ম্যাডাম আমাকে চেনেন
মেহের জান্নাত। ।
কলেজে পড়ার সময়ই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাস্ট) লাল বাসগুলোকে সিলেট শহরের রাস্তায় দেখতাম। তখন মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম, জানালার মুখগুলো কী অসম্ভব মেধাবী! সেই বাসে চড়ার লোভ থেকেই কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিই। অদ্ভুতভাবে টিকেও যাই। অথচ ভর্তি পরীক্ষার জন্যে কিনে রাখা গাইডের এক পাতাও উলটে দেখা হয়নি আমার। ভাগ্য আমাদের জন্যে যে রাস্তা তৈরি করে রাখে আমাদের সেই রাস্তাতেই হাঁটতে হয়। প্রমাণ পেয়েছিলাম সেবার। সাস্টে ভর্তি হওয়াটা আমার জন্যে স্রেফ ভাগ্যের সহায়তা ছিল। তাই কখনোই নিজেকে এর যোগ্য মনে হয়নি। মনে হতো আমার সঙ্গে পড়ালেখা করা সবাই মেধাবী, শুধু আমি ছাড়া।
সেই আত্মবিশ্বাসহীন অবস্থায় আমি ক্লাস করা শুরু করি। নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা, গার্লস স্কুল ও গার্লস কলেজে পড়া অন্তর্মুখী স্বভাবের আমি নতুন পরিবেশে এসে আরও বেশি গুটিয়ে যাই। কারও সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি লাগত। যে বাসে চড়ার স্বপ্ন দেখে ভর্তি হলাম, সেই বাসে ধাক্কাধাক্কি করে উঠতেও তখন ভয় লাগে। তারপর তো একদিন বাসে দাঁড়িয়ে আসতে গিয়ে পড়েই গেলাম।
দিন দিন আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকছিল৷ চুপচাপ ক্লাসে আসতাম, যন্ত্রের মতো নোট করতাম। নোট শেষ করেই বাসায় দিতাম দৌড়। অনেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সদস্য হয়; আর আমি দশ হাত দূর দিয়ে চলে যাই। কেবলই মনে হয়—আমি এসবের যোগ্য না, এই জায়গার যোগ্য না।
প্রথম দিকে শুধুমাত্র শিক্ষকদের জন্যে নিয়মিত ক্লাসে যেতাম। আমরা বড় ভাগ্যবান ব্যাচ ছিলাম। বিভাগের কয়েকজন অসাধারণ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিতেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক আমিনা পারভীন ম্যাডাম। এক কোণায় বসে ক্লাস করতাম আমি। ম্যাডামের উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ খাতায় তুলে নেওয়ার ইচ্ছে হতো। প্রতিটি বিষয় এত গুছিয়ে পড়াতেন, মনে হতো তখনই বুঝে গেছি! ম্যাডামের হাসিমুখ, সবার নাম মনে রাখার ক্ষমতা ও আদরমিশ্রিত শাসন—আমাদের সবারই অসম্ভব ভালো লাগত। অথচ আমি বারান্দায় ম্যাডামকে দূর থেকে দেখলেই উল্টো দিকে দৌড় দিতাম! পালানো সম্ভব না হলে সালাম দিয়েই চলে আসতাম। চোখ তুলে তাকাতেও অস্বস্তি হতো।
ম্যাডাম হয়তো বুঝতেই পারেননি পুরো প্রথম সেমিস্টার একটা মেয়ে তার প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা নিয়ে তাঁর ক্লাসগুলো করে গেছে। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সেমিস্টারে যখন আবার ম্যাডামের কোর্স পেলাম, তখন অসম্ভব খুশি হয়েছিলাম প্রথম ক্লাসেই ম্যাডাম সস্নেহে এমন কিছু কথা বলেছিলেন যে, আমি লজ্জায় মাথা তুলতে পারিনি৷ চোখ তুলে তাকাতেও পারিনি। কথাগুলো প্রশংসাসূচকই ছিল। লজ্জা আর বিস্ময় নিয়ে আমি ভাবছিলাম, ম্যাডাম আমাকে চেনেন! প্রশংসার কিছুই আমি ভালো করে শুনতে পাইনি। আমি শুধু ভাবছিলাম, ম্যাডাম আমাকে চেনেন? আমার আবেগীয় প্রকাশ নিতান্তই কম। তাই ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে কখনো কৃতজ্ঞতার হাসিটুকুও দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে মানসিক ও পারিবারিক নানা কারণে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করা হয়নি।
ম্যাডামের কোর্সগুলোতেও খারাপ করছিলাম তখন। অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণেই হয়তো আমি কখনোই কারও সামনে ভেঙে পড়ি না। আমার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিল, মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলাম৷ তখনো ম্যাডামের দিকে তাকাতে অস্বস্তি হতো। মনে হতো, ম্যাডামের আস্থার সঠিক মূল্যায়ন আমি করছি না। আজও মনে হয়।
ম্যাডাম অনেকেরই কাউন্সেলিং করেন। শুধু নিজের বিভাগ নয়, অন্য বিভাগের অনেক ছাত্রছাত্রীও ওনার কাছে নিজেদের সমস্যার কথা ভাগাভাগি করতে আসে। ম্যাডাম অসংখ্য ব্যস্ততার মধ্যেও তাদের জন্যে হাসিমুখে সময় বের করেন। তাঁর দরজা সবার জন্যেই উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু সেই উন্মুক্ত দরজা দিয়ে আমার কখনো ঢোকা হয়নি। একান্ত প্রয়োজনে যখনই গিয়েছি, বের হওয়ার পর মনে হয়েছে কিছুই বলা হয়নি।
ম্যাডাম বিভাগের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে৷ বিশ্ববিদ্যালয়জীবন প্রায় শেষের পথে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আপনার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর পাব না৷ আপনি নিজের অজান্তেই আমার তলানিতে ঠেকে যাওয়া আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিলেন। এমনকি প্রত্যেকবার হাসিমুখে আপনার ‘ভালো আছি কিনা’ জিজ্ঞেস করাটাও আমার জন্যে দোয়ার মতো ছিল।
ভালো থাকবেন ম্যাডাম। শিক্ষক দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
* মেহের জান্নাত: সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী
সাম্প্রতিক মন্তব্য