logo
news image

শীতের মজা ও সাজা এবং পোড়ের আগুনের দহন

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম।  ।  
এবারের শীতে নেই তেমন কোন মজা, কোন আমেজ! কারণ, বাচ্চাদের পরীক্ষা যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না! একটার স্কুলের পরীক্ষা শেষ হতেই আরেকটার কলেজেরটা শরু আর সেটার যখন শেষ হবে তখন বিশ^বিদ্যালয়ের শুরু হবে আর এমনি করে করে শীতকালটা ফুরিয়ে যাবে। তাই পরিবার নিয়ে কোথাও বের হতে পারবেন না বলে নিচের ভাবীসাব মুখটা গোমড়া করে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন। শুনে মনে হলো- এবারের শীতে শহরের বাইরে দূর গাঁও-গেরামের নির্ভৃত কোন ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা জায়গায় ভ্রমণে যেতে না পেরে তার জীবনটাই বৃথা হয়ে গেল। হবেই না বা কেন? জন্ম তো সেই কাদা মাখা, দেহ-ঢাকা পল্লী মায়ের আদরের আঁচলে। এটা একজন ভাবীর মনের আক্ষেপের কথা হলেও আমার মনে হয় অনেক হাজার হাজার শহুরে দালানের বস্তিতে বাস করে গ্রামের জন্য হা-পিত্যেশ করা ভাবীদের মনের কথা তিনি বলে দিয়েছেন।
যাহোক, গ্রাম সব সময় মানুষকে টানে। যদিও গ্রামগুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কোন পরিবারের একজন উচ্চশিক্ষিত হলেই হলো। তিনি আর গ্রামে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবেন না। উচ্চশিক্ষিত হলেই শহরে গিয়ে চাকুরী করতে হবে। তার জন্য গ্রামের চিরচেনা শান্তিময় পরিবেশ যেন বিষিয়ে উঠে। কারণ গ্রামে নেই কোন অফিস, নেই কোন হাসপাতাল অথবা বাসস্থানের অবকাঠামো। শুধু তাই নয়-জেলা শহরে যে হাসপাতাল বা বিশ^বিদ্যালয় গড়ে ওঠার কথা সেটাও জায়গা নিয়েছে রাজধানী ঢাকার কোন আবাসিক এলাকার গলিতে বা ঘিঞ্জি কাঁচা বাজারের ছাদে! তাইতো একটি রাজধানী শহরে যদি পাঁচ বছরের মধ্যে অপরিকল্পিতবাবে শুধু ব্যবসায়িক ধান্ধায় একশতটি ব্যক্তিগত বিশ^বিদ্যালয়, পাঁচশতটি ব্যক্তিগত মার্কেট ও হাসপাতাল গড়ে উঠে তাহলে শিক্ষা ও চিকিৎসা নেয়ার জন্য প্রতিদিন কত লক্ষ মানুষের আনাগোনা ঘটে এবং কেমন যানবাহনের জট লেগে যায়-তা ভুক্তভোগী মাত্রই ভাল জানেন। তাইতো মানুষ সহজাত তাগিদেই একটু সবুজের দিকে ফিরে যেতে চায়। হোকনা তা কিছুদিনের জন্য!
গ্রামীণ শীতকাল অনেক কিছুর সাথে উপহার দেয় টাটকা শাক-সব্জী ও মিষ্টি খেজুরের রস। জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে বাধ্য হয়ে শহরে বসতি গেড়ে নেয়া অনেকে গ্রামের রসের পিঠা, ভাপা পিঠার কথা ভুলতে পারেন না। তাইতো সেটা যখন শহরের রাজপথের পাশে ময়লা ধুলোবালিতে কোন ফেরিওয়ালাকে বানাতে দেখেন- তক্ষুনি তার মনে জেগে ওঠে গ্রামের কথা। কেউ কিনে সেখানেই খেতে শুরু করে দেন কেউবা কিনে বাসায় নিয়ে যান।  ফেরিওয়ালার ঠেলা গাড়ির পাশে দাড়িয়ে কিনে অথবা অভিজাত দোকানে গিয়ে বসে যত বাহারি ভাপা-পুলি খাই না কেন সেটাতো শীতের সময় গ্রামে তাজা খেজুরের রস ও নতুন চালের তৈরী পিঠা ‘পোড়ে’ জ¦ালানো আগুনের  পাশে বসে খাওয়ানোর সংগে তুলণীয় হতে পারে না।  আর সেই পিঠা যদি মা নিজ হাতে তৈরী করে মুখের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলেন- বাবা, আরেকটা খেয়ে দেখ না? তাহলে কেমন হয়? স্বর্গ তো দুনিয়াতেই মনে হবে-তাই না?
এছাড়া, পোড়ের ছাইচাপা আগুনে মিষ্টি আলু পোড়ানো, ভুট্টা, মটরশুটি বা নোয়া ডাং (এক ধরনের লম্বা লাল ধান) ধানের খৈ ফুটিয়ে গরম গরম খাওয়া- ইত্যাদি তো অনেকের মধুর সুখস্মৃতি বৈ কিছু নয়! আর এগুলো করতে গিয়ে অনেকে আতœভোলা হয়ে যায়। বিশেষত: ছোট শিশুরা। তারা হাত-পা পুড়িয়ে ফেলে। সাধারণত: শীতকালে বেশী বয়স্ক মানুষেরা বেশী ঠান্ডা অনুভুব করেন। তাদের গায়ে গরম কাপড়ের সাথে কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে নিতে দেখা যায়। এছাড়া সেগুলো পরেই তাদের অনেকেই দীর্ঘ সময় পোড়ের আগুনের পাশে বসে থাকতে পছন্দ করেন। শহরের মানুষ অথবা নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না ’পোড়’ অর্থ কি।  ’ পোড়’ বলতে সাধারণত: ধান-গমের নাড়া, খড়, ভুট্টা ও খেসারী কলাইয়ের শুকনো ডান্ডা, গাছের ঝরাপাতা, গোবরের ঘষি, শুকনো ঘাস, ইত্যাদি দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়ে থাকে। এলাকাভেদে এসব উপকরণের ভিন্নতা লক্ষণীয়। অনেকগুলো উপকরণ একসংগে জড়ো করে বাড়ির ভেতর বা বাহির আঙ্গিনায় ‘পোড়’ বা আগুনের ঢিবি বানানো হয। ‘পোড়ে’-র মধ্যিখানে বেশকিছু ধানের তুষ দিয়ে দেয়া হয় যাতে সারাদিন আগুন জ্বালিয়ে রাখা যায়। কৃষাণ-কৃষাণী পরিবারের সবাই সকালে ‘পোড়ে’-র চতুর্দিকে গোল হয়ে বসে আগুন পোহান।
গ্রামে বেশীরভাগ বাড়িতে এখন টিনের চালা দেয়া ঘর। এ ঘরগুলোতে রাতে টিন ঠান্ডা হতে হতে শেষরাতে আরো বেশী ঠান্ডা অনুভুত হয়। তাইতো অনেকেই বিছানা ছেড়ে কাকাডাকা ভোরে খড়কুটা জ্বালিয়ে ‘পোড়ে’-র আগুনের তাপে শীত নিবারণ করার চেষ্টা করে থাকেন। আগুন জ্বালানোর এই কৌশলটি গ্রামের অতি পুরাতন ঐতিহ্যও বটে।
‘পোড়ে’-র আগুন পোহানো মজার ব্যাপার। এটা একটা অতি পুরনো গ্রামীণ কৃষ্টি। তবে বিপদ হলো- প্রতি শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে অজান্তে শরীরের কাপড়ে আগুন লেগে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। গত বছর সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ২.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমেছিল। আগুন পোহাতে গিয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক বেশী হয়েছিল। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম ও লালমণিরহাট জেলায় শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে ৬ জন সহ দেশের অন্যান্য স্থানে বাচ্চা ও বৃদ্ধাসহ ২২ জন দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৪০০ জন বার্ণ ইউনিটে ভর্তি হয়েছিল (ঢাকা ট্রিবিউন ২৮.০১.২০১৮)।
এবছর শীতের শুরুতেই আগুন পোহানোর কারণে দেশের কয়েক জায়গায় দুর্ঘটনার খবর জানা গেছে। শীত নিবারণে আগুন তাপাতে গিয়ে গত তিনদিনে দেশের উত্তরাঞ্চলে দুজন মারা গেছে এবং হাসপাতালে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে (ইত্তেফাক ০৭.০১.২০১৯)। তবে এটা যেন আর না ঘটে সেজন্য সবাইকে সতর্কতার সাথে পোড়ের পাশে বসতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কগণ যাতে পোড়ের আগুন তাপানো পোহানো থেকে বিরত থাকেন সেজন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত গরম কাপড় ও গরম পানীয় ও খাবার সরবরাহ করতে হবে। শৈত্য প্রবাহের আগাম সংবাদ গ্রামে-গঞ্জে মাইকিং করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি বছর শীত  এলেই কিছু মানুষ নানা সংগঠনের নামে শীতার্তদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা তুলে থাকেন। সেসব অর্থ থেকে যৎসামান্য শীতার্তদের জন্য ব্যয় করা হয়। সেটাও ঘটে বড় বড় শহরের আশে-পাশে। ফলে শহরের একজন দরিদ্র বা বস্তিবাসী একাই অনেকগুলো ত্রাণের কম্বল বা অর্থ পেয়ে যান। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে- একজন ব্যক্তি বারংবার হাত পেতে বিভিন্নজনের নিকট থেকে অনেকগুলো কম্বল পেয়েছেন (দৈ: প্রাপ্তি প্রসঙ্গ ২৮.০১ ২০১৮)। সেগুলো বাজারে নিয়ে গিয়ে পুন:রায় ঐ কম্বলের দোকনে স্বল্পদাম বিক্রয় করে দিয়েছেন !  এতে দেখা যায়- গ্রামের হতদরিদ্র, শীতার্ত মানুষ কিছুই পাচ্ছে না অথচ শহরের দরিদ্র একই মানুষ বার বার সুযোগ নিচ্ছে। মুঠোফোনের এই যুগে এভাবে শহরের দরিদ্র আত্মীয়দের নিকট থেকে এ ধরনের সুযোগের কথা জেনে নিয়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা প্রতিদিন বেশী কিছুর আশায় শহরগুলোতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তাই শুধু শহরের বস্তি ও পার্কে নয়, গরম কাপড় নিয়ে আজই চলুন বন্টন করতে যাই দূর গাঁও-গেরামে যেখানে অজশ্র অশীতিপর শীতার্ত মানুষ এই কনকনে শীতে একটু উষ্ণতার পরশ পাবার আশায় আঁকুপাকু করছে।
আমাদের দেশে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এক হিসেব মতে-দেশে এখনও তিন কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এদের বেশীরভাগ গ্রামীণ ভূমিহীন হতদরিদ্র (হার্ডকোর পুওর) অথবা চরম দরিদ্র (আল্ট্রা-পুওর) শ্রেণির। যাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা অপূরিত থাকে ও যারা মৌল-মানবিক সেবাদান প্রক্রিয়ায় নিজ অংশগ্রহণ অক্ষমতা বিবেচনায় বাদ পরে যায়। যেমন-খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা কিনতে না পারা। উন্নত দেশগুলোতে শহুরে মানুষেরা প্রতিবছর নিজেদের পুরনো জিনিষ, কাপড় ইত্যাদি স্বল্পমূল্যের খোলা বাজারে (ফ্লি-মার্কেট), পার্কে বা গ্যারাজ সেলে রেখে দেয়।  স্বল্প আয়ের মানুষেরা সেগুলো পানির দামে অথবা বিনামূল্যে সংগ্রহ করে। আমাদের ধনী পরিবারগুলোর আলমারীতে যুগ যুগ ধরে অব্যবহৃত পুরনো দ্রব্য, কাপড় ইত্যাদি থাকলেও কখনও গরীবের জন্য হৃদয় গলে না। অথচ, দান-খয়রাত মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ। তাই সমাজের সামর্থ্যবান সবাইকে আহবান করবো নিজেদের অপ্রয়োজনীয় অব্যবহৃত কাপড়-সামগ্রীগুলো মানব কল্যাণে পুণ:ব্যবহারের (রি-সাইকেল) জন্য বিতরণের ব্যবস্থা করুন। এজন্য নিকটস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কাউট বা রোভার-রেঞ্জার, বি.এন.সি.সি. ইউনিটগুলোকে টেলিফোন করে আপনার নিকট থেকে সংগ্রহ করতে উৎসাহিত করুন। তারা নিজ দায়িত্বে গ্রামের গরীব দু:খিদের নিকট সেগুলো পৌছানোর ব্যবস্থা করতে পারে। এভাবে আমরা সবাই শীতের মজা পেতে পারি এবং শীতের সাজা তথা ঠান্ডা ও ‘পোড়ের আগুনের’ সমূহ বিপদ থেকে গ্রামের গরীব দু:খিদের  রক্ষা করতে পারি।
* প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।  E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top