logo
news image

ডাকসু নির্বাচন চাই-তবে...

জুলফিকার আলি মাণিক।  ।  
লজ্জার হলেও সত্য বলতে কুণ্ঠা নেই, স্কুলজীবনে ভালো ছাত্র ছিলাম না। ফলে বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে শিক্ষাবর্ষের ক্ষতি হওয়ার মতো দুর্যোগও গেছে। স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠী বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে গেছি, তারা এগিয়ে গেছে। এগিয়ে যাওয়া বন্ধুদের যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, তাদের সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভোট দেওয়ার। কলেজে ঘুরে দাঁড়ালাম। ভালো পড়ালেখায় ভালো ফল মিলল। নব্বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের ছাত্র হলাম। কিন্তু ভর্তির আগেই নির্বাচন শেষ; তাই ডাকসু নির্বাচনের ট্রেন ধরার সৌভাগ্য হয়নি; স্কুলে বাজে ছাত্র হওয়ার খেসারত।
'৯১-এ ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনের প্যানেল গোছানোর তৎপরতাও শুরু হয়। একটি ছাত্র জোট আমার হলে তাদের প্যানেলের একজন প্রার্থী হতে বলেছিল। হতাম কিনা জানি না; কিন্তু ডাকসুতে ভোট দেওয়ার উত্তেজনায় ছিলাম। তাও আমার জীবনের প্রথম কোনো ভোট; শেষ পর্যন্ত সেই সৌভাগ্য ধরা দেয়নি। কেননা, নির্বাচনই হয়নি। '৯০-এর পর অদ্যাবধি ২৮ বছরে আর হয়নি ডাকসু নির্বাচন। এ বছর দেশের 'দ্বিতীয় পার্লামেন্ট'খ্যাত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তৎপরতার কথা শুনছি। ডাকসুতে ভোট দিতে না পারার আক্ষেপটা আজীবন থাকবে; কিন্তু আমিও চাই ডাকসু নির্বাচন হোক। তবে আমার চাওয়ার তালিকায় আছে আরও কিছু।
এক. শুধু ২৮ বছর পর একবার নয়, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছরই যেন হয় ডাকসু নির্বাচন। তা যেন আর কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনের বা যে কোনো সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার পুতুল না হয়।
দুই. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে নির্বাচন। না হলে নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা নতুন করে ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে নূ্যনতম সততা এবং অস্ত্র ও পেশিশক্তি বর্জিত নির্বাচন প্রত্যাশিত। ভোটারদের ভীতিহীন অংশগ্রহণ এবং ভোটের রেফারিদের নিরপেক্ষ ভূমিকা কাঙ্ক্ষিত। বহিরাগতদের ব্যবহার ও প্রতিপক্ষকে দৌড়ের ওপর রাখা যেন নির্বাচনে জয়ের মন্ত্র না হয়। ভোটের জন্য ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার সংকট কাঙ্ক্ষিত নয়। সুষ্ঠু ভোটে জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা দেখার আশা রাখি। নির্বাচনের পর বিজয়ী ও পরাজিত কোনো পক্ষের দানবীয় কর্মকাণ্ড দেখতে আগ্রহী নই।
তিন. '৯০ সাল থেকে সাংবাদিকতা শুরু করি। একাধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাংবাদিক। ফলে ছাত্র রাজনীতিসহ ক্যাম্পাসের অনেক কিছুর গভীরে গিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। অনেক ছাত্রনেতাকে বছরের পর বছর অস্ত্র হাতে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছি। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বাধাহীন মহড়া এবং বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর সশস্ত্র যুদ্ধ দেখেছি। রক্তপাত ও প্রাণহানি ঘটেছে চোখের সামনে। মৃত্যু হতে পারে, এমন সন্ত্রাসের মাঝে নিজেও পড়েছি। ক্লাস, পরীক্ষার হল ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। বহুবার বন্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা। আকস্মিক বন্ধে, অনিশ্চিত গন্তব্য সত্ত্বেও হল ছেড়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে ছেলেমেয়েরা।
চার. '৯০-এর দশকের শুরুর দিকে ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসের 'হল দখল' সংস্কৃতির ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছিলাম সাপ্তাহিক 'কাগজে'। প্রকাশ্যে ও গোপনে অনেকের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল। জহুরুল হক হলের গেস্টরুমে সশস্ত্র অবস্থান নেওয়া এক গ্রুপের ছাত্রনেতা নিজের ও অনুসারীদের সশস্ত্র বেশেই সাক্ষাৎকার দিলেন। এ জন্য তাদের মধ্যে একবিন্দু সংকোচ ছিল না। হলগুলোর ভেতরেও নিজেদের দেওয়া নামে ব্লক বানিয়ে (যেমন- 'সাদ্দাম ব্লক', 'বুশ ব্লক') ভাগাভাগি করে দখলে রাখত সশস্ত্র নেতারা। উগ্র বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যও 'গালকাটা' অমুক, 'কুত্তা' অমুক- এ ধরনের বাজে নাম হতো তাদের। ক্যাম্পাসের খাবারের ক্যান্টিন-দোকানগুলো যেন ছিল তাদের নিজস্ব সম্পত্তি, বিনামূল্যে খেতেন। পেটের দায়ে ক্যাম্পাসে আসা দরিদ্র আখের রস বিক্রেতার আখও টাকা না দিয়ে খেতে দেখেছি সশস্ত্র ছাত্রনেতাদের। কেউ কেউ ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানি করত। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও বর্বর ব্যবহার করতে দেখেছি।
পাঁচ. পরিচয়ের সুবাদে অস্ত্রধারী ছাত্রনেতা বা ক্যাডারদের হলের রুমে যেতাম। নতুন আমদানি হওয়া বাহারি অস্ত্র দেখাতেন উৎসাহ নিয়ে। এমন সশস্ত্র অনেক ছাত্রনেতা বা ক্যাডারদের অনেককে রাজনৈতিক দলের হয়ে জাতীয় সংসদের এমপি হতে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাহচর্যে দেখেছি।
ছয়. ছাত্র রাজনীতি হয়েছে শিক্ষক রাজনীতি বা শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অদৃশ্য শক্তি। আবার শিক্ষক রাজনীতির ঘুঁটিও হয়েছে ছাত্র রাজনীতি। ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমেও জাতীয় রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নোংরা খেলার প্রাঙ্গণেও পরিণত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিকে পুতুল বানায়। ছাত্র রাজনীতি হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত ও দলের বাণিজ্যের পুঁজি।
সাত. আশির দশকের শেষ ভাগের ঘটনা- কলেজে পড়ি। মাঝেমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতাম এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মিছিল- সমাবেশে অংশ নিতে। একদিন দুপুরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে যাই। ডাকসু ভবনের সামনে আমাদের ও ছাত্রদলের মিছিল মুখোমুখি। দুটিই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের। তারপরও প্রতিপক্ষ বলে চাপা উত্তেজনা ছিল। ঝামেলা ছাড়াই পাশ কেটে পেরোল। কিন্তু পেছন থেকে আমাদের মিছিলে ইটপাটকেল পড়তে শুরু করল। ব্যস, শান্তি গেল উড়ে।
আট. নতুন প্রজন্মগুলোর কাছে 'ইসলামী ছাত্র সংঘ' অপরিচিত। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের আদি নাম। তারাই ঘাতক আলবদর বাহিনী গঠন করেছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। হত্যা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকসহ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের। স্বাধীনতার পর ছাত্র সংঘ নাম পাল্টায়। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে 'ইসলামী ছাত্রশিবির' নামে পুনরায় জন্ম নেয়। পুনর্জন্মের স্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ। প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে হাত-পায়ের রগ কাটার প্রচলন করে। ফলে 'রগ কাটা' সংগঠনের পরিচিতি পায় ইসলামী ছাত্রশিবির। ক্যাম্পাসের মসজিদে জন্ম নিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে দঁাঁড়াতে পারেনি আজও। গোপনে বা ছদ্মবেশে কাজ করে। তবে দশ বছরে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, তাদের ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে ছাত্রশিবিরের ছেলেরা। বিএনপির ছাত্রদল আর শিবির বড় বন্ধু। ডাকসু নির্বাচন ঘিরে নানা সংগঠনের ছত্রছায়ায় ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে জায়গা করার চেষ্টা করবে। ব্যবহার করতে পারে ক্যাম্পাসের মসজিদগুলো।
শেষ. মাত্র দুই বছর পর, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর। তার আগে ডাকসুর প্রত্যাবর্তন আনন্দের। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দুর্ভাবনা হলো- ডাকসু সচল করতে গিয়ে ক্যাম্পাস না অচল হয় আবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি হওয়ার মতো পুরনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণগুলো ডাকসু নির্বাচন ঘিরে আবারও যেন ফিরে না আসে, সেই নিশ্চয়তা-অঙ্গীকার জরুরি। অন্যথায় ডাকসুর পুনরুজ্জীবন হবে হরিষে বিষাদ।

* জুলফিকার আলি মাণিক: স্ট্রিংগার, নিউইয়র্ক টাইমস। 

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top