logo
news image

হাজী সবেদ আলী মণ্ডলের স্মৃতিকথা

সাদ আহমেদ।  ।  
বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কত? ৫৫ থেকে ৬০ বছর। যারা বৃটিশ দেখেছেন তারা অনেক বছর জীবনকাল পার করে গেছেন।এখনকার মানুষের এতো কম আয়ু কেন? নানা মানুষ নানা বিশ্লেষণে কথা বনে।কেউ শত বছর বেঁচে আছেন শুনলে বেশ অবাক লাগে।পশ্চিমে মানুষের গড় জীবনকাল ৭০-৮৫ বছরের মধ্যেই থাকে।বাংলাদেশের কোনো মানুষ যদি বলেন তার বর্তমান বয়স ১১৫ বছর। বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। কঠিন হলেও ঘটনাটা কিন্তু বাস্তব।এমন দীর্ঘায়ু জীবনের কথা বিশ্বাস না হওয়ার কারণ কী হতে পারে? মানুষের জীবনের নানা টেনশন, মানসিক চাপ, পরিবেশ দূষণ-সব মিলিয়ে আয়ু তো দিন দিন কমে যাচ্ছে। মানুষ নিয়মিত শরীরচর্চাও করে না। খাদ্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তারা সচেতন নয়। মানুষ হন্যে হয়ে পাহাড় চষে হার্বাল উদ্ভিদ বের করে আনে না। এসব খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাও করে না। শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত বিশেষ কৌশলের চর্চাও করে না।একারনেই তার জিজ্ঞাসা। ামাদের আজকের আলোচনা একজন সাধারণ মানুষ মোঃ ছবেদ আলী মন্ডলকে নিয়ে।
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের চিকাদহ গ্রামের হাজী মোঃ সবেদ আলী মণ্ডল ১১৫ বছর সময়কাল অতিক্রম করে বয়সের ভারে নুঁইয়ে পড়েছেন।তাঁর পিতার নাম মরহুম কেদার মণ্ডল এবং মাতার নাম মরহুমা ছেদ্দা খাতুন। একেবারে অজোপাড়া গাঁইয়ে বসবাস।বয়স কত হয়েছে জানা ছিল না তাঁর।তাই নানা জিজ্ঞাসায় আনুমানিক বয়স নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। তাঁর ভাস্যে খুঁজে পেয়েছি স্থানীয় ইতিহাসের নানা উপাদান।
তার ভাষ্য মতে, ১৩৫০ বঙ্গাব্দে চিকাদহ গ্রামের বর্তমান বাড়ি নির্মাণ করেন।১৩৬০ বঙ্গাব্দে হজ্জে যান। নৌ পথে হজ্জ সম্পন্ন করতে ৬ মাস সময় লেগেছিল।তৎকালীন ইউনয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান লালপুরের আহাদ আলী সরকারের কাছ থেকে হজ্জের কাগজ-পত্র প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন।মসজিদের ইমামতি করেছেন একসময়। তবে হাজি সবেদ আলী লেখাপড়া জানেন না।সে সময় কোনো স্কুলই ছিল না।তখন যেমন গ্রামজুড়ে রাজনীতি ছিল না, ভারতীয় বড় বড় নেতা সম্পর্কেও ধারণা সাধারণ মানুষের সবার ছিল না।তাঁরও রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও শুধু প্রজা হিসেবে জমিদারদের চিনতেন। বর্তমানে অধিক বয়স জনিত কারণে এখন গায়ে সেই শক্তি নেই, হাঁটতে-চলতে পারেন না। কানেও কম শুনেন। জোরে কথা বলতে হয়। আস্তে আস্তে কথা বলেন।চোখে এখনও ভালই দেখেন বলা যায়।কিছু কিছু স্মরন শক্তি এখনও আছে।বিশেষ ঘটনা ছাড়া মনে করতে পারেন না।
কোন কো্ন অতীত স্মৃতি তাঁর মনে আছে। শুধু ঘটনা মনে করিয়ে দিলেই বলতে শুরু করেন। তাঁর জন্ম কত সালে জিজ্ঞাসা করলে বলেন তার জানা নাই।তিনি যা বলছেন তার হিসেব করা কঠিন।যেমন, তিনি কত সালে জন্ম গ্রহন করেছেন মনে করতে পারছেন না অথবা জানা নাই।এ নিয়ে মাথা ব্যাথাও ছিল না কোন দিন।গ্রামে যারা বিখ্যাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাদের বিষয়টা আলাদা। সে সময় অনেক শিক্ষিত মানুষই বলতে পারতো না নিজের জন্ম সন-তারিখের ইতিহাস। দেশের শাসন ক্ষমতায় কে ছিলেন, তিনি জানান বৃটিশরা।পাঁচ আনি, চার আনির জমিদাররা খাজনা নিতে আসত। আর না হয় প্রজাদেরই দিয়ে আসতে হত।এই দুই তরফেরই প্রজা ছিল এ এলাকায়। তিনি পুঠিয়াতে পাঁচ আনি জমিদারের প্রজা ছিলেন। স্মৃতির ভাবনায় তিনি জানাজ, অর্জুনপাড়া গ্রামে প্রাচীনকালে খননকৃত অনেক পুকুর ও তার চারিপাশে পুরাতন হিন্দুদের রাজবাড়ী ছিল। সেগুলির ধংশাবশেষ তিনি কিছু কিছু প্রত্যক্ষ করেছেন। ব্রিটিশ আমলে বলমাড়ীয়াতে নীলের আবাদ নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল। পরে ওরা জানের ভয়ে আবাদ রেখে পালিয়ে যায়।
তেমন কনো ঘটনা কি মনে পড়ে? একটা কাহিনী তিনি জানান, আরবাব গ্রাম থেকে চলে এসে বাগু মোল্লার ছেলে মটক মোল্লা বাগ-ভালুকসহ অন্যান্য বিপদ থেকে নিরাপত্তার জন্য বিলশলিয়ার বিলের মধ্যে বাড়ি করে ‘বিলশলিয়া’নামক গ্রামের গোড়া পত্তন করেন বলে শুনেছি।তিনি বললেন, জমি-জমার আবাদ নিয়ে ব্রিটিশদের সাথে গল্ডগোল হওয়ায় পাঁচ আনি, চার আনি জমিদারের অধীন বিশাল জোতদার বিলশলিয়ার মটক মোল্লার ছেলে ফয়েজ উদ্দিন মোল্লার লোকেরা একবার বিলমাড়িয়ার নীন কুঠির বড় সাহেবের পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজদের বেদম পিটিয়েছিলেন।নীল কুঠির বড় সাহেব ফয়েজ মোল্লার উপর নীল চাষের জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন।কিন্তু জোতদার ফয়েজ মোল্লা নীল চাষ করা তো দুরের কথা, তার লোকজন সাহেবের লোকজনকে বেধড়ক পিটিয়ে বিদায় করেন।নীল কুঠির বড় সাহেব হুঙ্কার দিলেন, ‘জমিদারের জোতদার ফয়েজ মোল্লা এতো ক্ষমতা আর সাহস কে দিল যে ভারত সম্রাট ইংরাজদের গায়ে হাত দেয়।’ পরে পুঠিয়ার জমিদার মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী ফয়েজ মোল্লার পক্ষ নিয়ে শালিস-দরবার করে আপোষ করে দেন। নীল চাষকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ পাইক-পেয়াদাদের সাথে মরহুম ফয়েজ উদ্দিন মোল্লার ৯১৮৬১-১৯৬৬) গল্ডগোল হওয়ায় ঘটনার বিষয়ে মরহুমের উত্তরশুরি মরহুম জাফর উদ্দিন মোল্লা (১৯১৩-১৯৮৬) ও তাঁর সহধর্মিনী ফাতেমা খাতুন (১৯২৪-২০১৮, সদ্য প্রয়াত) এবং মরহুম আব্দুল জলিল মোল্লা (১৯১৫-১৯১১) জীবিতকালে ঘটনার অনুরুপ বর্ণনা করে সাক্ষ্য দেন। সবেদ আলী মন্ডলের তথ্য বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তখন পুঠিয়ার পাঁচ আনির জমিদার ছিলেন হেমন্তকুমারী দেবী। বংশ পরম্পরায় মোট ১৫ রাজা-রানী এ রাজত্ব শাসন করেছেন। হেমন্তকুমারী দেবী লর্ড কার্জনের আমলে ১৯০১ সালে “রাণী”এবং ১৯২০ সালে লর্ড আরউইনের আমলে “মহারাণী”উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৪২ সালে মহারাণী হেমন্তকুমারী দেবী মৃত্যুবরণ করেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ছবেদ আলি মন্ডলের বক্তব্য হচ্ছে, বিলমাড়ীয়ার ইংরাজ নীলকর সাহেবের ফয়েজ মোল্লার উপর রাগ ছিল। কারণ তিনি জমিদারের রায়তো জোতদার ছিলেন। অনুরোধ স্বত্তেও সাহেবের জোত তিনি গ্রহণ করতেন না।ওরা ফয়েজ মোল্লার কিচ্ছু করতে পারেনি। পরে অবশ্য নীল চাষ না করার শর্তে কিছু জমি নীলকুঠির বড় সাহেব তাকে অনুরোধক্রমে দিয়েছিলেন।সেই ফয়েজ মোল্লা তার চেয়ে ২ বছরের এবং ফয়েজ মোল্লার ভাতিজা হাজী শরাফত মোল্লা তার চেয়ে আরো কিছু ছোট বলে হাজি সবেদ আলী জানান।তিনি এও জানান যে, আব্দুলপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মজির উদ্দিন সরকার তার ছোট এবং বিলশলিয়া নিবাসী পাকিস্তান আমলের ইউনিয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান রাহাত আলী মৃধার বাবা উজির আলী মৃধা তার চেয়ে ২/৩ বছরের বড় ছিলেন।ফয়েজ মোল্লার উত্তরাধিকার সুত্রে জানা যায়, ফয়েজ মোল্লা ১৯৬৬ সালে ১০৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। সেই হিসেবে হাজী সবেদ আলীর জন্ম সাল ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে হলে, সে অনুযায়ী তার বয়স হওয়া উচিৎ ১৫৪ বছর। বাস্তবতায় যেটা কোন দিক থেকেই সঠিক বলে গ্রহন করা যায় না।কোনো কোনো সময় তিনি ফয়েজ উদ্দিন মোল্লার দুই সন্তান যথাক্রমে জাফর উদ্দিন মোল্লা ও আব্দুল জলিল মোল্লার থেকে বড় বলে স্মৃতির রোমন্থনের চেষ্টা করেন। বিভিন্ন প্রশ্নের প্রাপ্ত উত্তরে এবং মরহুম ফয়েজ উদ্দিন মোল্লার উত্তরাধিকারদের বক্তব্য অনুযায়ী লেখকের ধারণা এই যে, হাজী সবেদ আলী হয়তো মরহুম জাফর উদ্দিন মোল্লা বা জলিল মোল্লার স্থলে ফয়েজ উদ্দিন মোল্লা হিসেবে স্মৃতি ভ্রম করেছেন।তবে এটা ঠিক যে, উল্লেখিত ব্যক্তিদ্বয় সবেদ আলী মন্ডলের দশ-বার বছরের ছোট ছিলেন। তবে ফয়েজ মোল্লার সন্তান জাফর উদ্দিন মোল্লা ও আব্দুল জলিল মোল্লার সাথে তার বয়সের তুলনা করলে অনেকাংশেই মিলে যাচ্ছে।স্থানীয় বয়স্ক মানুষদের ধারনাও তাই। রাহাত আলী মৃধার উত্তরাধিকারও অনুরুপ কথা বলেছেন যে তিনি উজির আলী মৃধা নয়, রাহাত আলি মৃধার থেকে অনেক বড় ছিলেন। উল্লেখিত প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সাথে তার বয়সের তারতম্য বিশ্লেষণ করলে তার বর্তমান বয়স সহজেই হিসেব করা যায়। তবে ১৩৬০ বঙ্গাব্দে (১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি হজে যান তখন তার বয়স ৫০ বছর বলে তিনি স্পস্ট তথ্য দেন। সে হিসেবে তার জন্ম ১৩১০ বঙ্গাব্দে বা ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে। সুতরাং তার বর্তমান বয়স হবে ১১৫ বছর। বর্তমানে তাঁর ১ ছেলে ও ২ মেয়ে ও ৪ নাতী-নাতনি ৪ পুরুষ বর্তমান আছেন।
(গত ৩ জানুয়ারি তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি)

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top