logo
news image

আজ মওলানা ভাসানীর ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী

আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার। তেভাগা ও ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ আন্দোলন, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি এবং বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি মজলুম জননেতা হিসেবে আখ্যা পান।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা এবং টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আলাউদ্দিন আজ সকালে টাঙ্গাইলে ভাসানীর সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচির সূচনা করবেন। দিনের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কোরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, গণভোজ, আলোচনা সভা ও ভাসানী মেলা। এছাড়া মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সাংগঠনিক রাজনীতিতে মওলানা ভাসানী কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্ম মওলানা ভাসানীর। তিনি জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। সন্তোষের মাটিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তত্কালীন বাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। গত শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে আসামে বঙ্গাল খেদা অভিযানের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা স্মরণীয়। তার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সর্বদলীয় ওয়ার কাউন্সিলের উপদেষ্টা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তার সর্বশেষ কীর্তি ছিল ফারাক্কা লং মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

জন্ম ও সংক্ষিপ্ত জীবণী

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। মক্তব হতে শিক্ষাগ্রহণ করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম যান। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬-এ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তাঁর নাম রাখা হয় ‘ভাসানীর মওলানা’। এরপর থেকে তাঁর নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। ক্ষণজন্মা এ ব্যক্তি জীবনে অনেকবার শাসকগোষ্ঠীর রোষাণলে পড়ে কারান্তরীণ হয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে ‘মজলুম জননেতা’ বলা হয়। চৈনিক কম্যুনিজমের প্রতি তাঁর বিশেষ বিশ্বাসের জন্য তাঁকে ‘রেড মওলানা’ও বলা হতো। তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী হলো: কাগমারী সম্মেলন, লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন, আসাম চাষী মজুর সমিতি গঠন, মুসলিম লীগ ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন, ন্যাপ গঠন, ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দান, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সভায় সভাপতিত্ব, ফারাক্কা লং মার্চসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে তিনি নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে ৫ এপ্রিল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে ২৮ মে তাকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ১৭ নবেম্বর পরলোক গমন করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষের ইসলামীয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি যিনি এক অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন তিনি হলেন মওলানা ভাসানী। মুক্তি যুদ্ধের স্বপক্ষে থাকার কারণে ও সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য তার মতো একজন মওলানাকে ‘কাফের’ উপাধী দিয়ে বাড়ি পুড়ে দিয়েছিল পাক বাহিনী। মুক্তি যুদ্ধের প্রারম্ভে এই মহৎ প্রাণের কি কি ভূমিকা ছিলো সে নিয়ে দু’একটি কথা বলছি: ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ডামাডোল চলছিল দেশে। সারা দেশে চলছিল সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ঢাকায় প্রায়ই বিভিন্ন মাঠে স্বাধিকার আদায়ের জন্যই সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত ইত্যাদি চলতো। এরই ধারাবাহিকতায় মওলানা ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক বজ্রকণ্ঠ ভাষণ দিলেন। যে ভাষণটিও কম্পন তুলেছিল পাক সেনা সরকার গদিতে। ৯ মার্চ ১৯৭১ মজলুম জননেতা ভাসানী পাকিস্তানের জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয় , তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। লা-কুম দ্বিনিকুম অলইয়া দ্বিন’ অর্থ্যাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার; পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না’। জনসভায় মওলানা ভাসানী তুমুল করতালির মধ্যে বলেন, ‘মুজিবের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবো’। পল্টনে সেই বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা দৃঢ় কন্ঠে আরো বলেন, ‘অচিরেই পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে’। তিনি সবাইকে মুজিবের উপর আস্থা রাখতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বাঙ্গালিরা মুজিবের উপর আসস্থা রাখেন, কারণ আমি তাকে ভালভাবে চিনি’। এইদিন তিনি তার ভাষণের সাথে ১৪ দফা দাবিও পেশ করেন। মওলানা ভাসানী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন।

স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর ভাষণের এক একটা শব্দ ও বাক্যের গুরুত্ব ছিল অনেক। রাজনৈতিক বিশ্লষক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ঐতিহাসিকগণ নিরূপণ করবেন মওলানার এ ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। যেটি ফ্রান্সের সংবাদ মাধ্যম এপি এর রেকর্ড করা। ইউটিউব এ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ভাষণটির নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন। ঝিমিয়ে থাকা ন্যাপ ও খুব একটা জাঁকজমক করে পালন করে না বা এটিকে প্রচার ও করে না সেভাবে।

যুদ্ধের শুরুতে তিনি নিরাপদ থাকলেও এপ্রিলে বাধ্য হন শরণার্থী হতে। ৪ এপ্রিল ‘কাফের ভাসানী’র খোঁজে সন্তোষে হামলা চালায় পাক বাহিনী। ভাসানী পালিয়ে যান এবং নানা কৌশলে পাকিস্থানিদের নজর এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কোষা নৌকায় করে ১০ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ পৌঁছান। ১৫ এপ্রিল সীমান্ত পাড়ি দেন তিনি এবং আসামের গোয়ালপাড়া জেলার শিশুমারীতে আশ্রয় নেন। আসামের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তার আসার এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য চান। ১৭ এপ্রিল একটি বিমানে করে ভাসানী কলকাতায় যান। শুরুতে পার্ক সার্কাসের পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের পাঁচ তলায় ভাসানী ও তাঁর সহকর্মীদের থাকতে দেয়া হয়।একই ভবনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের পরিবারও থাকতেন।

মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সেতুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। ৯ সেপ্টেম্বর গঠিত মুজিব নগর সরকারের ৮ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন ভাসানী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে তিনি সর্বপ্রথম যে দাবিটি তোলেন তা হলো বাংলাদেশ ভূখ- থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ।

সংগৃহীত, এম ইসলাম

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top