logo
news image

ছোট্ট মশা মহাবিপদে ফেলেছে: মুক্তি কোথায়?

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।।
ছোট্ট মশার কি দারুন এক ক্ষমতা! ছোট্ট এডিস মশা গোটা জাতিকে সংকটে নিপতিত করেছে। তারা আমাদেরকে বর্তমানে এক মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে দিনাতিপাত করছে। একদিকে গরম, বৃষ্টি, বন্যা, নদীভাঙ্গন অপরদিকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তদের আহাজারি ও মৃত্যুভয়। এমন বাজে সংকটের মুহূর্ত আমাদের দেশে দীর্ঘদিন দেখা যায়নি, আঘাতও হানেনি!
ইতো:পূর্বে নানা ধরনের মহামারী যেমন কলেরা হতো, গুটিবসন্ত দেখা দিত, ঘন ঘন ডায়রীয়া হতো। সেই আতঙ্কের দিনগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি। এছাড়া ভয়ংকর ছয়টি শিশুরোগকেও আমরা দুরে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়েছি। জ্বর, পেটের পীড়া ইত্যাদি আমাদের মত গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে অতি সাধারণ ব্যাপার। এগুলো হলে কেউ সাধারণত: মারা যান না। তাই প্যারাসিটামল বা খাবার স্যালাইন নিজে নিজে সেবন করার রেওয়াজ ঘরে ঘরে সমাদৃত। কয়েক বছর ধরেই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরের প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হলেও মৃত্যুহার তেমন না থাকায় সেটাকে একদম অবহেলা করা হয়েছে। যদিও থাইল্যান্ড, ফিলিপিনস্ প্রভৃতি দেশে ডেঙ্গুজ্বরের জন্য বিশেষ সতর্ককতা অবলম্বন করা হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে মোটেও গুরুত্ত¡ দেয়া হয়নি। মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি সবার নজর কেড়েছে। ইতো:মধ্যে শিশু, স্কুলছাত্র, অন্ত:স্বত্তা গৃহবধূ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া শিক্ষার্থী, পুলিশের বড় কর্মকর্তার স্ত্রী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ বহু প্রাণ ডেঙ্গুজ্বরের কারনে ঝরে গেছে। বাসা-বাড়ি, শিক্ষাঙ্গন, অফিস-আদালত, রাজনৈতিক অঙ্গন, হাসপাতাল সবজায়গায় আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। পত্র-পত্রিকা তো বটেই, টিভি রুমের আলোচনায় ডেঙ্গুজ্বরের কথা নানাভাবে প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরের আলোচনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপবাদ দেয়ার খেলাও (বেøম-গেম) বেশ জমে উঠেছে। মনে হচ্ছ এটাই আমাদের জাতিগত কৃষ্টির চরিত্র। সমস্যাটির সমাধানের দিকে নজর নেই, এক অপরকে দোষারোপ করে কালক্ষেপন করে বিষয়টিকে আরো খারাপের দিকে ঠেলে দেয়াটা যেন আমাদের কাজ।
ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না- রোমানরা যখন ইউরোপ জয় করে তখন সেখানে জৌলুষ ছিল। কিন্তু সৈন্যদের দুর্নীতি, লুটতরাজ, বিলাসিতা, অহমিকা ও কাজকর্মে অনীহা থেকে সামাজিক অনাচার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মাদকদ্রব্য আফিমের ব্যবহার বেড়ে যায়। কাজ-কর্মে চরম অবহেলা ও নোংরামীর কারনে আবর্জনার স্তুপ জমে উঠে। চারদিকে ময়লা আবর্জনা ও ভাগাড়ের কারনে ইঁদুরের বংশ ও বসতি বেড়ে যায়। আমদানী বেড়ে যওয়ায় যুদ্ধ জাহাজের পাশাপাশি বাণিজ্য জাহাজ চলাচলের ফলে নাবিকদের বাক্স-পেটরা ও পণ্যসামগ্রীর প্যাকেটের মাধ্যমে প্লেগের বাহন কালো ইঁদুর সারা ইউরোপে বংশ বিস্তার করে ফেলে। এরা প্রথমদিকে ফসলের খামারেই থাকতো। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিলের সময় আইরিশ পটেটো বøাইট ও ফ্যামিনের কথা সর্বজনবিদিত। মড়ক রেগে আলুর আবাদ নষ্ট হয়ে গেলে ইউরোপে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইঁদুররা একসময় ফসলের জমির শস্যদানা শেষ করে ফেললে খাবারের অভাবে মানুষের বসতিতে ঢুকে আক্রমণ শরু করে। সেখান থেকে প্লেগ ছড়াতে থাকে ও আতঙ্ক শুরু হয়। মহামারী আকারে প্লেগ শুরু হলে শহরের মানুষ দিক্বিদ্বিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে এক সময় শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল। শহরগুলো তখন ভুতুড়ে অন্ধকার জনপদে রুপান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ফরাসী বায়োলজিষ্ট আলেক্সান্ডার ইয়ারসিন প্লেগের জীবাণু আবিষ্কার করলে এর প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফলে অবস্থার উন্নতি হয়। কিন্তু সেই সামাজিক ক্ষত এখনও ইতিহাস হয়ে আমাদেরকে উপহাস করে মাত্র।
অর্থাৎ, মানুষের অবহেলা ও উদাসীনতাই এই মহামারীর জন্য দায়ী। এডিস মশা এক দুই করে মানুষের প্রাণ সংহারে নমে পড়েছে বিধায় আমরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছি। এতদিন এর প্রতিরোধে অবহেলা করা হয়েছে। আজ জুলাই ৬ তারিখে দেশে ২৪ ঘন্টায় সর্বচ্চো সাত জনের মৃত্যুর সংবাদ বের হয়েছে। সারা দেশে এ পর্যন্ত ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে যা খুবই আতঙ্কের বিষয়। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজেই ১৭ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন এবং ১৮৩ জন ভর্তি হয়েছেন। সারা দেশে ২৭ হাজার ৪৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আসন্ন ঈদের ছুটিতে মানুষের চলাচলের গতি বেড়ে গেছে বিধায় ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অথচ ঢাকার বাইরে এর চিকিৎসা সুবিধা খুবই সীমিত।
প্রশ্ন হলো এই মহাবিপদের মুক্তি কোথায়? সবাই রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে সবার জন্যই শুধু বিপদের ক্ষেত্রটা প্রশস্থ হবে। সরকার এখনো ডেঙ্গুর ভয়াবহতাকে সেভাবে প্রকাশ করছেন না। আজকের এক পত্রিকায় বেসরকারী হিসেবে মারা গেছেন ৯৪ জন অথচ সরকারী হিসেবে মাত্র ১৮ জন মারা যাবার কথা প্রকাশিত হয়েছে! সরকার কেন ডেঙ্গুকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সারা দেশের মানুষকে সতর্ক করছেন না সেটা মোটেই বোধগম্য নয়। একজন একটি প্রথম সারির পত্রিকায় ডেঙ্গু মৃত্যু সংখ্যার লুকোচুরি নিয়ে মন্তব্য করেছেন- তাহলে কি সরকারকে নামতা শেখাতে হবে? মানুষের ভীতি কাটানোর জন্য ও সতর্কতা বাড়ানোর মাধ্যমে এর প্রতিরোধ করার জন্য সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। সরকারী তথ্য সেল খুলে ডেঙ্গু কোন লেভেলে আছে তা বিরতিহীনভাবে সকল রেডিও-টিভি ও পত্রিকায় জরুরীভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে হাস্যকর পদক্ষেপ যেমন- পিচঢালা রাস্তায়, জনসভায় দুপুরের রোদে ফগিং করা হচ্ছে। হাজী ক্যাম্পে ঢুকে কিছু উৎসাহী ছেলেরা ঘুমন্ত হজ্জযাত্রীর মুখে ধোঁয়া ছুড়ে বিব্রত করছে। অথচ, এডিসের জন্মস্থান বাসার কাছে জমানো পরিস্কার পানিতে, চৌবাচ্চায়, ফুলের টবে, নির্মানাধীন বাড়ির জমানো পানি, পরিত্যক্ত পনির পিপা-ড্রাম, ড্রেন, বাসন, ডাবের খোসা, পলিথিন, বেসিন ইত্যাদিতে। এজন্য সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য নিজ নিজ পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব। যে কেউ মানবতার সেবায় নিবেদিত হয়ে সব পর্যায়ে রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়–ন। কে কত পরিমান কালো টাকা সাদা করলেন আর কতটা ন্যায়-অন্যায়ের প্রাকৃতিক বন্যায় ভেসে নিয়ে গেল তার হিসেব কি একজন হাজী ও সাচ্চা মুসলিম হিসেবে আপনার মাথায় আছে? ঘুষ-দুর্নীতি পরিহার করুন। মিথ্যা কথা বলা ছাড়–ন। উন্নয়নকে টেকসই আবহ দিয়ে টিকে রাখতে হলে পরিশ্রমের পাশাপাশি উন্নয়নের ‘বরকত’ পাবার সদিচ্ছা থাকা উচিত। তা না হলে উন্নয়ন হবে কিন্তু উন্নয়নের ‘বরকত’ উধাও হয়ে যাবে।
শহুরে ধনী ডেঙ্গু রোগীরা সহজে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন কিন্তু গরীব মানুষেরা যাতে সহজে চিকিৎসা পেতে পারেন সেজন্য দানশীল ব্যক্তিগণকে এ মুহুর্তে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। এছাড়া সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাওয়ায় আর রাখ-ঢাক না করে সরকারীভাবে জরুরী আপদকালীন ফান্ড তৈরী করে বিনামূল্যে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিতে প্রয়োজনে স্কাউট, বিএনসিসি, পুলিশ-আনসার, সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
ছোট্ট এডিস মশা গোটা জাতিকে আজ যে মানবিক সংকটে নিপতিত করেছে তার জন্য আমাদেরকে মনে প্রাণে পরিচ্ছন্ন হতে হবে। দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ফেলে নিজে নোংরা থেকে মুক্ত থাকি, পরিবেশকে নোংরা হতে না-দিই। তাহলে এডিস মশারা লজ্জায় পালিয়ে যাবে।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top