logo
news image

ওয়ান্টি ওয়ান-অংক খবর ও শিশুর জ্ঞান বিকাশে পক্ষপাতহীন শিক্ষা-অবকাঠামো

ড. মো: ফখরুল ইসলাম।  ।  
গত দু’দিন ধরে ফেসবুক খুললেই শুধুু চোখ পড়ছিল প্রাথমিকে কৃতি শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা ছবি। বাবা-মা আপনজনদের আঁকুতি- দোয়া করবেন আমার সোনামণিটার জন্য। হ্যাঁ, ওদের জন্য প্রাণখুলে দোয়া তো করবই, ওরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ। পাশাপাশি শঙ্কা জাগে, ওরা এত এত নম্বর পাচ্ছে, এত ভালো ফলাফল করছে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে তারা তাদের পাঠ্য বইয়ের সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? বিষয়টি দিন দিন জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে।
বাচ্চারা স্কুলে কিছু শিখুক বা না শিখুক অভিাবকগণ একটি গোল্ডেন জিপিএ চান। এজন্য বাচ্চাদের ওপর চলে নানমুখী চাপ, গৃহশিক্ষকের শাসন ও ট্রাফিকজ্যামের মধ্যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কোচিংবাড়ি যাওয়া-আসার নির্যাতন। একজন মন্ত্রী কিছুদিন আগে শিশুদের জিপিএ ফাইভ বিষয়টিকে ‘নির্যাতনের’ সংগে তুলনা করতে কুন্ঠিত হননি! শহুরে অনেক অভিভাবক একটি গোল্ডেন জিপিএ বিষয়টিকে দেখিয়ে সন্তানকে ভাল দামী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন অথবা বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন। পত্রিকায় প্রকাশ- কোন কোন বিত্তশালী অভিভাবক সেসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাসুযোগ নেয়ার পাশাপাশি তাদের সন্তানদের চাকুরী কিনে দেয়ারও ক্ষমতা রাখেন! এছাড়া- নকল, ভেজাল, অনৈতিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলাকে আজকাল আনস্মার্ট-বোকা বলে মনে করা হয়! কারণ, আজকাল শতাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলোতে মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে গেছে। সেগুলোর সিংহভাগই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যবসায়িক এবং ধার করা পার্টটাইম পঠন-পাঠন ব্যবস্থাপনার থাকায় তাদেরকে বাজারে টিকে থাকার ভাবনায় পেয়ে  বসেছে। অনেকে মন খারাপ করতে পারেন, কিন্তু একমত হবেন যে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করা হলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই আজ সনদ বিকি-কিনির বাজার। এসব ঘটতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা জাতি হিসেবে মেধাহীন হয়ে আস্তাকুঁড়ে আস্তানা বেছে নেব আর কি!
যাহোক, কিছুদিন আগে সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়েকে সংখ্যা গণনা পড়ানোর সময় সে বলেছিল, আব্বু ইংরেজীতে ২১ যদি টুয়েণ্টি ওয়ান হয় এবং ধারাবাহিকভাবে ৩১, ৪১, ..., ..., ৯১ পর্যন্ত যদি একটা ধারা বজায় থাকে তাহলে  ইলেভেন (১১) কেন ওয়াণ্টি ওয়ান হয় না? বাংলায় এক দশ এক এগার হয়, তাহলে একদশ দুই বেগারো হয় না কেন? আবার ২১, ৩১, ৪১ কেই ধারায় উচ্চারিত হলেও ১১ কে ইলেভেন বলা হয় কেন?  বিষয়টি আপাতঃ দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমি উত্তর দিলাম- পড়ার নিয়মটা এভাবেই চলে আসছে। এত বেশী ব্যাখ্যা চেও না, ভালভাবে পড়াশোনা কর, পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হতে হবে। সে বলল ফার্ষ্ট হলে আমাকে কী উপহার দিবে? আর যদি সাড়ে ফার্ষ্ট হই তাহলে কি তার চেয়ে বেশী কিছু দিবে?
আমি তো শুনে হতবাক। এতটুকু মেয়ে, কেবল বাংলা বলা শিখেছে, তার কথার ধরন এবং গভীরতা দেখলে ভিমড়ি খাবার মত অবস্থা আর কি! কিন্তু একটি বিষয় সত্যি যে, বাংলাদেশে ওয়াণ্টি ওয়ানের ধারাবাহিকতা না থাকার মত শিশুদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই একটা বহুমাত্রিক ব্যবস্থার ধারা বিদ্যমান। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণতঃ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু হয়ে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বহুমাত্রিকতা রয়েছে কিন্তু পৃথিবীর কোথাও শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই বাংলাদেশের শিক্ষা ধারার মত বৈচিত্র্য, বৈষম্য, বিভেদ, সমন্বয়হীনতা ও অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে না। বিশেষতঃ শহুরে শিশুদের মধ্যে এই বিভেদ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আজকের লেখাটিতে শিশু মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা, শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই প্রতিষ্ঠানগত নানা বিভেদ ও পার্থক্য নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।
আজকাল সব বাবা-মা'কে বলতে শুনি, আজকালকার বাচ্চারা খুবই পাকা পাকা কথা বলে। বাচ্চাদের মস্তিষ্ক বিশেষ করে যাদের পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে তাদের মগজ খুবই শাণিত। আর কেনই বা হবে না? আজকাল বাচ্চারা জন্মের পর হতেই পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে যা কিছু দেখছে, ব্যবহার করছে এবং শুনতে অভ্যস্ত হচ্ছে সেগুলো তাদের মগজকে নিয়তই শাণিত করছে। বাচ্চাদের অবসর বলতে কিছু নেই। শুধু ঘুমের সময়টা বাদে তারা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। টিভিতে কার্টুন অথবা ছবি অথবা অন্য কোন অনুষ্ঠান, কম্পিউটারে গেম, ছবি আঁকা, স্কুলের পড়া তৈরী, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলা করা আর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যে কোন বাচ্চা সারাটা দিন ব্যস্ত সময় কাটায়। এমনকি স্কুল ছুটির পর দুপুরে খাবার খাইয়ে দিয়ে ঘুম-পাড়ানো খুবই অসম্ভব ব্যাপার। বাচ্চারা যেন দিনে ঘুমুতেই চায় না। কেউ কেউ সারাদিন ভিডিও গেম খেলে। কেউ কার্টুুন দেখে এমনকি রাতে বড়দের সাথে নাটকসহ সকল টিভি অনুষ্ঠান দেখতে পছন্দ করে। খুব অল্পবয়সী বাচ্চাদের মধ্যে নাটকের পাত্র-পাত্রীদের নাম, ডায়লগ মুখস্থ রাখতে দেখা যায়। টিভি অনুষ্ঠান দেখতে অভ্যস্ত এক বাচ্চা তার মাকে বলেছিল, মা টিভিতে শুধু বাংলা ও ইংরেজী খবর হয় কিন্তু অংক খবর কেন হয় না ?
এক গবেষণায় দেখা যায়, একজন বয়স্ক মানুষ তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার ১৫ ভাগও ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয় না। এর চেয়ে বেশী ব্যবহারকারীরা নাকি নিউটন হয়ে যাবেন! তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। একটি সুস্থ সবল বাচ্চা যেভাবেই হোক তার জানা ক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করতে তৎপর থাকে। যদি তা না করে তাহলে বুঝতে হবে সে বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। কিছু কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, অনেক সুস্থ বাচ্চা স্বভাবতইঃ চুপচাপ ও লাজুক ধরণের। তবে আজকাল এদের সংখ্যা খুবই কম।
শৈশবকালে বাচ্চাদের কৌতুহল প্রবণতা খুব বেশী থাকে। কৌতুহল থেকে নতুনকে জানা ও বোঝার পথ উন্মোচিত হয়। তাই বাচ্চাদের স্বভাবজাত কৌতুহলকে খুবই সতর্কতার সাথে সহজ, সরল, সঠিক এবং প্রাঞ্জল ভাষায় নিবৃত্ত করতে হবে। কোন ধরনের ছল-চাতুরী, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে তাদের স্বভাবজাত কৌতুহলের মধ্যে ছেদ পড়বে এবং যদি তারা কোন কৌতুহলের প্রেক্ষিতে জবাবটা বাবা-মায়ের কাছে একরকম, শিক্ষকদের কাছে একরকম এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আরেকরকম ভাবে জানতে পারে তাহলে তাদের কৌতুহলের সঠিক জবাব কোনটি এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকবে সঠিক উত্তর খুঁজতে একসময় হতাশ হয়ে পড়বে এবং অপরকে ঘৃণা করা শুরু করবে। অধিকন্তু তার ভিতরেও মিথ্যা, ছলনা, ক্ষোভ ইত্যাদির সৃষ্টি হবে এবং স্বাভাবিক সৃজনশীলতা (creativity) হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখতে হবে যে, শিশু মস্তিষ্ক একটি প্রায় ফাঁকা বায়োলজিক্যাল ডিভাইস, এটা একটি আশ্চর্য্যজনক বায়ো-হার্ড ডিস্ক। এই হার্ড ডিস্কে সহজেই নতুন কিছু রেকর্ড হয়ে যেতে পারে। তাই ভাইরাস সদৃশ্য মিথ্যা, চাতুরী, অসততা ইত্যাদি শিশুকালেই যাতে তাদের মাথায় ঢুকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তাই শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতাবোধকে জাগ্রতকরণ ও তার লালনের জন্য কৌতুহলকে ইতিবাচকভাবে অথবা নেতিবাচকভাবে যা সত্য তাই তুল ধরতে হবে। তবে জিপিএ ফাইভ পেতে গিয়ে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য যদি বাজারের গাইড বা নোটবই কিনে মুখস্থ করা হয় সেটা আতœঘাতী হবে। আজকাল এটাই ঘটে চলেছে। সেজন্য স্কুল-কলেজের সনদে ডাবল জিপিএ ফাইভ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়  অকৃতকার্য হতে দেখা যাচ্ছে।
যা বলছিলাম, আজকাল শিশুদের মধ্যে অধিক কৌতুহল প্রবণতা ও অধিক জিজ্ঞাসু মনোভাব লক্ষণীয়। শিশুদের এই জিজ্ঞাসু মনোভাবকে সযত্নে লালন করতে হবে। তাদের মননশীলতার এদিকটিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন ব্যবহার প্রদর্শন করতে হবে।
আরেকটি বিষয়, আজকাল আমাদের দেশে শিশুতে শিশুতে পার্থক্য ও বৈষম্য খুবই পীড়াদায়ক। ঘনিষ্ট বন্ধু দুই শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুলের পার্থক্য, পোষাকের পার্থক্য, খাদ্যের পার্থক্য। এই পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে সার্বজনীন করতে হবে। বিশেষতঃ শহরাঞ্চলের শিশুরা কেউ কিন্ডারগার্টেনে যায়, কেউ ইংরেজী মাধ্যম শিখে, কেউ কমদামী স্কুলে যায়। এক্ষেত্রে অতি শৌশবকাল থেকেই আমরা জাতিকে বিভক্ত করে তুলছি। কিছু  শিশু ইংরেজী শিখে স্মার্ট হচ্ছে কিছু শিশু সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তাদের সমমানে যেতে পারছে না। উন্নত বিশ্বে এই বৈষম্য নেই বললেই চলে। যেমন, জাপানে ধনী-গরীব, উচ্চ-নীচু সবার বাচ্চারাই একই স্কুলে যায়, কমপক্ষে শুরু থেকে ৮ গ্রেড পর্যন্ত সব পিতামাতাই তাদের সন্তানদের একই ধরনের পরিবেশে লালন-পালন করাতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী স্কুলের খরচ নির্ধারণ করে দেয়া থাকে। মূলতঃ সরকারী তত্ত্বাবধানে সেসকল স্কুল পরিচালনা করা হয়। শিশুদের খাবার, পোষাক, চিকিৎসা এবং অবস্থানকালীণ সময়ের নিয়ম-কানুন চাকুরীজীবি বাবা-মাকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে একটি নিশ্চিন্ত সেবাদান করার সুযোগ এনে দেয়। কর্মজীবি বাবা-মায়েরা সকাল থেকে রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যšত সেসকল ‘ডে-কেয়ার কাম-স্কুলে’ বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে নিজেদের পেশাগত কাজ চালিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে (২০১০ এর শিক্ষানীতিতে উল্লেখ আছে) এখন সময় এসেছে বৈষম্যহীনভাবে ১ম-৮ম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য সার্বজনীন শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা দেয়ার। গ্রামাঞ্চলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্ষেত্রে বৈষম্য আপাতঃ দৃষ্টিতে নেই। কারণ গ্রামে সরকারী ও কিছু রেজিষ্টার্ড বিদ্যালয় এবং মক্তব, মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া ছাড়া শিশুদের শিক্ষার অন্য কোন গত্যন্তর নেই। কিন্তু থানা, জেলাশহর এবং রাজধানীতে শিশু শিক্ষার বৈষম্য আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্বলতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শহরাঞ্চলে বাহারী নামের কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট, ক্যাডেট মাদ্রাসা, চাইল্ড কেয়ারহোম গুলোতে বিদেশী ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা, অভিনব পাঠ্যসূচি, বোঝা বোঝা বই-পুস্তক এবং বাচ্চাদের মাসিক খরচের পর্বত প্রমাণ হিসাব প্রভৃতি শৈশবকাল থেকেই বাচ্চাদের মধ্যে বিভেদ এবং পড়াশুনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং অনেকক্ষেত্রে বাচ্চাদের প্রাকৃতিক ও সুপ্ত সৃজনশীলতাকে বিলীন করে দিচ্ছে। কোমলমতি বাচ্চারা তাদের দেহের ওজনের চেয়ে বেশী ওজনের বই খাতা পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে বহন করে । এর সাথে দৈহিক ও মানসিক উভয় যন্ত্রনা বিজড়িত হয়ে যায় । এ ছাড়া বিশাল সিলেবাসের ঝক্কি সামলাতে বাড়ীতে উচ্চ বেতনে হাউস টিউটর এবং কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীলতার প্রবণতা জড়িত এবং শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকগণ ক্লাশরুমে পড়ানো ফাঁকি দিয়ে উচ্চতর মাসিক বেতনে বাসা-বাড়িতে গিয়ে পড়ানো, নিজ বাসভবনে স্কুল খুলে ব্যবসা চালিয়ে সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলছেন।
পাশাপাশি সীমিত আয়ের অভিভাবকদের মধ্যে হীন প্রতিযোগিতা, হতাশা এবং শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক এই বিষয়টিতে সামঞ্জস্য (adjustment) বিধান করতে না পারায় ঘুষ- দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। খোদ রাজধানীতে বাচ্চাদের কোন কোন স্কুলে ভর্ত্তি ফি’র পরিমাণ এত বেশী, যা দিয়ে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাবলিক স্কুল- থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি ছেলে বা মেয়ের ১ম শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পাশ করা পর্যন্ত সমূদয় খরচ মেটানো সম্ভব (যেখানে পাবলিক স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক বেতন মাত্র ২০ বা ৩০ টাকা, সেখানে রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে ২য় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হতে খরচ হয় ডোনেশনসহ ৮০ হাজার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা)।
ক’দিন পরেই নতুন বছর শুরু হবে। তাই গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় না হোক, কমপক্ষে শিশুজীবনের জন্য একটি ইতিবাচক পর্যায় গড়ে তুলতে হলে শহরে প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি, গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষকরা যাতে শিক্ষকতা করতে আকৃষ্ট হয় সেজন্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে এই পদক্ষেপ প্রভূত বিপ্লব বয়ে আনতে পারে। তাহলে শিশুতে-শিশুতে বৈষম্য ও বঞ্চনা কম হবে এবং শিশুদের সৃজনশীলতাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। একটি ইতিবাচক সৃজনশীলতার জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন- দরকার সুষ্ঠু সামাজিক ও শান্তিপূর্ণ গৃহ-পরিবেশ। একটি ইতিবাচক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও শাসন দিতে পরে এই শান্তিপূর্ণ সামাজিক পরিবেশের নিশ্চয়তা। এজন্য আসন্ন ভোটে সাধারণ জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। কারণ পক্ষপাতিত্বমূলক ও জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন হলে স্বভাবতই: বঞ্চিতরা জনরোষ ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। এ থেকে শুরু হবে সামাজিক বিরক্তি, হতাশা, ভায়োলেন্স ও ভাঙ্গন। একটি বিরক্তিপূর্ণ ও ভঙ্গুর সমাজে শান্তি থাকে না। তাই সেখানে কোন উন্নয়ন টেকসই করানো সম্ভব হয় না। আর এই ধরনের সমাজে সবচে’ ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশুরা।
তাই একটি টেকসই সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সংস্কার ঘটানো জরুরী। এই সংস্কার সূচিত হলে কেউ আর মাকালফল সদৃশ ‘গোল্ডেন জিপিএ’-র মত আজব তথা বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আগ্রহী হবে না। বরং একজন শিশুর ‘ওয়াণ্টি ওয়ান’  বা ‘অংক খবর’ সৃষ্টির ইচ্ছার মত লক্ষ লক্ষ শিশুর  বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুহলগুলোকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাবে এবং শুধুমাত্র একজন শিশু ‘সাড়ে ফার্ষ্ট’ হয়ে সুযোগ লাভ করবে- তা না হয়ে সমাজের সকল শিশু ‘সাড়ে ফার্ষ্ট’ স্থান লাভ করার যথার্থ জ্ঞান লাভ, মনো:দৈহিক ও নৈতিক শক্তি অর্জন করে ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারবে।

* ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।  E-mail: fakrul@ru.ac.bd

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top