logo
news image

পার্বত্য চুক্তির ২১ বছর: আশা-নিরাশা-হতাশার পাহাড়ের শান্তি

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি।  ।  
রোববার (২ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২১তম বার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে সরকার এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মাধম্যে তিন পাবর্ত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটে। সেসময়ের সরকারের পক্ষে জাতীয় সংসদের তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ্ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। শান্তি চুক্তির ২১ বছর বছরে প্রশ্নটা আরো বড় হয়ে উঠছে আসলেই কি পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সন্তু লারমার পক্ষ থেকে যেমনি রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তেমনিভাবে অত্রাঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকেও রয়েছে নানান অভিযোগ। অভিযোগের ট্রেনে বগি লাগানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকেও।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শান্তি চুক্তির পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সামাজিক অপরাধের বাইরে তিন পার্বত্য জেলায় খুন হয়েছে ২ হাজার ২৭৫ জন মানুষ। অপহৃত হয়েছে আরো ২ হাজার ৪৫০ জন। নিহতদের পাহাড়ি-বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ে থাকলেও বাঙ্গালীদের সংখ্যা বেশি। বাঙালিরা খুন হয়েছেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে এবং অধিকাংশই পাহাড়িদের হাতে। নিহত পাহাড়িরা মারা গেছে তাদেরই সশস্ত্র তৎপরতা ও আধিপত্যের লড়াইয়ের নিজস্ব অন্তঃকোন্দলের কারণে। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, শান্তিচুক্তি হলেও তিন পার্বত্য জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। চুক্তি মোতাবেক ৪৫ দিনের মধ্যে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের তালিকা প্রদান করা হয়েছিল এবং ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮ থেকে ৫ মার্চ ১৯৯৮ পর্যন্ত ৪ দফায় ১৯৪৭ জন সশস্ত্র শান্তি বাহিনীর সদস্য শেখ হাসিনা সরকারের নিকট আত্ম সমর্পণ করেন। ৮৭৫টি অস্ত্রসহ ২ লাখের অধিক গলা বারুদ তারা জমা দিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ সর্বশেষ দলের আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনীর পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটে এমনটাই কাগজে-কলমে উল্লেখের মাধ্যমে সকলেই জেনে আসলেও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত বলেও মন্তব্য স্থানীয়দের।
তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বাঙালি। বাকি ৫২ শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উপজাতি অধিবাসী। পাহাড়ি বাঙালি সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিচুক্তি করা সত্তেও এখনো জনসংহতির নেতারা তিন পার্বত্য জেলা থেকে বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সময়। খোদ সন্তু লারমাও এমন দাবি জানান সময়ে সময়ে। পার্বত্য এলাকার জমির বিরোধ নিরসনে শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ২০০১ সালে সরকার ভুমি জরিপ কমিশন গঠন করে। কিন্তু পার্বত্য গোষ্ঠীগুলো বাধার মুখে ভূমি জরিপ কমিশন কাজ করতে পারছে না। উপজাতীয় নেতাদের আপত্তির পরিপেক্ষিতে সরকার গত বছর ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করেছে কিন্তু তবুও এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না।
পার্বত্যাঞ্চলের বাঙ্গালী সংগঠনগুলো মনে করছে পার্বত্য চুক্তির এতোবছরেও এই অঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালীদের কোনো প্রকার ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি। পার্বত্য সম-অধিকার আন্দোলনের নেতা জাহাঙ্গীর কামাল ও পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আমনা চুক্তির বিনিময়ে শান্তিতো দূরের কথা বর্তমানে পাহাড়ে অসহ্য যন্ত্রনাময় পরিস্থিতিতে বাস করছি। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের কথাবলে পার্বত্য চুক্তি করা হলেও চুক্তির পরবতীতে শুধুমাত্র সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। এছাড়াও পার্বত্য চুক্তির আগে পাহাড়ে ছিলো শান্তি বাহিনী নামক অশান্তি সৃষ্ঠিকারি একটি মাত্র সশস্ত্র সংগঠন। জনাব জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, পাহাড়বাসীর ভাগ্যোন্নয়নের চুক্তি পরবর্তীতে বর্তমানে পাহাড়ে ৪টি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি হয়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে সশস্ত্র তৎরপরতা, বেড়েছে ভাতৃঘাতি সংঘাত। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ি এলাকার দুর্গম অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করার পর থেকে পাহাড়িদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আরো বেড়ে গেছে। আগে যেখানে পাহাড়িদের কাছে জনপ্রতি অস্ত্র ছিল না বর্তমানে সেখানে প্রত্যেক পাহাড়ির হাতে হাতে অস্ত্র থাকার পরেও তাদের কাছে এখন তাদের কাছে উদ্বৃত্ত অস্ত্র রয়েছে।
অপরদিকে, রাঙামাটির স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেছেন, চুক্তি করার পর থেকে কিছুই যে বাস্তবায়ন হয়নি তা নয়। কিন্তু এখানে স্থানীয় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাহাড়ে আলাদ শাসন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক রূপ আমরা দেখতে পাইনি। ঊষাতন বলেন, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো যেমন, সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বন ও পরিবেশ এবং ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়নের বাইরে রাখা হয়েছে। এই মৌলিক বিষয়গুলো অতিশীঘ্রই পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর হাতে হস্তান্তরিত করে জেলা-পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন করে পাহাড়ে স্থানীয় শাসন বা জনগণের শাসন প্রবর্তন করা উচিত মন্তব্য করে জনাব উষাতন তালুকদার বলেন, আমরা আশা করবো আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়া সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো সংযোজন করে কবে/কখন কিভাবে এগুলো বাস্তবায়ন করবে সেবিষয়ে সুনির্দিষ্ঠ্য রোডম্যাপ ঘোষণা করে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
অপরদিকে পাহাড়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেছেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সিংহভাগ আওয়ামীলীগ সরকার বাস্তবায়ন করেছে। চুক্তি শর্তানুসারেই আমরা পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন করেছি। এই ভূমি কমিশন বাস্তবায়নে কাজ চলছে। আগামীতে আবারো ক্ষমতায় আসলে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে চিনু বলেন, আমি মনে করি জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিলো পাহাড়ের মানুষের জন্য তার চেয়ে দরদী আর কেউ নাই।   
চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেছেন, সংঘাতের অবসান আর জেএসএস এর সদস্যরা সাধারণ জীবনে ফিরে আসা এই দুটো অংশসহ আর কিছু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হওয়া ছাড়া চুক্তির মধ্যে থাকা মৌলিক জিনিসগুলো দৃশ্যমান নেই বলে এখানকার জনগণের ধারনা। আমরা আশা করবো যে, আগামীতে যে সরকারই আসুক, তার বলিষ্ট নেতৃত্বে চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করবে। এই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীরও সহযোগিতা দরকার এবং এই সহযোগিতা পাওয়ার আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন চাকমা রাজা।
এদিকে পাহাড়ের সাধারণ জনগণের অভিমত, পাহাড়ে সেনাবাহিনী না থাকলে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের কচুকাটা করে তাড়িয়ে দেবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, পার্বত্য জেলাগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হলে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হবে। তাদের মতে এমনিতেই পাহাড়ে বর্তমানে সুষ্ঠু পরিস্থিতি নেই। এখনো চাষাবাদ, পণ্য পরিবহনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা দিতে হয়। কাঙ্খিত চাঁদা না পেলে তারা খুন, অপহরণসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। সুতরাং সঙ্গত কারণে স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থেই সেখানে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাহিনীর এক উদ্বর্তন কর্মকর্তার মতে চুক্তি শর্ত অনুযায়ী পার্বত্য জেলার দূর্গম অঞ্চল থেকে বেশকিছু সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের স্বার্থেই সব ক্যাম্প প্রত্যাহার করা মোটেও উচিত হবে না। বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার জন্যই সেখানে সেনাক্যাম্প রাখা প্রয়োজন। সব সেনা সরিয়ে নিলে পার্বত্য জেলায় নিরাপত্তাশূন্যতা তৈরি হবে। সরকারী বিভিন্ন মহলের মতে, শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন করেছে বাকিগুলোও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন। সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র একটিই শর্ত ছিল সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র সমর্পন করবে। কিন্তু পাহাড়ি নেতাদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে শান্তি চুক্তির ২১ বছরেও সেটা সম্ভব হয়নি।

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top