logo
news image

বিদায়ী বছরে চট্টগ্রামে ঋণখেলাপি ৬৬৮ ব্যক্তি

বিদায়ী বছরে চট্টগ্রামের ৬৬৮ খেলাপি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় রয়েছে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প গ্রুপ ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত। তবে মামলা করলেও পাওনা আদায়ে চিন্তিত অধিকাংশ ব্যাংক ব্যবস্থাপক। কারণ মামলার প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে প্রচুর।

ব্যাংক ও অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, ভোজ্য তেল আমদানিকারক, আবাসন নির্মাতা, পোশাক উৎপাদন ও জাহাজ ভাঙা শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের পাইকারি পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক প্রয়োজনের বিভিন্ন সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হতে ঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের ৬৬৮ ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান। আর এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৭, ফেব্রুয়ারিতে ৪০, মার্চে ৫৩, এপ্রিলে ৫১, মে’তে ৩২, জুনে ৫৪, জুলাইয়ে ৩৬, আগস্টে ৬৮, সেপ্টেম্বরে ৬৫, অক্টোবরে ৫৪ ও নভেম্বর মাসে ১৯৯টি মামলা করা হয়। তবে ডিসেম্বরে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ সময় কোনো মামলা হয়নি।

মামলার বাদী ব্যাংকগুলোর একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, কয়েক বছরে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তা ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাংক পরিচালনা করাটা রীতিমত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ঋণখেলাপি হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলা হয়েছে ৭৪৪টি। এর আগে ২০১৫ সালে মামলা হয় ৯৫৮টি ও ২০১৪ সালে ৪৫৪টি।

ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখা ব্যবস্থাপক শফিউর করিম মজুমদার বলেন, ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অফিসে গিয়েও ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে দেখা মিলছে না। আর ফোনে তো পাওয়াই যায় না। ফলে এসব পাওনা আদায়ে খুব চিন্তিত আছি। এক্ষেত্রে কয়েকবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিস দেওয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। ফলে মামলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত চিন্তায় দিন কাটছে।’

ঋণখেলাপি একাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, আগ্রাসী ব্যাংকিং, ব্যাংকঋণের সুদ বেশি, ব্যবসায়িক অদক্ষতা, টানা লোকসান, ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতনের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এমন অবস্থা। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে, যাতে ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের টাকা সুদে-আসলে পরিশোধ করতে পারেন।

মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংক এশিয়ার উদ্যোক্তা জহির উদ্দিন বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কাটিয়ে ওঠার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি সুদারোপ স্থগিত করে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি নতুনভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার গ্রুপের ঋণের বিপরীতে এ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করলেও মূল ঋণের টাকা কমেনি। ব্যাংকগুলো সুদের ওপর সুদ গুনে যাচ্ছে।’

খেলাপি ঋণের গ্রাহকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাহিদ এন্টারপ্রাইজ, টেকনো বিল্ডার্স, সি টেক্স, বেনজা স্টিল, রোজ গার্ডেন, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স এমএম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মোরশেদ ইন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সৌদিয়া স্টোর, জাহিদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স হেরিটেজ গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম, মেসার্স হক মেডিকো, মেসার্স রনি ফ্যাশন অ্যান্ড ওয়্যারস লিমিটেড, নাজমুল হুদা, নেয়ামত উল্লাহ, মেসার্স চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ, আবদুল আলীম, মেসার্স একেআর করপোরেশন, জাহিদ হোসেন মিয়া, লিজেন্ড হোল্ডিংস, সেভেন বি অ্যাসোসিয়েট, মাবিয়া শিপব্রেকার্স ও মাবিয়া স্টিল, মেসার্স সাফি অটোমোবাইল,  মেসার্স আসমা অটো মোটরস, মেসার্স কোস্টাল ফুডস, মেসার্স পিকে করপোরেশন, এমআর শিপিং লাইনস, মেসার্স সায়মন পেপারস হাউজ, ট্রেডমার্ক, ওয়ান ফ্যাশন ডাবল ক্লিক ডটকম, খাজা ট্রেডিং, আবু তালেব অ্যান্ড ব্রাদার্স, ছগির অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স এসএম করপোরেশন,  মেসার্স আবেদন টেক্সটাইল মিল, বনলতা গ্রুপের মালিকাধীন প্রিটি অ্যাপারেল ও বনবীথি ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেডে, বেস্ট ফ্যাশন প্রা. লিমিটেড, জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান এসকে শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড স্টিল লিমিটেড, গাউসিয়া ক্রোকারিজ, অটো এসি পার্টস, লোটাস এন্টারপ্রাইস, জমজম স্টোর, মেসার্স আলম স্টোর, প্যারাগন অপু অটো ব্রিকস, রুবাইয়া প্লাস্টিক ইন্ডাস্টিজ, মেসার্স মিশম্যাক শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ, নাইট ফ্র্যাঙ্ক ডেভেলপম্যান্ট লিমিটেড, মেসার্স এ জামাল অ্যান্ড ব্রাদার্স, চয়েস গার্মেন্টস, মিশমেক ডেভেলপম্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড, শাহেদ শিপব্রেকিং লিমিটেড, শাহ আমানত আয়রন, এ মেরিন টেকনিক্যাল সার্ভিসেস, আরাজ গার্মেন্টস, সুলতানা শিপব্রেকিং লিমিটেড, লার্ক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড, অপূর্ব ফ্যাশন, মাবিয়া শিপব্রেকিং লিমিটেডসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচার না হওয়া, সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার খেলাপি ঋণের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাদের মতে, এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আগামীতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। অপরদিকে দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিরছে না গতি। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বাড়ছে না, অন্যদিকে আগে বিতরণ হওয়া ঋণের টাকাও ফেরত আসছে না। এতে করে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, যা সার্বিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে ও ফেলবে।

 

সূত্র: শেয়ার বিজ

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top