logo
news image

সেই ছবি আর পাঠাবেন না খোকন ভাই

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ।  ।  
প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় একবার সিরাজগঞ্জের একটা প্রতিবেদন ছাপা হলো, তার শিরোনাম ছিল ‘ওষুধ বটে’। নিউজটা পড়ে এতই মজা পেয়েছিলাম যে তারপর থেকে প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিকে আর কোনো দিন আমি তাঁর নাম ধরে ডাকিনি। এনামুল হকও বলিনি। ডাক নাম খোকনও বলিনি। ফোনে ‘ওষুধ’ বলে একটি চিত্কার দিলেই খোকন ভাই বুঝতে পারতেন ফোনের ওপাশে আমি।
গত ১ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিনিধি সম্মেলন শেষে বার্তা সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলীকে বললাম, সিরাজগঞ্জে একটা ভালো প্রতিবেদনের জিনিস আছে। শুনে বললেন, খোকন ভাইয়ের সঙ্গেই যান। এখনো আছে। আমি ফোন করলাম ‘ওষুধ’ কোথায়? কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি প্রথম আলোর বার্তাকক্ষে এসে হাজির হলেন। একটা পরিকল্পনা করলাম। বললাম, আমি রাতে মিরপুরে থাকব। খোকন ভাই আমার হাত ধরে টানতে টানতে বললেন, ‘কিসের মিরপুর! চলেন, আমার বাসায় থাকব। বাসায় ছেলে আর ছেলের বউ ছাড়া কেউ থাকে না। আমার একটু ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন ছিল। এক দিন পরে যেতে চেয়েছিলাম। তো আপনি যখন যাবেন, কালই যাই। ছেলেকে ফোন দিই গাড়ি নিয়ে আসুক। রাতেই ডাক্তার দেখিয়ে নিই।’ ফোন পেয়েই খোকন ভাইয়ের ছেলে গাড়ি নিয়ে এল। তার ডাক্তার দেখানো হলো। বাসায় ফেরার পথে
ছেলেকে এক জায়গায় গাড়ি থামাতে বললেন। আমাকে কানে কানে বললেন, বউমার জন্য একটু ফলমূল নেবেন। বাসায় তাঁর ছেলে আর ছেলের বউয়ের সমাদর মনে রাখার মতো। খাওয়াদাওয়া করে আমি আর খোকন ভাই এক বিছানায় একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। ট্রেন ধরার জন্য ভোরে উঠতে হবে, তা ভুলে দুজনেই গল্পে মেতে উঠলাম। খোকন ভাই কীভাবে সাংবাদিকতায় এলেন, তার আগে কী করতেন। তাঁর তিন ছেলে। বড়টা একটা চাকরিতে আছে। মেজ ছেলের বাসায় আমরা ছিলাম। ওই ছেলে-বউ দুজনেই চাকরি করে। তারা বেশ আছে। বললেন, বউমা খুব ভালো। নিয়মিত তাঁর শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজখবর রাখে। অনিয়ম করতে দেয় না। বলতে গেলে তাঁকে শাসন করে। সেদিনের গল্প অনেক লম্বা ছিল। কথাবার্তায় বুঝলাম তিনি বেশ স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ। প্রতিদিন সকালে উঠে লেবু-পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে নিয়মিত খান। তার সঙ্গে আরও কী কী অনুপান যোগ করে নেন ইত্যাদি আমাকে শিখিয়ে দিলেন। বললেন, নিয়মিত খাবেন।
হঠাৎ করেই খোকন ভাই বললেন, ‘আমি তিন ছেলের জন্য একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তাদের জন্য এটা যথেষ্ট। এখন তারা নিজেরা কিছু করতে পারলে আর ভাবতে হবে না।’ ছেলেদের জন্য ব্যবস্থা করে রেখে যাচ্ছেন—এই কথা যেন আমাকে একটা ধাক্কা দিল। এর আগেও তাঁরা আমাকে এ রকম কথা বলেছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমার সেটা শেষ দেখা ছিল।
ভোরে আমাদের আগেই ছেলে উঠে গেছে। ওই ভোরেই কিছু নাশতা না করে আর ছাড়াছাড়ি নেই। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছেলে বাবার ব্যাগে হরেক রকম জিনিস ঢুকিয়ে দিতে লাগল। একবার একটা দিয়ে যাচ্ছে, আবার আরেকটা নিয়ে আসছে। দেখে মনে হলো ছেলেটাই যেন বাবার অভিভাবক। সে গাড়ি করে আমাদের বিমানবন্দর স্টেশনে রেখে গেল। তার আগেই অনলাইনে আমাদের দুজনের জন্য টিকিট কেটে রেখেছিল। যমুনা পার হয়ে শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্টেশনে নামলাম। একটু হেঁটে গিয়ে সিরাজগঞ্জের নলকার মোড়ে একটা দোকানে বসে চা খেলাম। সেখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা পলাশ। তাঁর বাড়ি কামারখন্দ থানার বাজার ভদ্রঘাট শেখপাড়ায়। সেখান থেকে দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরে। একটা প্রতিবেদন করার জন্য আমাদের ওখানেই যাওয়া। পলাশের ওখানে গিয়ে আমরা সব তথ্য নিলাম। একটা বাগান নিয়ে প্রতিবেদন। বললাম, খোকন ভাই স্টোরি লিখব আমি আর ছবি পাঠাবেন আপনি। তাই খোকন ভাই ধানখেতের ভেতর দিয়ে গিয়ে অনেক কষ্ট করে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললেন। পলাশের মা ছাড়লেন না। আমরা একসঙ্গে খেলাম।
ফুলজোড় নদীর ধার দিয়ে ফিরছিলাম। রাস্তাটি ছিল নির্মাণাধীন। একটা গাড়ি পার হওয়ার সময় এত ধুলা উড়ছিল, আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। খোকন ভাই অটোরিকশা থামিয়ে ধুলার ছবি তুললেন। বললেন, ‘একটা স্টোরি করব। ঠিকাদারেরই পানি দিয়ে এই ধুলা নিয়ন্ত্রণ করার কথা।’
আমরা নলকার মোড়ে এসে বাসে উঠলাম। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ফুড ভিলেজের কাছে এসে দুজনেই বাস থেকে নামলাম। প্রথম আলোর ঢাকা অফিস থেকে নামার পর এই পর্যন্ত খোকন ভাই আমার পকেট থেকে একটি টাকাও বের করতে দেননি। এবার দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেল। খোকন ভাই বললেন, ‘এখন বাড়ি (শাহজাদপুরের তালগাছি) যাই। বিকেলে মোটরসাইকেল নিয়ে আবার সিরাজগঞ্জে আসব।’ কে জানত মাত্র ১৫ দিন পরে এই মোটরসাইকেলই খোকন ভাইয়ের কাল হবে। প্রথম তাঁর ছেলে আমাকে ফোন করল, রক্ত জোগাড় করতে পারছে না। খবরটা প্রথম আলোতে একটু জানাতে হবে। আমি রওশন ভাইকে জানালাম। মাঝে খবর নিয়েছিলাম। ঢাকায় ইউনাইটেড হাসপাতালে আছেন। নাম বললে চিনতে পারছেন। শুনে ভরসা পেয়েছিলাম। ৯ জানুয়ারি খবর পেলাম শেষ ভরসাটুকু আর নেই।
মনে পড়ছে, গ্যাস নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেছিলাম। খোকন ভাই সিরাজগঞ্জ থেকে রাতে ছবি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এবারের তোলা ছবিগুলো আর পাঠাবেন না। আমিও আর ফোন করে ‘ওষুধ’ বলে কাউকে ডাকব না।

* আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী। 

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top