logo
news image

সৌদি আরব ফেরত এক ঝিনুকের আর্তনাদ

মো. সাদিকুর রহমান নুমান।।
সৌদি আরব থেকে দেশের পথে বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইট…। যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়া শেষে ক্লান্ত হয়ে বেশির ভাগ ঘুমে। এরিয়া ইনচার্জ হিসাবে আমি সিটে বসে আছি। হঠাৎ শুনতে পাই পাশেই ফুপিয়ে কান্নার শব্দ। উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি বিশ থেকে বাইশ বছরের একটি মেয়ে কান্নারত। কারণ জানতে চাইলাম; সাধারণত দেশে ফিরতে কেউ কান্না করে না, থাকে উৎফুল্ল। মেয়েটি কিছুই বলে না। মনে করলাম হয়তো পাশের যাত্রী বিরক্ত করছে, ভয়ে কিছু বলছে না। তখন আমি তাঁকে আমার ওয়ার্কিং এরিয়ায় নিয়ে এলাম। তাকে অভয় দিয়ে বললাম- আপনি আমার ছোট বোনের চেয়ে বয়সে ছোট। আমাকে বড় ভাই হিসাবে আপনার সমস্যা বলতে পারেন।
মেয়েটির নাম ঝিনুক। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে বসবাস। বাবা বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। মা পরের বাড়িতে কাজ করে।  মেয়েটি এলাকার একটি দর্জি দোকানে কাজ করে সংসার চলছিল। অসহায় এই পরিবারে আশার আলো হিসাবে গ্রামের মধ্যবয়স্ক এক পরিচিত প্রস্তাব দিলেন সৌদি গিয়ে আট ঘন্টা বাসার কাজ, সাথে ওভার টাইম। থাকা খাওয়া ফ্রি। মাসে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা আয়।
মেয়েটির মা অভাবের দিন শেষ হয়ে যাবার স্বপ্ন নিয়ে ভিটে ছাড়া বাকি সমান্য জমি বিক্রি করে মেয়ের বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্তা করেন। রঙিন স্বপ্নে বিভোর মেয়েটি গ্রামের সেই লোকের সাথে ফ্লাইটের আগের রাতে ঢাকা এসে হোটেল ওঠে। গভীর রাতে প্রথম আঘাত আসে। সেই মানুষের ধর্ষণের শিকার হয়ে তা নিরবে মেনে নিতে হয়। প্রতিবাদ করলে কিংবা বিষয়টি প্রকাশ করলে বিদেশ আর যাওয়া হবে না।
সৌদি পৌঁছে শুরু হয় তৃতীয় দিন থেকে বয়স্ক সৌদি চাকুরীদাতার লালসার শিকার। কয়েক দিন পরে যুক্ত হয় সেই মানুষের যুবক ছেলে। ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে একটি তরুণীর স্বপ্ন। একদিন সেই বাড়ির একটি অনুষ্ঠানের ব্যস্ততার সুযোগ মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে হাটতে হাটতে একটি মার্কেটের সামনে বাংলা ভাষায় আলাপরত একটি পরিবারকে পেয়ে পা জড়িয়ে ধরে সাহায্য চায়। তারা মেয়েটিকে বাসায় নিয়ে যান। সৌদি আরবীয় সেই মানুষকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে শুধু মেয়েটির দেশে ফেরার টিকিট এবং ছাড়পত্র ছাড়া কিছুই আদায় করতে ব্যর্থ হয়।
তারা কিছু টাকা দিয়ে কাপড়-চোপড় এবং সামান্য খেজুর কিনে দেন। সাথে বাংলাদেশের হাজার টাকা পরিমাণ সৌদি রিয়াল দিয়ে বিমান তুলে দেন। মেয়েটির কাহিনীর করুণ অংশগুলি আমি লিখতে পারছিনা, শালিনতা নষ্ট হবে বলে। কান্নারত মেয়েটির ঘটনা শুনে সেদিন আমি ফ্লাইটের বাকি কাজে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু অবতরণের আগে মেয়েটিকে বিমানবন্দরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আমার জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ দিলাম।
আমি আমার ক্রু ব্যাগেজ বিমানের গাড়িতে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে বাসায় পৌঁছে দিতে অনুরোধ করি। আবার এয়ারপোর্টে প্রবেশ করে সাথে থাকা ২৫০ ডলার ব্যাংক থেকে ভাংগিয়ে একুশ হাজারে কিছু বেশি বাংলাদেশী টাকা পেলাম। তারপর উবার কল করে মেয়েটিকে উত্তরার একটি বাস কাউন্টারে নিয়ে বাসের টিকিট কিনে দিলাম। বাকি টাকা মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে বললাম “এই টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে নিজে সেলাইয়ের কাজ শুরু করবে। তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা কোথাও বলবে না। কারণ হায়েনার দল এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে তোমার আগামী জীবন বিষিয়ে তুলবে। কারো অপকার ছাড়া উপকার করবে না। “
কিছুক্ষন পরে বাস আসলে, মেয়েটি বাসে উঠল। ছেড়ে দেবার সময় মনে হলো এই মেয়ে সারা জীবন আশেপাশের মানুষগুলিকে হায়েনা হিসেবেই চিন্তা করবে, মানুষ নয়।
আমাদের দেশের অনেক নারী বিদেশে গৃহকর্মী হিসেবে যায়। যার নববই শতাংশ নির্যাতিত হয়। বেশির ভাগ সময় খালি হাতে ফিরে আসে। এদের সাথে মিথ্যা আশার আলো দেখায় দেশের এবং প্রবাসি কিছু অর্থলোভী অমানুষের দল।
আমাদের উচিত হবে, এরকমভাবে কাউকে যেতে দেখলে নিরুৎসাহিত করা। সরকারেরও উচিত এই বিষয়ে চিন্তা করা। আমি বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই করুণ কাহিনীগুলি জানতে পারলে দেশে থেকে নারী গৃহকর্মী প্রেরণে নতুন করে চিন্তা করবেন। আসুন হায়নাদের হাত থেকে দেশের অসহায় নারীকর্মীদের রক্ষা করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমত চেষ্টা করি।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top