logo
news image

সাত রঙা চায়ের রহস্য উদঘাটনে শাবি শিক্ষার্থীরা

মোয়াজ্জেম আফরান, শাবি।  ।  
বাংলাদেশের চায়ের নগরী শ্রীমঙ্গল। মৌলভীবাজারের এখানে এসেছেন, ‘সাত রঙা’ চায়ের স্বাদ নেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এই চায়ের স্বাদ যেমনই হোক, সবার কৌতূহল রং নিয়ে। স্বচ্ছ গ্লাসে ভিন্ন রঙে সাতটি স্তরে সাজানো এক কাপ চা। চামচ ছাড়া যতই নাড়াচাড়া করা হোক না কেন স্তরগুলো ভাঙবে না, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ভীষণ আগ্রহের।
এই চায়ের উদ্ভাবক রমেশ রাম গৌড়। সম্প্রতি এই চায়ের রহস্য, উদ্ভাবনের গল্প, পর্যটকদের মনোভাব বিষয়ে মাঠকর্ম গবেষেণা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থী।
ছয় শিক্ষকের অধীনে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ২০১৪-১৫ সেশনের ৬৬ শিক্ষার্থী মাঠগবেষণা করেন। তারা শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, চা ও চা শ্রমিকদের জীবনাচার নিয়ে গবেষণা করেন। প্রত্যেক গ্রুপের গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুর-উল হায়দারের অধীনে থাকা শিক্ষার্থীদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল রমেশ রাম গৌড়ের সাত রঙা চায়ের রহস্য ও তা নিয়ে পর্যটকদের মনোভাব।
তিন দিন ধরে শ্রীমঙ্গল ঘুরে এই দলের শিক্ষার্থীরা দেখেছেন, সাত রঙা চায়ের ৭০ ভাগ ক্রেতা বাইরের, তারা ঘুরতে এসে স্বাদ নেন। এদের মধ্যে ৬০ ভাগই প্রথমবারের মতো এই চা পান করেন। আগতদের ৮৫ ভাগই চায়ের স্বাদ নয়, সাতটি রঙের প্রতি বেশি কৌতূহলী।
শ্রীমঙ্গলের সাত রঙা চা পাওয়া যায় মণিপুরি অধ্যুষিত রামনগর ‘আদি নীলকণ্ঠ’ চা কেবিনে। খোলামেলা পরিবেশে সাধারণ একটি দোকান। ভেতর-বাইরে বসার জায়গা করা। সেখানে বসে আগন্তুকরা চায়ের অর্ডার করছেন। গল্প-আড্ডা দিচ্ছেন আর চা পান করছেন।
গবেষক দলকে সময় দেন এই চায়ের উদ্ভাবক রমেশ রাম গৌড়। হাস্যোজ্জ্বল পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিই নিজেই সবার জন্য চায়ের অর্ডার দেন। ফাঁকে ময়মনসিংহ থেকে শ্রীমঙ্গলে আসা এবং চা উদ্ভাবনের গল্প বলে চলেন।
দরিদ্র রমেশ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা থেকে ভাগ্য বদলে ২০০০ সালের ৫ মার্চ স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও এক ভাইকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল আসেন। এখানে রামনগর মণিপুরি পাড়ায় একটি বাসা ভাড়া নেন। আর পৌরশহরের নতুন বাজার এলাকায় একটি চায়ের দোকানে চাকরি নেন।
চাকরি ছেড়ে রমেশ ২০০১ সালে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) সংলগ্ন ফিনলে টি কোম্পানির কাকিয়াছড়া চা বাগানে নিজে চায়ের দোকান দেন।
এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০২ সালে প্রথম একটি গ্লাসে দুটি স্তরে দুই রঙা চা উদ্ভাবন করে হৈ চৈ ফেলে দেন রমেশ। নিজের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে তিনি এখন পর্যন্ত দুই থেকে ১০ রঙা চা তৈরি করা শিখেছেন। কিন্তু, সবখানে তার এই চা সাত রঙা নামেই খ্যাতি অর্জন করেছে।
কথা প্রসঙ্গে রমেশ জানান, রাতে দোকান বন্ধ করার পর চা নিয়ে তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। বিভিন্ন স্তরে চা বসানোর জন্য প্রতিদিন দু’তিন ঘণ্টা অনুশীলন করতেন। এভাবেই দিনকে দিন চায়ের স্তর ১০টিতে নিয়ে গেছেন রমেশ।
এরপরই সাত রঙা চায়ের রহস্য জানতে চান গবেষকরা। কিন্তু, হাসি মুখে বিনয়ের সঙ্গে রমেশ বলেন, ‘এটাতো আমি কাউকে কখনো বলি না, বলবও না। এটা বললে এই চায়ের প্রতি মানুষের আর কোনো কৌতূহল থাকবে না।’তবে তিনি একেবারে বিমুখ করেননি। গ্রিন ও ব্লাকটি, লেবু, আদা, দারুচিনি, লং, এলাচ, মসলা, গরুর খাঁটি দুধ ইত্যাদির মিশ্রণে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে এই চা তৈরি হয় বলে জানান।
সরকারের চা বোর্ডসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রমেশের চা পরীক্ষা করেছে। কিন্তু, কোনো কেমিক্যাল কিংবা অস্বাভাবিক কোনো উপাদান খুঁজে পায়নি।
রমেশ জানান, এই চা তৈরির কৌশল তিনি নিজের তিন ছেলে ও ভাইকে শিখিয়েছেন। দোকানের ছোট্ট একটি কক্ষে দরজা বন্ধ করে চা তৈরি করেন তারা। সিসিটিভি, টেলিভিশন ক্যামেরার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। আমৃত্যু এই গোপনীয়তা বজায় রাখার ইচ্ছে রমেশের।
এরপর গবেষকদল বিভিন্ন পর্যটক ও আগন্তুকদের সঙ্গে সাত রঙা চা নিয়ে কথা বলেন। নরসিংদী থেকে সাত রঙা চায়ের টানে পরিবার নিয়ে আসা আব্দুল হালিম জানান, বিভিন্ন মাধ্যমে সাত রঙা চা সম্পর্কে অনেক জেনেছি। কৌতূহল মেটাতেই এসেছি। ভাল লেগেছে।
সাত রঙা চায়ের আরেকটি দোকান শ্রীমঙ্গল কালীঘাট রোডের ১৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ক্যান্টিনে, নাম ‘ফ্যামাস নীলকণ্ঠ চা’ কেবিন। সেখানে চা পান করতে থাকা নাবিলা ফরিহা গবেষক দলকে বলেন, ‘এ চায়ের অনেক সুখ্যাতি। বাসা কাছে হওয়া সত্ত্বেও আগে কোনো দিন আসিনি। বন্ধুদের ইচ্ছেপূরণে এসেছি।’
সাত রঙা চায়ের টানে ভারত, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা তিন পর্যটকই জানান, বিভিন্ন মাধ্যমে সাত রঙা চায়ের রহস্য জেনে তারা পান করতে এসেছেন।
এদের মধ্যে ব্রিটিশ পর্যটক জানান, বিখ্যাত ভ্রমণ বই ‘লোনলি প্ল্যানেট’ থেকে সাত রঙা চায়ের চমৎকার বর্ণনা পেয়ে তিনি এসেছেন।
সাত রঙা চা নিয়ে শাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবষেক দলে ছিলেন সানজিদা চৈতি, সাব্বির হোসাইন, জুবায়েরুল হক, সালমা বেগম, রাবিনা সুলতানা অনন্যা, আসমা আজাদ, আতিকুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, উম্মে জান্নাতুল মোহসিনা ও আব্দুল্লাহ আল সুমন।
সালমা বেগম বলেন, ‘সাত রঙা চা নিয়ে কাজ করা নতুন অভিজ্ঞতা। অনেক কিছু জানতে পেরেছি।’
আতিক, চৈতী ও জুবায়ের বলেন, ‘নৃবিজ্ঞান মানুষ ও মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে। মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয়ই নৃবিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়। তাই গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে সাত রঙা চা খুবই সময়োপযোগী। মাঠপর্যায়ে কাজ করে খুবই ভালো লেগেছে। ভবিষ্যতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব।’
এই গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মনজুর-উল হায়দার বলেন, ‘নৃবিজ্ঞানের অপরিহার্য প্রশিক্ষণ হলো মাঠকর্ম। তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা মাঠকর্মের কোর্সের (এএনপি-৩৫০) অংশ হিসেবে সাত রঙা চা নিয়ে কাজ করেছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমিও নতুন কিছু তথ্য এবং অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। আশা করি, এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হবে।’
শিক্ষার্থীদের গবেষণার বিষয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘সাত রঙা চা নিয়ে মানুষের ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এ কাজের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতে ভালো গবেষণামূলক কাজ করতে পরবে।’

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top