মো. আকতারুল ইসলাম । ।
ছাত্র
আন্দোলনের প্রতিকৃত, আন্দোলনের অগ্নি স্ফুলিংগ পাকিস্তানের আইয়ুব খানের
সামরিক সরকারের অন্যায়, বৈষম্যএবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচার আইয়ুব খানের
গঠন করা শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনের দূর্বার সৈনিক ৬৩
সালে ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট
আইয়ুব খানের গাড়িতে জুতা মেরে ছাত্রত্ব হারানো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা বসির উদ্দিনের পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকী ২৯
মার্চ। ২০১৪ সালের এই দিনে এ দেশে ছাত্র আন্দোলনের পথিকৃত বসির উদ্দিন
মৃত্যু বরণ করেন।
বসির
উদ্দিন ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার রঘুনাথপুর
গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র রাজনীতির সাহসী
সৈনিক চেহারা আর গ্রামের জোতদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় ছোট বেলা থেকেই
সাহেব হিসেবে পরিচিতি পান।
বসির
সাহেব ১৯৫৭ সালে বাঘা উপজেলার কালিদাসখালী হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন
পরীক্ষা পাস করেন। আই এ পাস করেন নাটোর নবাব সিরাজদৌলা কলেজ থেকে। এনএস
কলেজে বিএ পড়ার সময় ১৯৬১-৬২ সালে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। বিএ পাস
করার পরে ১৯৬৩ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাসে মাস্টার্স এ ভর্তি হন। তখন
শরীফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে পূর্ব বাংলায় ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে। রাজশাহী
বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বসির উদ্দিন। এসময় পাকিস্তানের
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে আসলে বসির তাঁর গাড়িতে জুতা মেরে
আটক হন। প্রাণে বেঁচে গেলেও হারান বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব । তার
সার্টিফিকেট লাল কালি দিয়েছে পাকিস্তান সরকার বলে জানা যায়। এ ঘটনায় তাঁর
জীবনে বড় ধরণের ধাক্কা খান বসির উদ্দিন। এর পরে স্বাধিকার তথা দেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। তিনি একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের
সময় পাবনার পাকশি কলেজে শিক্ষকতা করেন এবং স্বাধীনতার জন্য মক্তিযুদ্ধকালীন
দিকনির্দেশনা এবং এলাকার মানুষদের সংগঠিত করেন। সাংসারিক জীবনে সময় না
দেয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী তাদের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণকারী
বন্ধুর সাথে চার সন্তান নিয়ে চলে যাবার পর বড় ধরনের আঘাত পান বসির সাহেব।
তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সময়ে ৭২ সালে
আবার রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে পা রাখেন। তিনি পুনরায় মাস্টার্স করেন ইংরেজীতে
এবং চাঁপাই নবাবগঞ্জের রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজে ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে
যোগদান করেন। তিনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন এবং এর পরে তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে
যোগ দেন পঞ্চগড় জেলার রহিয়া ডিগ্রী কলেজে। পরবর্তীতে ৭৮ সালে বশির সাহেব
অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদেন রাজশাহী জেলার আড়ানী ডিগ্রি কলেজে। আড়ানী কলেজের
ম্যানেজিং কমিটির সাথে নানান বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে কুচক্রী মহলের
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মামলায় জর্জরিত হন এবং ৮৪ সালে তাকে কলেজ থেকে সাময়িক
বরখাস্ত করে বেতনভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। মনের দিক থেকে একেবারে ভেঙ্গে
পড়েন এই শিক্ষানুরাগী। ফিরে যান পৈত্রিক ভিটা রঘুনাথপুরে। নিদারুন কষ্টে
দিন কাটে বসির প্রিন্সিপালের। বেকার জীবনে কষ্টে সংসার চালানো তার ওপর
মামলা চালিযে নেয়া তাঁর জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পরে আদালত থেকে তাঁর পক্ষে
রায়ও পান এই প্রিন্সিপাল। মামলায় ডিক্রি লাভের পরও তিনি কলেজে যোগদান করতে
পারেননি। ততদিনে চলে গেছে পৈত্রিক সম্পত্তিসহ অনেকগুলো বছর। বকেয়া
বেতন-ভাতার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন যা এখনো
চলমান। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় স্ত্রী ও ৬ ছেলে নিয়ে জীবন সায়হ্নে এসে এই
শিক্ষাবিদ সংসার চালাতে ১৯৯১ সালে নাটোর জামহুরিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ইংরেজীর
শিক্ষক হিসেবে সামান্য বেতনে চাকুরীতে যোগ দেন। জামহুরিয়া মাদ্রাসায় ১০
বছর চাকুরি করে অবসর নেন ২০০১ সালে। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে জীবনের শেষ দিকে
এসে নিদারুন কষ্টে দিন কাটে এই বসির সাহেবের এবং অর্থাভাবে তিনি নিজের
সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেননি।
পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, ছাত্র আন্দোলনের
পথিকৃত, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মনের কাছে পরাজিত হয়ে নিভূতচারী
হয়ে সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে সাংসারিক অনটনে জীবনকে টেনে নিয়ে আসেন ২০১৪
সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত। মৃত্যুর পরে রঘুনাপুরে পৈত্রিক ভিটায় চির নিদ্রায়
সায়িত হন। অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদী কন্ঠ, এক সময়ের তুখোড় এবং ত্যাগী
ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষানরাগী এই সাহেব আমাদের কাছে
মূল্যায়ন পাননি। নিভূত পল্লী থেকে উঠে আসা এমন শিক্ষা প্রেমী ছাত্র নেতৃত্ব
এবং সংগঠক আমাদের জন্য একটি অনুপম দৃষ্ঠান্ত। দেশ প্রেমের উজ্জল দৃষ্টান্ত
স্থাপনকারী এই সাহেবকে নতুন প্রজন্ম স্মরণে রাখবে চিরদিন। তাঁর মৃত্যু
দিবসে এই আমাদের প্রত্যাশা। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা
সাম্প্রতিক মন্তব্য