logo
news image

ফোর জি ইন্টারনেট গতি মন্থর করা কোন সমাধান নয়

ড. মো: ফখরুল ইসলাম।  ।  
যখন এই লেখাটি শুরু হচ্ছে তখন ইন্টারনেটে দেখলাম ভোটের আর মাত্র সময় বাকী একদিন দশঘন্টা এক মিনিট!  ইতো:মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার সময়সীমা শেষ হয়েছে। একদিকে কনকনে ঠান্ডা অন্যদিকে ভোটারদের মনে এখনও অজানা শঙ্কা। বিজিবি-সেনাবাহিনী সবাই নিরাপত্তার জন্য মাঠে নেমে গেছেন। তাই গত দু’দিন ধরে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা ফাকা। যাহোক, এরপরও আনুভূমিক ইথার ও স্যাটেলাইট নির্ভর সব ধরনের যোগাযোগমাধ্যমে থেমে নেই নির্বাচনের বিশেষ প্রচারণা!  
নির্বাচনকে ঘিরে ঘরে-বাইরে সন্দেহ যেন পিছু ছাড়ছেই না। কোন প্রার্থীর পক্ষে পোস্টার-ব্যানার ছয়লাব হয়ে গেছে। কারো একটি পোস্টারও চোখে পড়ছে না। তার অভিযোগ- পোস্টার লাগানো হয়েছিল, দুবৃত্তরা বার বার ছিঁড়ে ফেলেছে। তাই আর কোন পোস্টার লাগাবো না। এলাকার জনগন একথা জানেন। আমাকে এমনিতেই ভোট দিবেন। এজন্য নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে শুধু নয়- ভোটারদের মধ্যেও উৎকন্ঠা বেড়েই চলেছে।
যদিও আইন শৃংখলা বাহিনী বলছেন (প্রথম আলো ২৮.১২.২০১৮) ‘পুলিশের আচরণ পক্ষপাতমূলক নয়....নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে যাতে ভোটাররা ভোট দিতে পারে সে চেষ্টা তাদের থাকবে।’  অনেকে বলছেন, আমরা অনেক দেরীতে এই কথাগুলো শুনলেও পুলিশকে সাধুবাদ জানাচ্ছি এবং ৩০ তারিখে সেই চেষ্টার প্রতিফলন ও বাস্তবতা দেখতে চাই।
নির্বাচনী সহিংসতায় আত্মরক্ষার্থে মাঠে প্রধান বিরোধীপক্ষগুলো ক’দিন থেকেই নেই। প্রচার কাজে অংশ নেয়া  অনেকেই বাড়িতেই নেই। এমনকি গ্রামাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়া কেউ কেউ বাড়ি পালিয়ে ধানক্ষেতে ঘুমাচ্ছেন (আমাদের সময় ২৮.১২.২০১৮) বলে জানা গেছে! কিছু মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রশাসনিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা ভাবছে দল ও দলের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হবার কথা। কিন্তু সেটা না হয়ে বিরোধী দলগুলোর সংগে প্রতিযোগিতা করছে রাষ্ট্রযন্ত্র! একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থিত প্রশাসন শুধু একটি দলের পক্ষ নিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করছে, অন্যদেরকে নির্দয়ভাবে নির্যাতন করে মাঠ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে!  বিপুল সংখ্যক সাধারণ ও এক কোটি তেইশ লক্ষ নতুন ভোটারদের (প্রাগুক্ত ২৮.১২.২০১৮) চির-সবুজ সৎ আবেগকে কোন মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। ভোটার জীবনের শুরুতে ভোট-মাঠের এরকম পক্ষপাতমূলক অবস্থাদৃষ্টে নতুন ভোটাররা কি সিদ্ধান্ত নেবে তা বলাই বাহুল্য। তাহলে আমরা নবীন ভোটারদের সৎ আবেগকে কি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চলেছি?  
এছাড়া সংবাদ মাধ্যমে জনো গেল সহিংসতার প্রতিরোধ ব্যবস্থা না করে হঠাৎ ‘হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখতে বলা হচ্ছে’! এত জনমনে আরো আতঙ্ক তৈরী হয়েছে। হাসপাতাল পরের বিষয়। কাল্পনিক কোন সমস্যা মোকবিলার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা না রেখে আগেই প্রতিকার করতে কেন চাওয়া হচ্ছে- সেখানেও জনমনে সন্দেহ হচ্ছে বৈ কি?
মোদ্দাকথা,  মানুষ চায় ভোটের কাজ দায়িত্বশীলগণ নিরপেক্ষতার সাথে পালন করে একটি নতুন ইতিহাস গড়ুক। কেউ কোনপ্রকারে গোটা ভোট প্রক্রিয়ার কোন স্তরে নির্লজ্জভাবে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করুক সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ আজ সতর্ক ও উৎকন্ঠিত। এজন্য ফোরজি ইন্টারনেট সেবা কিংবা বায়বীয় গতি বন্ধ করে দেয়া বা নেটের গতি মন্থর করে দেয়ার মত কাজগুলো করা খুবই অর্বাচীন মনে হবে। একাজগুলা মানুষের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার চেয়ে বেশী রুঢ় মনে হয় এবং নির্বাচনে বিশ্বমিডিয়া বা বিশ্ববাসীর চোখ বন্ধ করে দেয়ার মত পদক্ষেপ বলে মনে হবে। আমার কথা হলো, এমুহুূর্তে ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়ার অর্থ হলো- মানুষকে অহেতুক ক্ষেপিয়ে তোলা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্বাসরোধ করে হরদম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত বিপুল সংখ্যক নতুন ভোটারদের মনে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি করা!
বর্তমানে দেশের হাজার হাজার বেকার যুবক দেশ বিদেশ থেকে অনলাইনে ডাটা এন্ট্রিসহ বিভিন্ন অর্ডার নিয়ে পার্টটাইম কাজ করছেন। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাশে যোগ দিচ্ছে এবং লাইব্রেরী ঘেঁটে পড়াশুনা করছে। সাইবার শপগুলোতে মানুষ ই-মেইল পাঠানো, চাকুরীর আবেদন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ফলফল দেখা, ইউটিবটিউবে বিভিন্ন ধরনের সেবা বিকি-কিনি করছেন। ব্যাংকের এটিম বুথের মাধ্যমে লেন-দেন করা ও অনলইন শপিং এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সেক্ষেত্রে এক মিনিট বিদ্যুৎ না থাকা বা ইন্টারনেট সেবা মন্থর হওয়া বা বিঘ্নিত হওয়া মানে কোটি কোটি টাকা ক্ষতির ব্যাপার। দেশের আ্য় বাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার এখন দ্রুতগতির ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবার সচলতা। সংবাদ মাধ্যমে জানা গেল (প্রথমআলো ২৮.১২.২০১৮) পল্টনের জামান টাওয়ারে আগুন। যেখানে ঐক্য ফ্রন্টের অস্থায়ী অফিস অবস্থিত। এসময় এই ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিতে দ্রুত ভূমকিা রাখতে পারে। যে কোন দুর্ঘটনা প্রতিকার ও প্রতিরোধে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবার সচলতা থাকা জরুরী। তাই হঠাৎ স্থিত কোন জনসেবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে আমাদেরকে এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।  
সংবাদ মাধ্যমে জানা গেল ফোরজি ইন্টারনেট বা দ্রুতগতির ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলাফল প্রকাশের সময় গতি বাড়ানো হবে। এটা জনমনে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। মানুষ ঘরে বসে তথ্য পেতে চায়। হাতের তালুতে প্রয়োজনীয় তথ্য পেলে বাইরে বের হয়ে হৈচৈ করবে কেন? বরং তথ্য পেতে দেরী বা ব্যর্থ হলেই নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ বেড়ে যাবে।
গতকাল নয় ঘন্টা ফোরজি বা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ বা মন্থর ছিল। পিএইচডি ছাত্ররা সহ আমাদের অনেক কাজ বিঘিœত হয়েছে। ভোটের দিন মানুষ হয়তো ভোট প্রদানের জন্য দু’এক ঘন্টা সময় ব্যয় করবে। বাকী সময়টাতো নিজ নিজ কাজে কাটাবে অথবা ফলাফল জানার জন্যদ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করবে।  ভোটের দিন সকালে ইন্টারনেটের গতি কমানো ও ফলাফল প্রকাশের সময় গতি বাড়ানো নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করবে মাত্র। সকালে-বিকেলে গতি কমানো বাড়ানো এসব স্ববিরোধী কথা নির্বাচন কমিশনকে বলে মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার দরকারই বা কী?  আমার কথা হলো, কোন ধরনের সাইবার অপরাধ আঁচ করে থাকলে সাইবার ইন্টলিজেন্সকে সতর্ক রাখুন- নেট বন্ধ করতে হবে কেন? আইন শৃংখলা বাহিনীর নিজেদের সেবার অপ্রতুলতা থাকলে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সাইবার ইন্টলিজেন্সকে সতর্ক রাখুন! সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে একটি কার্যকর সাইবার প্রতিরোধ দেয়াল (ফায়ারওয়াল) গড়ে তুলুন।
রাষ্ট্র তৈরী হয়েছে জনকল্যানের জন্য। রাষ্ট্র কেন জনগণকে সন্দেহ করবে? এবং জনগণ কেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে অহেতুক ভয় করবে? তাহলে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হতে চাই কেন? রাষ্ট্রের সেবাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা পাবার ‘হক’ বা অংশীদারীত্বের সমসুযোগ সব নাগরিকেরই রয়েছে। তাই ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল স্তরের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সেবাদানকারী জনবলকে দেশের সকল জনগণের কথা মাথায় রেখে বিশেষ ভুমিকা পালন করতে হবে। তাদেরকে উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের সকল জনগণের জন্য জনসেবায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে নির্ভয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচনের প্রাক্কালে ফোরজি ইন্টারনেট বন্ধ করা, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা, ইত্যাদি বলে মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ তৈরী করে চারদিকে আতঙ্ক ছড়ানোর প্রয়োজন আছে কী?
আসন্ন ৩০ তারিখে সংশ্লিষ্ট সবার ঐকান্তিক সহযোগিতায় সব ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয়-ভীতি ঝেড়ে ফেলে নিশঙ্ক চিত্তে ভোটারগন ভোট দিয়ে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করে দেশকে উন্নত গণতন্ত্রের পথে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাক-এ আশায়।

* ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।  E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top