logo
news image

স্মরণ: আদর্শের প্রতীক আমার বাবা

অধ্যক্ষ ইমাম হাসান মুক্তি।  ।  
মরহুম ইসহাক আলী। আমার বাবা। দাদার গোষ্ঠীর জেষ্ঠ্য সন্তান। সুরাইয়া খাতুন। আমার মা। নানার গোষ্ঠীর জেষ্ঠ্য সন্তান। সেই সুবাদে আমি দাদা ও নানার গোষ্ঠীর নাতি হিসেবে জেষ্ঠ্যতার অবস্থান পেয়েছি। দুই কূলের আত্মীয়তার বন্ধনে আমার প্রতি স্নেহ-ভালবাসার সবটুকুই আমার ভাগ্যে জুটেছে। আর এই ভালবাসা-ই আমাকে সবার প্রতি ভালবাসতে শেখার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে আমার ভালবাসার প্রতি চরম দুর্বলতা এনে দিয়েছে। আর এই ভালবাসার ফসল আমার আজকের সফলতা। আমার বাবার স্মরণেই আজকের লেখা।
আদর্শ বাবা: আমার বাবা একজন আদর্শ বাবা। ছোট বেলায় বাবা শিখিয়েছেন কীভাবে নিজেদের মধ্যে অল্প জিনিস ভাগাভাগি করে নিতে হয়। সেই শিক্ষা থেকে আমার পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব কোন সমাজেই আমি একা কিছু ভোগ করতে পারি না। যা-ই হোক না কেন সবাই মিলে ভাগাভাগি করতে শিখেছি। এমন কী চরম ক্ষুধার সময় পকেটে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও একা কিছু খাওয়া ঐদ্ধত্য এখনো আমার হয়নি। সেই সাথে বাবা শিখিয়েছেন বড়দের প্রতিশ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ, প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধবদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য। আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা।
ভালবাসার প্রতীক বাবা: কলেজের গন্ডি পেরিয়ে আমি সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। অনেক দূর। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরাঞ্চলের হাতে গোনা কয়েকজন ছিলাম। বাড়ি আসলে লালপুর বাজার থেকে বাবা আমাকে বাসে তুলে দিতেন। বিদায় জানানোর সময় মুখ লুকিয়ে চোখের পানি মুছতেন। আমি দেখতে পেলে কষ্ট পাব জন্য চুপি চুপি রুমালে চোখ মুছে বিদায় জানাতেন। আমিও একইভাবে বাবার সাথে অভিনয় করতাম।
দায়িত্ববান বাবা: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার দাদা ইয়াজ উদ্দিন প্রামাণিক আমার হাত খরচের জোগান দিতেন। দাদা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত এ সুবিধা আমি ভোগ করেছি। যা থেকে সামাজিক কর্মকান্ডে অর্থের যোগান হয়েছে। লালপুর শ্রী সুন্দরাী পাইলট হাইস্কুলে পড়ার সময় বাবা আমার জন্য বাজারে গোবিন্দ কাকার দোকান বরাদ্দ করে দিয়ে ছিলেন প্রতিদিন দুটি করে সিঙ্গারা। মাঝে মধ্যে দু-তিন দিনের বরাদ্দ একত্রে কয়েকজন বন্ধু মিলে একদিনে তা খেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতিমাসে বেতন তুলেই প্রথমে আমার জন্য টাকা পাঠিয়ে বাড়ি ফিরতেন। সব সময় বলতেন আমি একটু কষ্ট করে চলতে পারবো। আমার সন্তান যেন কষ্ট না পায়।
শাসক বাবা: পড়াশুনার জন্য বাবার শাসন ছিল কঠোর। ছোট্ট থেকেই আমি ডানপিটে স্বভাবের। জীদ একটু বেশি। এসএসসি পরীক্ষার আগেও রাতভর আড্ডা দিতাম। একদিন বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইংরেজি রচনা কী পড়েছ?’ আমি বললাম সবগুলো পড়েছি। সবগুলো মানে? আমি বললাম একটা মুখস্থ করেছি। ওইটা অনুকরণ করে যে কোন রচনা লিখতে পারবো। বাবা রেগে গিয়ে আমাকে বললেন, বেশি বুঝে গেছ! তাই বলে আমাকে ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ করে চলে গেলেন। আমি ঘরের দরজা ভেঙ্গে পালায়। তখন রেগে আগুন হয়ে বললেন, তোর পড়া লাগবে না। আমার বইগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিলেন। পরে আবার নতুন বই কিনে এনে বুকে টেনে নিয়ে ভাল করে পড়ার জন্য তাগিদ দিলেন। যা এখন শুধুই স্মৃতি।
প্রশিক্ষক বাবা: একজন ভাল প্রশিক্ষক ছিলেন বাবা। বাড়ির পাশে পদ্মা নদীতে গোসল করতে গিয়ে আমাকে সাঁতার শিখিয়েছেন স্নেহের সাথে। দাবা, ক্যারাম, লুডু, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলা শিখিয়েছেন আমাকে তিনি নিজেই কোচ হিসেবে।
আমার অনুপ্রেরণা বাবা: আমার জীবনের সফলতার অনুপ্রেরণা আমার বাবা। তৃতীয় শ্রেণিতে আমার প্রথম কবিতা জংশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অষ্টম শ্রেণিতে শ্রী সুন্দরী হাইস্কুলের স্মরণিকা মঞ্জুরীতে  প্রকাশিত হয় কবিতা। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে থানা কেন্দ্রীয় পাঠাগার ও লালপুর থানা কেন্দ্রীয় প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলাম। ১৯৯৫ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব স্থাপনসহ পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ততা পেশায় রূপ নেয়। কলেজ প্রতিষ্ঠা, অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন, প্রথম আলোর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় দায়িত্ব গ্রহণ, লালপুর বার্তার প্রকাশনা সব কিছুতেই ছিল আমার বাবার ঐকান্তিক অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা। সর্বপরি দৈনিক প্রাপ্তি প্রসঙ্গ অন-লাইন ও ছাপা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগে সর্বাত্মক অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পেয়েছি বাবার। পরিতাপের বিষয় ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক প্রাপ্তি প্রসঙ্গ অন-লাইন পত্রিকা শুভযাত্রা হলেও বাবা তা দেখে যেতে পারলেন না। মাত্র তিন দিন আগে ১১ ডিসেম্বর চির বিদায় নিলেন তিনি। পত্রিকার মূদ্রণ সংস্করণ ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর চালু হলো আজ। শুকতারা হয়ে চলার পথে এখনো অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন বাবা।
ইসলামের সেবক বাবা: মা বলেন, বিয়ের আগে থেকেই বাবা নিয়মিত নামাজ পড়তেন। শেষ জীবন পর্যন্ত তা অব্যহত ছিল। তাবলীগ জামায়াতের সুরার সাথী হিসেবে ইসলামের খেদমত করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে যাবার সময় আমাকে একটা ডাক না দিয়ে মসজিদে যান নি। নিয়মিত তিনি তাবলীগ জামায়াতে সব নিয়ম মেনে চলেছেন। শেষ দিনেও তিনি আল্ল­াহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে বিদায় নিয়েছেন।
সমাজ সেবক বাবা: আমার বাবা বৃহৎ পরিসরে কিছু করেন নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরী জীবন শেষ করেন। প্রায় কুড়ি বছর লালপুর থানা কেন্দ্রীয় মসজিদ ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে বাবার উপস্থিতি ছিল নন্দিত।
প্রগতিশীল বাবা: দাদির মুখে শুনেছি, সঙ্গিত আর নাটকে ঝোঁক ছিল বাবার। আমি দেখিনি। আমার বুদ্ধি হবার পর একদিন বাবা বাক্সে সঙ্গিত আর নাটকের পান্ডুলিপি চোখে পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বাবা বললেন, আমি তো আর ওসব পথে নেই। এগুলো আর সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয়, এটাই জীবগত প্রভাব। এ জন্যই আমার সব ধরণের প্রগতিশীল ও সৃষ্টিশীল কাজে বাবার অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা ও সমর্থন ছিল সব-সময়।
আমার শিক্ষক বাবা: বালিতিতা মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে আমার বাবার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। পরে নাওদাঁড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন সেখানে। ছোট বেলায় বাবার সাথে পায়ে হেঁটে গিয়েছি। ওই এলাকার মানুষ বাবাকে অকৃত্রিম ভালবাসা দিয়েছেন। শেষ জীবন পর্যন্ত ওই সম্পর্ক অটুট ছিল। এর পর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাবার হাতেই আমার শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি। বাবা নিজে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বাবার হাতের লেখা ছিল অনুকরণীয় সুন্দর, ঝকঝকে-পরিষ্কার। তিনি নবীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এর পর থেকে পুরো সময় তিনি অতিবাহিত করেন দ্বীনের রাস্তায়।
সফল বাবা: আমার বাবা চাকুরী আর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি ইহ-জগতের সংসার জীবনেও সফল ছিলেন। একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে আমার মা আমার বাবাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমিসহ আমার বোন জুবাইদা খাতুন মিলিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাই ইহসানুল হাসানকে কুরআনে হাফেজসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করিয়েছেন। আরো দুই বোন জুলাইখা খাতুন শিল্পী ও জুয়াইরিয়া খাতুন লিপিসহ আমাদের পাঁচ ভাইবোনের বিয়ে দিয়ে ফরজ আদায় করে গেছেন। কলেজের অধ্যক্ষ ও সাংবদিকতা পেশায় আমার প্রতিষ্ঠা দেখে গেলেও ছোট ভাই ইহসানুল হাসানের প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমার ওপর অর্পন করে যেতে ভুলেন নি তিনি। দ্বীন শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোন ত্রুটি রাখেন নি। সন্তানদের পারিবারিক জীবনের সফলতা তিনি চোখে দেখে গেছেন।
স্নেহ সুলভ আমার বাবা: আমার দুই সন্তান নুজহাত ইমাম প্রাপ্তি ও ফাইরুজ ইমাম প্রসঙ্গ ছিল তাঁর চোখের মণি। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আবার বাড়িতে ঢোকার সময় ‘দা-দু’ ডাক ছিল তাঁর নিয়মিত কাজ। বাইরে কোথাও গেলে তাদের খোঁজ ছিল সবসময়। আমরা ভাই-বোনেরা যতক্ষণ বাইরে থাকতাম চাতক পাখির মতো পথের দিকে চেয়ে থাকতেন আমাদের ফেরার অপেক্ষায়। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেতেন না।
বাবার শেষ বিদায়: গত বছর ১৯ নভেম্বর জোড় ইস্তেমাতে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে যান টঙ্গী ময়দানে। সেখান থেকে পাঁচ দিনের জোড় শেষে এক চিল্লার জন্য চলে যান পটুয়াখালির কলারোয়া উপজেলায়। ইচ্ছে ছিল চিল্ল­া শেষ করে বিশ্ব ইস্তেমায় অংশগ্রহণ শেষে বাড়ি ফিরবেন। একটি মসজিদে অবস্থান করছিলেন। এর মধ্যে ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ (শুক্রবার) ভোর রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। ফজরের নামাজের আগে মসজিদে ঘুমন্ত অবস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। ওই দিন বিকেল ৫টায় বাবার নিথর দেহ বাড়ি পৌঁছে। রাত ৮টায় জানাযা শেষে বালিতিতা ইসলামপুর কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। বাবার জানাযার নামাজে ইমামতি করে আমার ছোট ভাই হাফেজ মো. ইহসানুল হাসান। আমরা দুই ভাই কবরের ভেতর বাবার দাফন সম্পন্ন করে বাবাকে চিরবিদায় জানাই না ফেরার দেশে।
বাবা ছিলেন একজন অতি সাধারণ মানুষ। তাঁর কর্মজীবন, ব্যক্তিগত জীবন, ধর্মীয় জীবন, সামাজিক জীবন ছিল সুশৃঙ্খল। বাবার জীবদ্দশায় চলার পথে যদি কোন ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে আপনার নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। আমি বাবার পক্ষ থেকে বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থী। যাঁরা আমার বাবাকে শেষ বিদায় জানাতে কষ্ট উপেক্ষা করে শীতের রাতে জানাযা নামাজ, দোয়া ও দাফনে শরীক হয়েছেন তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। সেই সাথে আমার বাবা আপনাদের একজন আত্মার আত্মীয় হিসেবে তাঁর জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাঁকে শহীদ হিসেবে মৃত্যু কবুল করে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন। আমরা তাঁর পরিবার-পরিজন হিসেবে আপনাদের স্নেহ-ভালবাসা, দোয়া ও দিকনির্দেশনা আন্তরিকভাবে কামনা করি। যা আমাদের পথের পাথেয় হিসেবে বাবার শুণ্যতা পূরণে ভূমিকা রাখবে। আল্লাহ যেন দ্বীনের রাস্তায় আমাদের কবুল করেন। আমিন।
(মো. ইসহাক আলী, পিতা-মরহুম ইয়াজ উদ্দিন প্রামাণিক, মাতা- মরহুম বদন। জন্ম: ৩০ অক্টোবর ১৯৪৪, মৃত্যু: ১১ ডিসেম্বর ২০১৫, শুক্রবার)

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Top