিক তেমনি কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে কারসাজি ও দুরাবস্থার সাম্প্রতিক চিত্রগুলো আমাদের অর্থনীতি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকে নাড়া দিয়েছে। একটি পত্রিকা উল্লেখ করেছে- ‘এতিম গরীবদের হক মেরে দিল চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট’।  ঢাকার মহাখালীর এক মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা আওলাদ হোসেন জানিয়েছেন, সে এলাকার মানুষ কোরবানীর চামড়া মাদ্রাসার ফান্ডে দেন। চামড়া বিক্রির এই টাকা এতিম ও দরিদ্র শিশুদের পড়াশুনা ও খাবারের খাতে খরচ করা হয়। দেশে সুনামগঞ্জ ও মহাখালীতেই শুধু নয়-এ ধরণের হাজার হাজার বেসরকারী সাধারন ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এতিম, অসহায়, অবহেলিত শিশু শিক্ষার্থীরা কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ দিয়ে পড়াশুনা ও খাবারের খরচ মিটিয়ে থাকে।
অপরদিকে চট্টগ্র্রামে একলক্ষ চামড়া রাস্তা থেকে বর্জ্য হিসেবে তুলে নিয়ে গেছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা। আমার এক সহকর্মী বলেছেন তিনি তাঁর কোরবানীর চামড়াটিকে বরাবরের মত বাসার দারোয়ানকে দান করেছিলেন। কিন্তু দারোয়ান কোথাও সেটার সুব্যবস্থা করতে না পেরে কোন এক পুকুরে নিক্ষেপ করে এসেছে। পত্রিকায় জানা গেল ট্যানারীগুলোতে গতবছরের কোরবানীর চামড়া এখনও অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। এর কারণ কী? জুতা, ব্যাগ, পোল্ট্রী ফিড ইত্যাদি বানানো ছাড়া চামড়ার কি আর কোন বিকল্প ব্যবহার নেই? এতদিন বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্র অর্জত হলেও এখন কিজন্য সেটা অর্জিত হচ্ছেনা? সেটা ভেবে দেখার বিষয়। বিদেশে পশু শিং ও চামড়ার বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। আমাদের দেশেও সেটার ব্যবহার বাড়াতে উদ্যেগ নিতে হবে। জাপানের কুমামোতো জেলার ঐতিহ্যবাদী দামী স্যুপ জাতীয় খাবার তৈরী হয় গরুর ‘নাইজো’ অর্থাৎ ভুড়ির কালো খসখসে অংশটা দিয়ে ও ঢাক-ঢোল বানানো হয় চামড়া দিয়ে। আমাদের দেশেও চামড়া দিয়ে নানা বাদ্যযন্ত্র বানানো হয়। দেশের পটুয়াখালীতে বিভিন্ন এলাকায় গরুর মাথার চামড়া দিয়ে এক ধরনের রান্নার প্রচলন রযেছে যা বিভিন্ন পদের ও স্বাদের। এছাড়া গরুর চামড়া দিয়ে এক ধরনের স্বুস্বাদু শুকনো আচার তৈরী করা যায় এবং সংরক্ষণ করে বছরব্যাপী খাওয়া যায়। কাঁচা চামড়া রপ্তানী করলে দেশের ট্যানারী শিল্প ধ্বংস হবে এবং ট্যানারী শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়বে।
গত বছরের কর্জ্যরে অর্থ শোধ দিতে না পারায় অনেক ট্যানারীমালিকদের অনেকেই এবার নতুন করে অর্থ সহায়তা পাননি। এটাও আমাদের অর্থনীতির ওপর কালো থাবা। দেশের জনস্বাস্থ্যের বর্তমানে ক্রান্তিকাল চলছে। তার ওপর পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। এমতাবস্থায় দেশের এককালের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানী আয়ের উৎস চামড়া শিল্পকে সিন্ডিকেটের কালো থাবা থেকে বাচানো জরুরী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অসহায় মানুষগুলোকেও বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসা জরুরী।
সীমাহীন দুর্নীতি, লোভ, প্রতারণার সিন্ডিকেট বানিয়ে কারসাজি করে যারা মানুষকে কষ্ট দেন, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করার কাজে লিপ্ত থাকেন তাদের ব্যাপারে সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে-  ঈদুল আযহা পরবর্তী বিরাজমান আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় দুরাবস্থা সংরক্ষণে এই কামনা সবার হওয়া উচিত।
* -প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top