বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ ঋণ দেয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে
অগ্রগতি খবরঃ বিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাতে পুনঃতফসিলের আশ্রয় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ ও পুনঃতফসিলের শীর্ষে থাকা সরকারি-বেসরকারি ২০টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার আগেই সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গতকালের ওই বৈঠকে আলোচনার বড় অংশজুড়ে ছিল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া ঋণ দেয়া ও খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের বিষয়টি। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে ত্রৈমাসিক পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে দ্রুতই তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি তুলে ধরেন ব্যাংক এমডিরা। খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করার জন্য হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চ গঠনের পাশাপাশি বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে সমন্বিত উদ্যোগের দাবি জানান তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের এমডিরা এতে অংশ নেন। ন্যাশনাল, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), দ্য সিটি, পূবালী, সাউথইস্ট, এবি, এক্সিমসহ খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা ১২টি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়ে বৈঠকে একটি ডায়াগনস্টিক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ যেমন বেশি, তেমনি আদায়েও খুব বেশি সাফল্য নেই।
বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, ২০টি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তলব করা হয়েছিল। বৈঠকে তাদের খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এটি যাতে আর খুব বেশি না বাড়ে, তার জন্য ঋণ বিতরণের আগে ঋণের মান যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংক আইন মোতাবেক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ব্যবস্থা নেবে।
কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের উদারহস্তে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সেখানে বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। গতকালের বৈঠকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সরকারি-বেসরকারি ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা দায়ী। এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশিই চট্টগ্রামের শাখাগুলোয়। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঋণ বিতরণে বাড়তি সতর্কতা ও খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে আমাদের কিছু দোষ ছিল— এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অনেক বেশি উদার ছিল। আগ্রাসী বিনিয়োগ হয়েছে সেখানে। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমরা যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করব, সেগুলো তো সেভাবে কাজ করছে না। টাকা আদায়ের জন্য আমাদের ভরসা অর্থঋণ আদালত। কিন্তু অনেক জেলায়ই অর্থঋণ আদালত নেই। চট্টগ্রামে আগে অর্থঋণ আদালতের দুটি বেঞ্চ থাকলেও এখন একটি হয়ে গেছে। মাত্র একটি বেঞ্চ দিয়ে চট্টগ্রামে খেলাপি হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায় সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে আমরা হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চ চেয়েছি। সব জেলায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক অর্থঋণ আদালত ও বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
যদিও বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে ব্যাংকাররা এলসি খুলেছেন। ওই অঞ্চলে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণের বড় একটি অংশের জন্য ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী মনোভাবই বেশি দায়ী। এজন্য ব্যাংক এমডিদের ঋণ দেয়ার সময় বেশি সতর্ক হতে বলা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, অর্থঋণ আদালতের মামলার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। কয়েক বছর আগের তুলনায় চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। এ অবস্থায় জেলাভিত্তিক একটি অর্থঋণ আদালত যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ বা ৬৫ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা মন্দমানে শ্রেণীকৃত। এ মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা সাধারণত কম থাকে।
সাম্প্রতিক মন্তব্য