logo
news image

জাপানে সন্তান জন্ম দিলেই টাকা

অনলাইন ডেস্ক।  ।  
জনসংখ্যা নিয়ে একেক দেশের একেক পরিস্থিতি। বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীনের মতো দেশগুলো জনসংখ্যার ভারে ‘হেলে’ পড়ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কর্মসূচি নিতে হয় এসব দেশে। জাপানসহ ইউরোপের দেশগুলোতে ঠিক এর বিপরীত চিত্র।
জাপানে শিশুজন্মের হার কমতে কমতে ২০ বছর পর কোনো কোনো শহরে শূন্যের ঘরে চলে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এভাবে সন্তান নিতে তরুণ দম্পতিদের উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি সন্তান প্রতিপালনে ব্যয়, স্কুলের খরচ, বিনা খরচে ছুটি কাটাতে ঘুরে বেড়ানো ও আবাসনে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
তরুণ দম্পতিদের সন্তান নিতে উৎসাহ দিতে জাপানের ‍স্থানীয় সরকারগুলো নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে নাগি শহর যেন কিছুটা বেশি এগিয়ে। ওকাইয়ামা বিভাগের কাতসুতা জেলার একটি শহর নাগি।
শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) সিএনএন অনলাইনের খবরে জানানো হয়, নাগিতে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য দম্পতিদের অর্থ দেওয়া হয়। যত বেশি সন্তান, তত বেশি অর্থ। প্রথম সন্তানের জন্য ১ লাখ ইয়েন বা ৮৭৯ মার্কিন ডলার (প্রায় ৭৩ হাজার ৩৫৮ টাকা), দ্বিতীয় সন্তানের জন্য ১ হাজার ৩৩৫ ডলার (প্রায় ১ লাখ সাড়ে ১১ হাজার টাকা) এবং ধাপে ধাপে পঞ্চম সন্তান পর্যন্ত ৩ হাজার ৫১৮ ডলার ( প্রায় ২ লাখ সাড়ে ৯৩ হাজার টাকা)। ২০০৪ সাল থেকে নাগি এ অর্থ দিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে কাতসুনোরি ও কায়োরি ওসাকা নামে এক দম্পতির ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, ওই দম্পতি জাপানের উত্তরাঞ্চলে ২০ লাখ অধিবাসীর শহর নাগোয়ায় একটি ছোট ফ্ল্যাটে এক সন্তান নিয়ে বাস করতেন। আরও অনেক তরুণ দম্পতির মতো তাঁরাও চেয়েছিলেন সন্তান বড় শহরে বেড়ে উঠুক। কিন্তু দেখলেন, সেখানে জীবন খুবই কঠিন। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটিতে অনেক বেশি লোক থাকে। আর সেটা ব্যয়বহুলও। শিশুসেবা যত্নের সুবিধাও কম। একসময় তাঁরা ওই শহর ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন।জন্মহার বাড়াতে সফল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা নাগি শহর। জন্মহার বাড়াতে সফল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা নাগি শহর। ছবি: অফিশিয়াল সাইট কাতসুনোরি বলেন, ‘২০-৩০ বছর বয়সে বড় শহরে বাস করা সত্যিই কঠিন। আমরা জানতাম, যদি আমরা আরও সন্তান নিতে চাই, তাহলে এখানে বাস করার মতো সামর্থ্য থাকবে না আমাদের।’
সেখানে বসবাসের ১৪ বছর পর ওসাকা পরিবার নাগি শহরে চলে আসে। এই শহরে কাতসুনোরি জন্মেছিলেন। জাপানের এ শহরটি জন্মহারের দিক দিয়ে সফল। শহরটিতে প্রায় ছয় হাজার লোকের বসবাস রয়েছে। সন্তান জন্মদানে বিপুল পরিমাণে অর্থ দেওয়াসহ নানা ভর্তুকি দিয়ে শহরটি দম্পতিদের আকৃষ্ট করতে পেরেছে। ওসাকা পরিবারের প্রতিবেশীদের বেশির ভাগেরই তিনটি বা তার চেয়েও বেশি সন্তান রয়েছে। কারণ সেখানে তাঁরা সন্তান লালন–পালন করতে পারেন সহজে।
২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শহরটিতে জন্মহার দ্বিগুণ বেড়ে ১ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৮ হয়েছে। বর্তমানে সেখানে জন্মহার কিছুটা কমে ২ দশমিক ৩৯ হলেও তা দেশটির মোট জন্মহারের চেয়ে অনেক বেশি। জাপানের জাতীয় জন্মহার এখন ১ দশমিক ৪৬। ১৯৭০ সাল থেকেই জাপানে জন্মহার কমে আসছে। দেশটির স্বাস্থ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে সাড়ে ৯ লাখের মতো শিশু জন্ম নিয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যা ১২ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ১২ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু। ২০৬৫ সাল নাগাদ জাপানে লোকসংখ্যা কমে ৮ কোটি ৮০ লাখে নেমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাপানে মোট ৪৭টি প্রশাসনিক বিভাগ (প্রিফেকচার) রয়েছে। প্রতিটি বিভাগের আলাদা সরকার ও বিচার বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী জাপানে ৯০ লাখের বেশি লোক বসবাস করে। পুরো দেশের মধ্যে টোকিওতে জন্মহার সবচেয়ে কম, ১ দশমিক ১৭।
এ ব্যাপারে টোকিওর মেইজি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিরোকাজু কাতো বলেন, প্রথাগতভাবে জাপানের সরকারের নীতি এমন যে, এখানে কর্মজীবী নারী-পুরুষ পারিবারিক জীবনের সঙ্গে পেশাগত জীবনের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে হিমশিম খায়। কম জন–অধ্যুষিত এলাকার চেয়ে প্রধান প্রধান বড় শহরে জীবনযাত্রার ব্যয়ে পার্থক্য অনেক বেশি। শহরে বসবাসকারী দম্পতিদের থেকে তাদের পরিবারগুলো অনেক দূরে বসবাস করে। ফলে পরিবারের সদস্যরাও তাদের কোনো সহায়তা করতে পারেন না।স্কুলে পড়ানো, দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখাসহ সন্তান পালনে জাপানে খরচ অনেক বেশি। ছবি: রয়টার্সস্কুলে পড়ানো, দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখাসহ সন্তান পালনে জাপানে খরচ অনেক বেশি। ছবি: রয়টার্সবলা হয়, সন্তান দেখভালের জন্য যথাযথ ব্যবস্থার সংকট তো রয়েছেই, পাশাপাশি পেশাগত চাহিদাও জন্মহারে প্রভাব ফেলছে। পেশার কারণে অনেক নারী-পুরুষ দেরিতে বিয়ে করা বা বিয়ে না করার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। দেশটির জাতীয় জনসংখ্যা ও সামাজিক সুরক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে ৫০ বছর বয়সেও বিয়ে করেননি এমন সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর ৫০ বছর বয়সে বিয়ে করেননি এমন পুরুষের সংখ্যা ২৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং নারীর সংখ্যা ১৪ দশমিক ০৬ শতাংশ ছিল।
জাপানে ৯৩ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করে। সেখানে একটি বা তার চেয়ে বেশি সন্তান পালন রীতিমতো কঠিন ব্যাপার।
ঐতিহ্যগতভাবে জাপানে ছেলেরা চাকরি করবেন এবং মেয়েরা ঘরে থাকবেন এবং পরিবারের লোকজনকে দেখভাল করবেন—এমন প্রবণতা ছিল। ধীরে ধীরে সেই মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। এখন সেখানে মেয়েরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকেন না। বেশি উপার্জনের আশায় স্বামীরাও চান স্ত্রী চাকরি করুক। এখন সন্তান জন্মের পর যে নারীরা ঘরে থাকেন, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত পছন্দ, আগের মতো সমাজের চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
নাগিতে এখনো জাপানের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপনের চল রয়েছে। বড় পরিবারগুলো কখনো এক ছাদের নিচে থাকে, অথবা পাশাপাশি বাড়িতে থাকে; যাতে কর্মজীবী বাবা–মায়েরা কাজে গেলে দাদা-দাদি, নানা-নানি তাঁদের সন্তানদের দেখতে পারেন। নাগিতে বসবাসকারী নারীরা জানেন, সেখানে পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব না, তবে কাজ ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। সেখানের ৭০ শতাংশ নারী কর্মজীবী। শিশুদের জন্য সীমিতসংখ্যক দিবাযত্নকেন্দ্র শহরটিতে কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না। পরিবারিক সেবা খাতের জন্য নাগির নির্দিষ্ট পরিমাণ বাজেট রয়েছে।
ওসাকা পরিবারের এখন চার সন্তান রয়েছে। কায়োরি চাকরির চেয়ে বাড়িতে থাকাকেই বেছে নিয়েছেন। তবে নিজের মেয়েরা চাকরি না করে তাঁর মতো বাড়িতে থাকুক, তা তিনি চান না। তবে তাঁর সন্তানেরা বড় হয়ে নাগিতেই থাকুক, সেটাও তিনি চান না। তিনি চান, তাঁর সন্তানেরা ছোট্ট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বিশ্ব চিনুক, বড় বড় শহর চষে বেড়াক।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top